আরিফ আজাদ
‘ঢাকা শহরে বাড়ছে ডিভোর্সের হার’- এমন শিরোনামের একটা সংবাদ কিছুদিন আগে পত্রিকায় পড়লাম। খবরটা আশঙ্কাজনক। উদ্বেগেরও বটে। ‘পরিবার’ হলো একটা সভ্যতার সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান স্তম্ভ। পরিবার ভেঙে পড়লে সভ্যতা ভেঙে পড়ে।
আরেকটা খবরে জেনেছিলাম, দেশের অধিকাংশ মানুষ বিবাহিত জীবনে সুখী নয়। তারা তবুও সংসার করছেন। হয়তো সন্তানাদি হয়ে গেছে বলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সংসার করে যাচ্ছেন, নয়তোবা সমাজের কাছে ছোট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তারা সংসার ত্যাগ করেন না। তবে, মনে মনে তারা খুব অসুখী। এই অসুখের কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পুরুষদের অধিকাংশই তাদের সহধর্মিণীর প্রতি আর কোন আকর্ষণ অনুভব করেন না। বিয়ের বছর পাঁচেক, কিংবা বছর দশেকের মাথায় তাদের মনে হয় যে- তাদের সহধর্মিণী হয় বুড়িয়ে গেছে, নয়তো মুটিয়ে গেছে। শুরুতে যে আকর্ষণ, যে প্রেম আর ভালোবাসা সহধর্মিণীর জন্য হৃদয়ে তৈরি হতো, তার ছিটেফোঁটাও এখন তারা আর পান না।
কথাটা মিথ্যে নয়। সৌন্দর্য জিনিসটা ক্ষয়িষ্ণু। সময়ের সাথে সাথে তার ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। বাগানের সবচেয়ে সুন্দর গোলাপটাও দিনশেষে নেতিয়ে পড়ে, শুকিয়ে যায়। তবে আমাদের মনে রাখা উচিত, বিবাহ জিনিসটা কেবল শারীরিক সম্পর্কে আবদ্ধ কোন স্থির বস্তু নয়। বিবাহ একটা বন্ধন। জৈবিক চাহিদাটা এই বন্ধনের একটা অংশ মাত্র, সমস্ত কিছু নয়। একবার, একলোক ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে এসে বললো যে সে তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চায়, কারণ-স্ত্রীর প্রতি সে আর কোন আকর্ষণ অনুভব করেনা। তাকে আর ভালোবাসেনা। ওমর রাদিয়াল্লাহু বললেন, ‘কেবল ভালোবাসাই সব? তার যত্ন, খেয়াল, তোমার জন্য তার মায়া-মহব্বত, তোমার সন্তানদের জন্য তার ত্যাগ এসব কিছুই না?’
যেসব পুরুষ কেবল ‘আকর্ষণ’ অনুভব না করলে সংসার ভেঙে দিতে চায়, তারা আসলে নারীটাকে বিয়ে করেনা, বিয়ে করে তার শরীরটাকে। একই কথা নারীদের বেলাতেও প্রযোজ্য। একটা সম্পর্ক আগাবে পরস্পর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, মায়া-মমতা, যত্ন-খেয়ালের ওপর ভিত্তি করে। তারচেয়েও বড় কথা হলো- ‘ইহসান’। দয়া করা।
ইহসান জিনিসটাই আমাদের মধ্য থেকে বিলুপ্ত এখন। কেবল ‘আকর্ষণ’ না পেলেই আমরা এতোদিনের একটা সম্পর্ক ভেঙে দিতে চাই, অথচ এতোদিনের সংসারে তার সাথে কাটানো আমার ভালো মুহূর্তগুলো, তার ভালো গুণগুলো, ভালো কাজগুলোর কথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। স্মরণ করতেই চাইনা। যদি আমরা পরস্পর পরস্পরের ব্যাপারে ‘ইহসান’-ই না করতে পারি, সেখানে ভালোবাসাটা জন্মাবে কোত্থেকে?
কেনো এমন হয়? কেনো আমরা আমাদের সঙ্গিনীর ওপর থেকে আকর্ষণ হারাই? ব্যাপারটাকে বুঝতে হলে দুটো দৃশ্য কল্পনা করা যাক।
ধরা যাক, আপনি আপনার সঙ্গিনীর ওপর থেকে সমস্ত আকর্ষণ হারিয়ে বসে আছেন। তাকে দেখলেই আপনার বিরক্ত লাগে। ঘরে ফিরতেই মন চায়না। এককথায়- তার কাছ থেকে পালাতে পারলেই আপনি বেঁচে যান। আবার অন্যদিকে, আপনার অফিসের মেয়ে কলিগ, যে আপনার ডেস্কের পাশে বসেই কাজ করে, তার প্রতি আপনার দূর্বার আকর্ষণ।
আপনার স্ত্রী যে পোশাক পরে, যে লিপস্টিক ঠোঁটে দেয়, যে পারফিউম মেখে আপনার কাছে আসে, আপনার ওই কলিগও ঠিক একই পোশাক, একই লিপিস্টিক, একই পারফিউম মেখে আপনার পাশে বসে অফিস করে। কিন্তু, আপনি আপনার স্ত্রীর প্রতি কোন আকর্ষণ-ই পান না। অন্যদিকে কলিগের ওপর আপনি পুরোই ফিদা! সে হাসিমুখে কথা বললে আপনার হৃদকম্পন বেড়ে যায়। আপনি ভাবেন, ‘আহা! তার স্বামীর কপাল বটে!’
আবার ধরা যাক, আপনার স্ত্রী যে অফিসে কাজ করে, ঠিক একই অফিসে কাজ করে আপনার ওই মেয়ে কলিগের স্বামী। বেচারাও তার স্ত্রীর প্রতি কোন আকর্ষণ পান না। ঘরে ফিরতেই তার বিষ লাগে। কিন্তু, আপনার স্ত্রীর প্রতি সে খুব দূর্বল। আপনার স্ত্রী অফিসে যখন তার সাথে গুছিয়ে আলাপ জমায়, তখন তার বুকে ধুকপুকানি শুরু হয়। সে ভাবে, ‘আহা! এই মহিলার স্বামীর কপাল একটা!’
দৃশ্য দুটোতে দেখুন, স্ত্রীর প্রতি আপনি কোন আকর্ষণ পাচ্ছেন না, যতো আকর্ষণ কলিগের প্রতি। আবার, আপনার কলিগের যে স্বামী, সে কিন্তু তার বউয়ের প্রতি আকর্ষণ পাচ্ছেনা। যতো আকর্ষণ আপনার বউয়ের প্রতিই। এখানে মূলত ব্যাপারটা কি জানেন? পদস্খলন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা ঠিক এজন্যেই আমাদের নজর হেফাযতের, চক্ষু হেফাযতের আদেশ দিয়েছেন। তিনিই তো আমাদের সৃষ্টিকর্তা। আমাদের মেকানিজম সম্পর্কে তারচে ভালো আর কে জানে? তিনি জানেন কোথায় আমাদের দূর্বলতা। এজন্যেই তিনি বারে বারে আমাদের নজর হেফাযতের আদেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালার কোন নিয়ম, কোন বিধান-ই অযৌক্তিক হতে পারেনা। চিন্তা করুন, যে লোক তার বউয়ের প্রতি আকর্ষণ না পেয়ে, কলিগের প্রতি আকর্ষণ পাচ্ছে, তার সাথে কেনো এমনটা হচ্ছে? কারণ সে নজরের হেফাযত করছেনা। পর-নারী থেকে সে নিজেকে গুটিয়ে রাখছেনা। ফলে, শয়তান ওই পর-নারীকে তার সামনে অপরূপ, অপূর্ব করে তুলে ধরছে আর সে ধোঁকা খাচ্ছে। অথচ, যাকে সে পছন্দ করে বসে আছে, ঠিক তাকে বাসায় আরেকজন অপছন্দ করছে। তার ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটছে। নজরের হেফাযত হচ্ছেনা। ফলে, পদস্খলন।
এই যে পর্দার বিধান, মাহরাম-নন মাহরামের বিধান, দৃষ্টি হেফাযতের বিধান, এসবগুলো তো এমনি এমনি দেওয়া হয়নি। আজকের সমাজে এই যে মহামারি আকারের পরিবার ভাঙন, সংসারে অশান্তি, অনৈক্য- খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এর পেছনে কোনো না কোনোভাবে ‘পর্দা’র ব্যাপারটা জড়িত। যে লোক নিজের দৃষ্টি হেফাযত করে চলে, মাহরাম-নন মাহরাম মেনে চলে, যে লোক কখনো কোন পর-নারীর দিকে দৃষ্টিপাত করেনি বা করেনা, তার কাছে তার স্ত্রী-ই জগতের সবচেয়ে সেরা সুন্দরী। তার দেখা জগতের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা। ওই লোক কি তার স্ত্রীর ওপর থেকে আকর্ষণ হারাতে পারে?
'পরিবার ভাঙন' নামে যুগের এই মহামারি সমস্যাকে দূর করতে হলে আমাদের মূলে ফিরে যেতে হবে। ফিরে যেতে হবে ইসলামের সুমহান বুনিয়াদি শিক্ষার মাঝে। বাঁচাতে হবে আমাদের পরিবার। সবার আগে বাঁচাতে হবে নিজেকে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন