আলফাজ আনাম
চলে গেলেন খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান। একটি দৈনিক পত্রিকায় কাজের সূত্রে স্যারের অসংখ্য সাক্ষাতকার আমাকে নিতে হয়েছে। পত্রিকাটিতে স্যার মাঝে মাঝে বিভিন্ন ইস্যুতে লিখতেন। অনেক সময় বলতেন বাংলায় আমার লেখাতো তেমন ভালো নয়। আমি বলি, তুমি লিখো। ছোট ৬০০ থেকে ৮০০ শব্দের লেখাগুলো অনেক সময় অনুলিখন নিতে হয়েছে।
যখনই স্যারের সাক্ষাতকার বা লেখা নিতে গিয়েছি ছোটখাটো এই মানুষটিকে দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টারের ড্রয়িংরুমে চারদিকে বইয়ের স্তুপের মধ্যে। যখনই ফোন করতাম, কখনই না বলেননি। উত্তর ছিলো বিকেলে আসো। পরম স্নেহে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সর্ম্পকের দিক, বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতি, আর ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায় বুঝিয়ে বলতেন। ২০০৬ বা ২০০৭ সালের দিকে স্যারের একটি আত্নজীবনী লেখার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো। বেশ কিছু বক্তব্য রেকর্ড করে কয়েক পৃষ্টা লেখাও হয়েছিলো। স্যারের অসুস্থতা আমার অলসতার কারনে কাজটি আর এগোয়নি। স্যারের মৃত্যুর খবর পাওয়ার বার বার স্যারের আতœজীবনী লেখা না হওয়ায় এক ধরনের অপরাধবোধে ভুগছি। এমন অপরাধবোধে ভুগছি মারা যাওয়ার সপ্তাহ দেড়েক আগে মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী ফোন করে বলেছিলেন, তুমি একটু আসো। বাংলাদেশের গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই। ব্যস্ততার নামে অলসতার কারনে মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর সাথে আর দেখা হয়নি। যদি লেগে থাকতাম হয়তো তালুকদার মনিরুজ্জামান স্যারের আত্নজীবনীটি লেখা হতো।
যে দৈনিক পত্রিকাটিতে কাজ করতাম সেখান থেকে একটি মাসিক ম্যাগাজিন আমাকে সম্পাদনা করতে হতো। ম্যাগাজিনটির জন্য স্যারের কয়েকটি দীর্ঘ সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। সর্বশেষ স্যারের সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সাথে ছিলেন প্রথম আলোর তাইয়েব আহমেদ। ( বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চতর পড়াশুনা করছে) আমি যে পত্রিকায় কাজ করতাম তাতে ছোট এই সাক্ষাতকারটি ছাপা হয়েছিলো। তাইয়েব আহমেদের নেয়া সাক্ষাতকারটি প্রথম আলোর ইংরেজি অনলাইনে প্রকাশ হয়েছে । সার্চ দিয়ে দেখলাম সেটা এখনও পাওয়া যাচ্ছে। ( https://en.prothomalo.com/…/Evocative-of-%E2%80%9860s-dream…)
স্যার আরেকটি কাজের কথা বলেছিলেন। প্রথমবার স্ট্রোক করার পর বলেছিলেন আরেকটু সুস্থ হলে হজরত মুহাম্মদ সা: রাষ্ট্র পরিচালনার দিক নিয়ে তিনি একটি বই লিখবেন। এ নিয়ে পড়াশুনাও শুরু করেছিলেন। স্টেটসম্যান মুহাম্মদ (সা:)। অসুস্থতার কারনে স্যার আর সে কাজটি শুরু করতে পারেননি।
বাংলাদেশের রাজনীতির স্বরুপ ও ইতিহাসকে বুঝতে তালুকদার মনিরুজ্জামানকে বাদ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বোঝার জন্য “দ্য সিকিউরিটি অফ স্মল স্টেটস ইন দ্য ওয়ার্ল্ড” স্যারের এক অনন্য গবেষণা। আগ্রহীরা স্যারের বইগুলো দেখতে পারেন। অধিকাংশ বই প্রকাশ করেছে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। একবার সাক্ষাতকার নেয়ার সময় জিজ্ঞাস করেছিলাম আপনার জীবনের সেরা অর্জন কী? স্যারের হাতে তখন ছিলো হলুদ রংয়ের কভারে দ্য বাংলাদেশ রেভিউলিশন এন্ড ইটস আফটারম্যাথ বইটি। হাতে থাকা বইটি দেখিয়ে বললেন এগুলো আমার সেরা অর্জন। এরপর বইটিতে সাক্ষর করে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। এ রকম অনেক স্মৃতি আজ মনে পড়ছে। পাঠকদের সামনে স্যারের বইগুলোর নাম দিলাম।
The Politices of Develpoment : The Case of Pakistan (1947-1958) # Radical Politics and the Emergence of Banlgadesh# The Bangladesh Revolution and its Aftermath # The Security of Small States in the Third World # Group Interests and Politicals Changes : Studies of Pakistan and Bangladesh # Military wihtdrawal From Politics : A Comparative Study ,# Politics and Security of Banlgadesh# Japan's Security Policy for the twenty-first century বাংলাদেশের রাজনীতি সঙ্কট ও বিশ্লেষণ।
খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামানের জন্ম সিরাজগঞ্জের তারাকান্দি গ্রামে ১৯৩৮ সালের ১ জুলাই। পিতা আব্দুল মজিদ তালুকদার ছিলেন স্কুলশিক্ষক। কৈশোর কেটেছে গ্রামেই। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন তারাকান্দি মাইনর স্কুলে। এরপর ভর্তি হন সিরাজগঞ্জ হাইস্কুলে। এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন। এইচএসসিতে মেধা তালিকায় প্রথম হন। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। অনার্সে প্রথম শ্রেণী এবং মাস্টার্সে দ্বিতীয় শ্রেণী লাভ করেন। বৃত্তি নিয়ে ১৯৬৩ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান কানাডায়। পড়াশোনা করেন কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে। ১৯৬৬ সালে দেশে ফিরে যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বছরই বিয়ে করেন একই বিভাগের ছাত্রী রাজিয়া আক্তার বানুকে। প্রায় সাত বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শেষে ১৯৭৪ সালে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন ২০০৬ সালে। এর আগে তাকে জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করা হয়।
তালুকদার মনিরুজ্জামান শুধু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন না। ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক ব্যক্তি। যিনি সব সময় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে থাকতেন উদ্বিগ্ন। আল্লাহ আপনাকে জান্নাতবাসী করুন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন