মো. ইলিয়াস
"তিনি" রাজাকার ছিলেন, তার এলাকার একটা অংশ তাকে পিচ কমিটির সভাপতি হিসেবে জানতো, থানা পুলিশের নথিপত্রে ওই এলাকার পাকিস্তানের বিশ্বস্ত লোকের তালিকায় তার নাম এক নাম্বারে।
লোকটি পাক সেনাদের আশ্বস্ত করেছেন তার এলাকায় মুক্তিবাহিনী নেই। সুতরাং ওই গ্রামে পাক সেনাদের প্রবেশেরও প্রয়োজন নেই।
এভাবে তিনি হানাদার পাক বাহিনীর জ্বালাও পোড়াও হত্যাযঙ্গ থেকে নিজ গ্রামকে রক্ষা করেছিলেন, অন্য গ্রামে যুদ্ধরত গেরিলাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল করেছিলেন। দিনের বেলা তার ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকার এবং খাবারের ব্যবস্থা করে রাতের আধারে সীমান্ত পারি দিয়ে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছিলেন।
কিন্তু যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ বিজয়ী হলে তার ঘরে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা খোঁজ নিতে এলে জানতে পারেন তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে। থানার লিস্টে তার নাম রাজাকারের খাতায়! এখনো।
যতটা মনে পড়ে কোন এক টেলিভিশন টকশোতে এই গল্পটা বলেছিলেন ৯ নং সেক্টরের সাব কমান্ডার জিয়া উদ্দিন। আর তারা যে রাজাকারের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার বাড়ি ছিল যশোর ঝিনাইদহ এলাকায়।
এখন প্রশ্ন, শান্তি কমিটির ওই লোকটি কি মুক্তিযোদ্ধা না রাজাকার?
প্রায় ২০০ বছর বৃটিশদের গোলামী খেটে, নানা চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা, হত্যা, লুটপাটের মধ্যে দিয়ে একটা পর্যায়ে বাধ্য হয়ে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানদের হাত ধরে অনেক স্বপ্ন নিয়ে যে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলেন সেই পাকিস্তানের শাসকরাও শোষণ বঞ্চনা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে লাগলো।
২শ বছর পড়ে অনেক কাঙ্খিত যে রাষ্ট্র মুসলমানরা পেল সেই দেশ তৈরি হওয়া নিয়েও নানান ধরনের ষড়যন্ত্র ছিল। (পড়ুন ঃ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী)
কিন্তু সদ্য রাষ্ট্র হওয়া একটি দেশ তার শাসকদের কারনে সেটা আবার ভেঙে যাবে তা মানতে পারেননি তারা, যারা ৪৭ এর দেশ ভাগ হওয়ার ভয়ংকর প্রেক্ষাপট দেখেছেন। তাদের অনেকে মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। যুদ্ধের সময় সন্তানকে গেরিলা বাহিনীর সদস্য হওয়ার উৎসাহ দিয়ে বাবা মুসলীম লীগের নেতা বা শান্তিকমিটির সদস্য হয়েও নিস্ক্রিয় ছিলেন। বাবার কারনে পাক হানারা তাদের বাড়ি, গ্রামের উপর নজর দেয়নি। হত্যাযঙ্গ করেনি।
প্রশ্ন এই মানুষগুলো রাজাকার নাকি মুক্তিযোদ্ধা?
আমাদের বর্তমান জীবিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের (জাসদ,বাসদ, আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ) অনেক হেভিওয়েট নেতাদের বাবা এমনকি পরিবারের অনেক লোকের খোঁজ নিয়ে জানাযায় তারা মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্তও। তাদের অনেকেই ছিল পিস কমিটির সদস্য!
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী মাঝে মাঝেই ক্ষোভের সাথে একটা কথা বলেন আমাদের বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি কম ছিল। কেননা তাদের অনেকেই ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ অর্থাৎ স্বাধীনতার মাত্র ২ দিন অাগ পর্যন্তও তারা পাকিস্তান সরকারের চাকুরী করেছেন, বেতন নিয়েছেন, রেশন খেয়েছেন। যে খানে তাদেরই অনেকে চাকরি ছেড়ে রণাঙ্গনে ছুটেগেছেন।
যুদ্ধ একটা কৌশল, সবাই রণাঙ্গনে যুদ্ধ করলেই মাত্র ৯ মাসে দেশ স্বাধীন হতো না।
সবাই যে নিজ ইচ্ছায় রাজাকারের খাতায় নাম লিখেছেন এমন না, সবাই যে শান্তি কমিটিতে নাম দিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, করেছেন এমনও না।
আবার সবার নাম যে তার জ্ঞাতসরেই পিচকমিটিতে উঠেছে এমনও না। (সেটা রাজাকারের লিস্ট প্রকাশ হওয়ার পড়ে সবাই বুঝেছে অনেকটা )।
গতকাল এক সিনিয়র সাংবাদিক বলতে ছিলেন যে সব এলাকায় হিন্দু নেতারা প্রভাবশালী ছিল তাদের অনেকর নাম পিচ কমিতে থানা থেকে তৎকালীন পাকিস্তানের ওসি ডিসিরা দিয়ে দিয়েছেন। অটো।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই একটা ম্যাসাকার হয় সারা দেশে। চিহ্নিত রাজাকার, আল বদরদের মধ্যে গুরুতর অভিযোগ পাওয়া প্রায় সকলকেই মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলেন।
এরকম ভাবে যুদ্ধের সময় অনেক মসজিদ মাদ্রাসা খানকার পীর বা মোতাওয়াল্লীদের নাম পিচ কমিতে ছিল। এদের মধ্যে বড় একটা অংশই ছিল নিরীহ। যার জন্য যুদ্ধের আগেও যেমন তারা নিজ এলাকায় সম্মানিত শ্রদ্ধেও ছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তারা সবার শ্রদ্ধ্যেও ছিলেন।
যুদ্ধ শেষে যারা বেঁচেছিল, যাদের নামে কেউ অভিযোগ করেন, বা কোন অভিযোগ ছাড়াও অনেকেই গ্রেফতার হয় তখন। তাদের নামে মামলা হয়, তারা গ্রেফতার হয়। এদের সংখ্যা ছিল ৩৭ হাজারের মত। বঙ্গবন্ধু সরকার দালাল আইনে এদের বিচার করেন। বিচারে ২৫ হাজারেরও বেশি যাদের কোন অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়।
দালাল আইনে এমন লোকদের বিচার করেন বঙ্গবন্ধু সরকার।
বিচারে ১১ হাজারের মত দোষী সাব্যস্ত হন। তাদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়।
যাদের নামে অভিযোগ পাওয়া যায় নি, কোন শাক্ষি, শাক্ষ, প্রমাণ পাওয়া যায় নি তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়।
এখন এই যে ৩৬ হাজারের নামে মামলা হল তারা সবাই কি রাজাকার ছিল? অপরাধী ছিল?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ওই লিস্ট অনুযায়ী এতদিন অামরা রাজাকারের সংখ্যা জানতাম।
সেই জানাটা যে সঠিক ছিল না তা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ না হলে হয়তো জানাই হতো না। যে ওই লিস্টের সবাই রাজাকার না, মামলা থাকলেই সে অপরাধী না, থানার টেবিলে বসে নাম টুকে দিলেই সে অপরাধী হয় না। সেটা কি ১৯৭১, কি ২০১৯!
প্রকাশ হওয়া রাজাকারের লিস্টে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার সংগঠকের নাম।
অথচ আমরা চোখ বুঝে সবার নামে বলে দিলাম "কুখ্যাত" রাজাকার!
এখানে এমনলোকেরও নাম আছে যাকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করছেন, যিনি গেরিলা বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
৭১ টিভির টকশোতে এংকর কয়েকটি লিস্ট দেখালেন যাদেরকে তখন গ্রেফতার করেছিল কিন্তু তাদের মামলাগুলো ৭৩ সালে ঢিসমিস হয়েছে তাদের কোন অপরাধ প্রমাণ হয়নি।
তাদেরকে কি আমরা অপরাধী বলতে পারি?
রাষ্ট্রের বর্তমান আইন অনুযায়ীও তারা অপরাধী না।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল একটি অনুষ্ঠানে বললেন, বাড়ির অনেক মুরুব্বির নাম শান্তি কমিটিতে দিয়ে পিছনে মুক্তিযোদ্ধারা কাজ করেছেন। এটাই বাস্তবতা ছিল তখন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ১৩ ই ডিসেম্বর বললেন, যারা রাজাকার, আল বদর, আল শামস হিসেবে বেতনভুক্ত ছিল, অপরাধী ছিল কেবল তাদের নামই প্রকাশ করা হবে। প্রথম ধাপে ১১ হাজারের মত প্রকাশ করা হবে বাকি ২০ হাজারের লিস্টও প্রকাশ পাবে শীঘ্রই।
কিন্তু লিস্ট প্রকাশ হওয়ার পড়ে যখন হইচই পড়ে গেল মন্ত্রী বললেন তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থাকা ডকুমেন্টস দাড়ি,কমা, সেমিকোলন সহকারে হুবুহু প্রকাশ করেছেন , তারা নতুন করে কোন সংযোজন বা বিয়োজন করেননি।
এই লিস্টে গ্রফতার হয়ে জেল খেটে নির্দোষ প্রমাণ হওয়াদের নামও ইন্ডিকেট করে দেয়া আছে তাদেরকেও যেমন স্বাধীনতার ৪৮ বছর পড়ে আমরা অপরাধী বলতে পারিনা।
একি ভাবে যে সব গুনী মানুষজনের নাম প্রকাশ হওয়ার পড়ে যে অসস্তি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে দিয়ে এসব পরিবার গুলো যাচ্ছে তা কি একটা দুঃখ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে শেষ হবে?? লিস্ট পাবলিক করে তা উড্রো করে নিলেই কি শেষ হয়ে যায়?? রাজাকারের তালিকাclick here
ব্লগার ও গণমাধ্যম কর্মী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন