নূর মোহাম্মাদ আবু তাহের
এবার আমার চতূর্থ পয়েন্ট।
মি. প্রেসিডেন্ট, এটাই এখন সবচেয়ে বড়ো সঙ্কট। বিশেষ করে এটার জন্যই আমি এখানে এসেছি। কাশ্মীরে যা ঘটছে, এখন আমি তা আপনাদের সামনে বলব। এই ব্যাপারে কথা বলার আগে আপনাদের সামনে একটা বিষয় পরিস্কার করতে চাই।
ক্ষমতায় আসার পর আমাদের অগ্রাধিকার ছিল—পাকিস্তান হবে এমন এক দেশ, যে দেশ শান্তির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে। ২০০১ সালের পর আমেরিকার সাথে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে (War on Terror) যোগ দেওয়ার মাধ্যমে পাকিস্তান তার ইতিহাসের অন্যতম খারাপ সময় অতিক্রম করেছে। আমাদের ৭০,০০০ লোক মার্কিন-আফগান যুদ্ধে মারা গেছে, অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ১৫০ বিলিয়ন ডলার।
আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তান পশ্চিমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করেছে। ‘গেরিলা যোদ্ধা’ নামে খ্যাত মুজাহিদ বাহিনীকে পশ্চিমারা (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র) অর্থায়ন করেছিল আর তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে সম্বোধন করত, আর আমরা বলতাম ‘মুক্তিযোদ্ধা’। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে পালাতে বাধ্য হয়। তারপরে আমেরিকা আফগানিস্তান ত্যাগ করে, আর পাকিস্তানও মুজাহিদ গ্রুপকে ত্যাগ করে।
অতঃপর ৯/১১ আসলো। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে (War on Terror) পাকিস্তান যক্তরাষ্ট্রের সাথে সংযুক্ত হলো। কিন্তু এখন আমাদের সরকার আর এই যুদ্ধের সাথে থাকতে চায় না। কেন? কারণ, একসময় পশ্চিমাদের সাথে মিলে আমরা আফগান মুজাহিদদের বিদেশী দখলদারদের বিরুদ্ধে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম। আমরা তার নাম দিয়েছিলাম—‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’। এখন আমেরিকা আফগানিস্তান দখল করে আমাদের কাছে প্রত্যাশা করছে, আমরা মুজাহিদদের বলব—‘তোমরা এখন স্বাধীনতা সংগ্রাম করছ না, তোমরা যা করছ—তা সন্ত্রাসী কার্যক্রম।’
ঠিক এ কারণে আমি পাকিস্তাব সরকারকে বললাম—আমাদের নিরেপেক্ষ থাকা উচিত। আমি সরকারকে বুঝাতে সক্ষম হলাম, যদি আমরা আমেরিকার সাথে যুদ্ধ অব্যাহত রাখি, তাহলে তালেবানরা আমাদের শত্রু বিবেচনা করতেই থাকবে। তারা আমাদের আক্রমণ করবে। আমরা যুদ্ধ থেকে সরে আসলাম। ঠিক এই কারণে আমরা আমেরিকার চোখে ‘ষড়যন্ত্রকারী’ বনে গেলাম; রাতারাতি আমরা তাদের দুঃস্বপ্নে পরিণত হলাম এবং তারা আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেল।
কল্পনা করুন, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে ৭০,০০০ পাকিস্তানী নিহত হলো। অথচ ৯/১১ এর সাথে কোনো পাকিস্তানী জড়িত ছিল না। তালেবান, আল কায়েদা আফগানিস্তানে তৈরি হয়েছে; পাকিস্তানে নয়। কিন্তু ৭০,০০০ পাকিস্তানী নিহত হয়েছে! সূতরাং, আমরা ক্ষমতায় এসে সিদ্ধান্ত নিলাম—পাকিস্তানে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠি থাকলে তাদের নির্মূল করব। এই সিদ্ধান্ত কেবল আমাদের সরকারই নেয়নি, সকল রাজনৈতিক দল এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা তা বাস্তবায়ন করেনি। আমরা সরকারে এসে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছিলাম।
আমি জানি ভারত বলে আসছে, আমাদের জঙ্গি সংগঠন আছে। আমি জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের পাকিস্তানে এসে ভারতীয় দাবির সত্যতা জানার আমন্ত্রণ জানাই। দেখুন, আসলে আমরা কী করেছি। পাকিস্তানে কোনো জঙ্গি গ্রুপ থাকবে না, এটা আমাদের সিদ্ধান্ত।
এই ব্যাকগ্রাউন্ড বর্ণনা করার দরকার ছিল। এরপরে আমরা বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কন্নোয়নে নজর দেই। আমরা আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্টকে পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। ইরানের সাথে কিছু সমস্যা ছিল; সেটা মিটিয়ে নিয়েছি। এরপর ভারত প্রসঙ্গে বলি। ভারতের সাথে আমার সম্পর্কের কথা বলার আগে পেছনের কিছু কথা বলতে হয়। উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট, তাদের অনেকেরই ক্রিকেট নিয়ে দারুণ আগ্রহ! ক্রিকেটের সুবাদে ভারতে আমার অনেক ভক্ত-শুভাকাঙ্ক্ষী আছে। ভারতে আমার অনেক প্রিয় বন্ধু আছে এবং ভারত ভ্রমণ করতে সবসময়ই পছন্দ করি।
সুতরাং দল ক্ষমতায় আসার পর আমার প্রথম উদ্যোগ ছিল ভারতের কাছাকাছি যাওয়া। নরেন্দ্র মোদীকে বললাম, আমাদের উভয় দেশের সমস্যাগুলো প্রায় একই; দারিদ্র, জলবায়ুর পরিবর্তনের সমস্যা। আসুন আমরা এসব সমস্যা সমাধানে একসাথে কাজ করি। বিশ্বস্ততার ভিত্তিতে আমরা সম্পর্কন্নোয়নে কাজ করি। কিন্তু উনি প্রত্তুত্তরে বললেন—পাকিস্থান সবসময় আমাদের উপর সন্ত্রাসী হামলা চালায়। আমি বলি, আমরাও একই সমস্যা মোকাবিলা করছি। ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে। আমরা সেখানে ভারতীয় গুপ্তচর কলভূষণ যাদভকে গ্রেফতার করেছিলাম। তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর হয়ে কাজ করছিল বলে স্বীকার করেছে। আসুন আমরা সেসব বিরোধপূর্ণ বিষয় ভুলে যাই, সামনের দিকে তাকাই, এগিয়ে যাই শান্তির জন্যে। আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত জনগণ ও জনগণের স্বার্থ। ভারতীয় উপমহাদেশে অসংখ্য দরিদ্র মানুষের বসবাস। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মোদী রেসপন্স করল না। জাতিসংঘের গত সম্মেলনে আমাদের পররাষ্টমন্ত্রীদের একটা বৈঠক হওয়ার কথা ছিল; ভারত সেটা বাতিল করে দিয়েছিল।
আমরা ভাবলাম, সামনে ভারতে ভোট আসছে। আল্ট্রা-জাতীয়তাবাদী দল হিসবে বিজেপি গেম খেলতে চায়, পাকিস্তানের বিরোধিতা করে ভোটের মাঠে সুবিধা আদায় করতে চায়। আমাদের আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। ঠিক এই সময়ে ভারত শাসিত কাশ্মীরে ২০ বছর বয়ষ্ক এক ছেলে আত্মঘাতি বোমা হামলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্যকে হত্যা করল। যদিও এই আত্মঘাতী হামলাকারীর বাবা সাংবাদিকদের জানিয়েছিল—ভারতীয় সিকিউরিটি ফোর্সেস দীর্ঘদিন ধরে ছেলেটিকে আত্মঘাতী হিসেবে তৈরি করেছে। ভারত তাৎক্ষণিকভাবে এই হামলার সব দোষ চাপাল পাকিস্থানের উপর। আমি টেলিভিশনে বললাম, ভারত একটা প্রমান দেখাক যে এই হামলায় পাকিস্থান এতটুকুও জড়িত। যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে আমরা তাৎক্ষণিক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করব। পুলওয়ামা হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার প্রমাণ পাঠানোর পরিবর্তে তারা জঙ্গী বিমান পাঠাল। আমাদের সীমানায় তারা বোমা হামলা করল। আমরাও জবাব দিলাম। আমরা তাদের দুটো যুদ্ধ বিমানও ভূপাতিত করলাম। তাদের একজন পাইলটকে জীবিত ধরে ফেললাম। কোনো কালক্ষেপণ না করে তাঁকে দ্রুত ভারতে ফেরত পাঠিয়ে দিলাম। বললাম, দেখুন আমরা উত্তেজনা বাড়াতে চাই না। আমাদের পুরো শান্তি উদ্যোগ ভেস্তে দিল ভারত। পুরো নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে মোদি দাবি করল—‘তিনি পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি ৩৫০ জন পাকিস্তানী সন্ত্রাসীকে বিমান হামলা করে হত্যা করেছেন।’ মোদির এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। মূলত, মোদি বিমান হামলা করে পাকিস্তানের ১০টি গাছ হত্যা করেছে; যদিও আমাদের কাছে এই ১০টি গাছের প্রাণহানীও খুবই বেদনাদায়ক। কারণ, অনেক মায়া করে গাছগুলো আমরা বড়ো করেছিলাম। (পুরো অডিয়েন্স তখন হাসছিল এবং হাততালি দিচ্ছিল।)
মোদি নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে বলতে থাকল—মুভির ট্রেইলার চলছে, ফাইনাল মুভি পরে দেখাব। আমি আমার দেশের রাজনীতিবিদদের বললাম, দেখুন, ভারতে নির্বাচন চলছে, মোদির এটা নির্বাচনী কৌশল। রাজনীতিবিদরা নির্বাচনে জিততে এমন অনেক কথায় বলে। নির্বাচনের পরে আমরা ভারতের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরে যাব।
ভালো কথা। ভারতে নির্বাচন শেষ হলো। আমরা ভারতকে কূটনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নের প্রস্তাব দিলাম। তারা কোনো জবাব দিলেন না। কিছুদিন পর আমরা অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, আন্তর্জাতিক পরিসরে তারা আমাদের ব্ল্যাকলিস্ট-এ ফেলার উদ্যোগ নিচ্ছে, আমাদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার আয়োজন করছে। আমরা ঠিক তখন উপলব্ধি করলাম, ভারত একটা সুনির্দিষ্ট এজেন্ডার দিকে এগোচ্ছে। আর এই এজেন্ডা পরিস্কার হয়ে ধরা পড়ে ভারত কর্তৃক কাশ্মীরের বিশেষ অধিকাসংক্রান্ত ৩৭০ আর্টিকেল বাতিল করার মধ্য দিয়ে।
এই আর্টিকেল বাতিল জাতিসংঘের ১১তম রেজ্যুলেশন-এর স্পষ্ট বিরোধিতা; যেখানে বলা ছিল—কাশ্মীর একটি সংঘাতপূর্ণ এলাকা এবং কাশ্মীরের জনগণের নিজেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। ভারত এই রেজ্যুলেশনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। শুধু তাই নয়; ভারত তাদের নিজেদের সংবিধানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ভারতীয় সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, কাশ্মীর ‘বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন’ এলাকা। কাশ্মীরে নতুন করে ১ লাখ ৮০ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, যা নিয়ে সেখানে মোট নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা ৯ লাখ! এর মাধ্যমে ৮ মিলিয়ন জনতাকে কারফিউ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
মি. প্রেসিডেন্ট, একজন লোক কী করে এমনটা করতে পারে! আপনারা কি বুঝতে পারছেন? এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে হলে আপনাকে আরএসএস সম্পর্কে জানতে হবে। এখন আমি আরএসএস সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে চাই। মি. নরেন্দ্র মোদি আরএসএস-এর আজীবন সদস্য। আরএসএস এমন একটি সংগঠন, যা এডলফ হিটলার ও মুসোলিনীর হিংস্র আদর্শে অনুপ্রাণিত। তারা জাতিগত পবিত্রতা ও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব বিশ্বাস করে। তারা মনে করে, আর্য জাতি থেকে তাদের উৎপত্তি, যেমনটি নাজিরা বিশ্বাস করত। আমি যা বলছি, তা যাচাই করে নিতে পারেন। এখন তো উন্মুক্ত তথ্য-দুনিয়া। আমি যা বলছি, তা গুগল করে যাচাই করে নিতে পারেন। ভারতে এখন আদতে কী হচ্ছে, তা আপনাদের সামনে ব্যাখ্যা করা এখন জরুরি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারত থেকে মুসলমানদের জাতিগত নিধনে বিশ্বাস করে আরএসএস। প্রথমত, আরএসএস হিন্দুত্ববাদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী। দ্বিতীয়ত, তারা মুসলিম ও খৃস্টানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায়। কারণ, তাদের ধারণা—মুসলিম শাসনের ফলেই শত বছর পুর্বে হিন্দু সভ্যতার সোনালী যুগের অবসান ঘটেছে। আর ব্রিটিশ শাসনের কারণে তারা বঞ্চিত বলে আক্ষেপ করে। সুতরাং তারা জেনেবুঝেই হিন্দুত্ববাদী জাতি শেষ্ঠত্বের চর্চা করতে গিয়ে মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার চাষাবাদ করে। এটা তারা স্পষ্টতই বলে থাকে। গুগল করে আপনি দেখুন! আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা গোলকওয়ার ও সাভারকারের অবস্থান একটু জানুন। এই ঘৃণার আদর্শে উজ্জীবিত হয়েই ১৯৪৮ সালে হত্যা করা হয়েছে ভারতের অবিসংবাদিত নেতা মহাত্মা গান্ধীকে। এটা ঘৃণার সেই আদর্শ, যা দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে নরেন্দ্র মোদী গুজরাটে ২০০০ মুসলমানকে জবাই করার বন্দোবস্ত করেছিলেন। তখন তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদির নির্দেশে গেরুয়া পাঞ্জাবী পরে টানা ৩ দিন ধরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল আরএসএস এর সন্ত্রাসীরা। তারা এখনো গেরুয়া পোষাক পরে। ভারতে সাবেক কংগ্রেস নেতা ও মন্ত্রী দাবি করেছেন, আরএসএস তার কর্মীদের সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ দেয় প্রকাশ্যেই। তাদের তান্ডবে গুজরাটে ২০০০ মুসলিম নিহত হয় এবং গৃহহীন হয় ১৫০,০০০ মুসলিম। মোদী তখন আমেরিকা ভ্রমণ করতে পারেননি এই অপরাধে!
কাশ্মীরি ৮ মিলিয়ন মানুষকে কারফিউ দিয়ে কী অবস্থায় রাখা হয়েছে, তা আলোচনা করার আগে আমি আপনাদের কাছে আরএসএস-এর এই মনস্তত্ত্বিক চরিত্র তুলে ধরতে চাই। বুঝতে হবে কেমন তাদের মানসিকতা! সেখানে নারী, শিশু, অসুস্থ মানুষদের পশুর মতো বন্দী করে রাখা হয়েছে। আমি যতদূর জানি, ইংল্যান্ডে ৮ মিলিয়ন পাশুকে খাঁচায় এভাবে বন্দি রাখলেও চারদিকে নাগরিকরা হইচই ফেলে দিত। অথচ, কাশ্মীরে আদম সন্তানরা বন্দি! পশ্চিমা বিশ্ব কী ভাবছে? (দর্শকদের তুমুল করতালি)।
মি. প্রেসিডেন্ট, এই জাতিগত দাম্ভিকতার আল্টিমেট রেজাল্ট আসলে কী এসেছে? এর ফল দুটো; অজ্ঞতা ও ভুল। যখন মানুষ এই জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের অজ্ঞতার ডুবে যায়, তখন সে এ রকম নিষ্ঠুর ও কদর্য ভুল করে বসে; যা নরেন্দ্র মোদি করেছে। এটা নিছক অজ্ঞতা। এই অজ্ঞতা নরেদ্র মোদিকে অন্ধ বানিয়ে ছেড়েছে। মোদি আর কখনোই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে না।
যখন কারফিউ উঠে যাবে, তখন কী ঘটবে সেখানে—তারা কি একবারও ভেবে দেখেছে? কারফিউ প্রত্যাহার হলে কি কাশ্মীরি জনগণ ভারতের এই আগ্রাসন মেনে নিবে? তাদের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে; এটা কি তারা কি মেনে নিবে?
মি প্রেসিডেন্ট, গত ৩০ বছরে কাশ্মীরে ১ লাখ নাগরিক নিহত হয়েছে, ১১ হাজার নারী ধর্ষিতা হয়েছে। কারণ, ভারত তাদের বিশেষ অধিকার ভোগ করতে দিবে না। এটা জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট। কিন্তু বিশ্ববাসী আদতে কিছুই করছে না। তারা দেখছে ভারত তাদের জন্য ১.২ বিলিয়ন জনসংখ্যার বিশাল বাজার। দুঃখজনকভাবে বস্তুগত স্বার্থের কাছে মানবতা হেরে যাচ্ছে! এর পরিণতি হবে ভয়াবহ! স্রেফ এটা বলতেই আমি এখানে এসে দাঁড়িয়েছি।
দেখুন, কাশ্মীরে এখন যা হচ্ছে, তার পরিণতি আসলে কী? কারফিউ প্রত্যাহারের সাথে সাথে কাশ্মীরের রক্তগঙ্গা বইয়ে যাবে। তখন জনগণ ঘর থেকে রাস্তায় বের হয়ে আসবে, ৯ লাখ সেনার মুখোমুখি হবে। বুঝতে পারছেন? নরেন্দ্র মোদি বলছে, কাশ্মীরি জনগণের উন্নয়নের স্বার্থে কারফিউ জারি করা হয়েছে। কী দারুণ! তাহলে ৯ লাখ সেনা সেখানে কী উন্নয়ন করছে? জনগণ যখন রাস্তায় বেড়িয়ে আসবে, তখন আদতে কী হবে? রক্তগঙ্গা ছাড়া আর কিছু? মোদি কি কখনো ভেবেছেন, তখন কী হবে? মি. প্রেসিডেন্ট রক্তগঙ্গা শুরু হওয়ার পরের পরিস্থিতি নিয়ে কেউ ভাবছে না।
আপনারা কখনো ভেবেছেন, এই পরিস্থিতিতে কাশ্মীরি জনগণের কীভাবে চিন্তা করা উচিত? তাদেরকে ঘরে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট উপায়ে বন্দি করে রাখা হয়েছে, অধিকার বলতে কিছু নাই। হাজারো রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এমন কি যেসব নেতারা ভারতের পক্ষে ছিল, তাদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৩০০ যুবককে অজ্ঞাত স্থানে গুম করে ফেলা হয়েছে; আল্লাহ জানেন, তারা এখন কোথায়? এই অবস্থায় কী ভাববে তারা? কী ভাবা উচিত? কারফিউ উঠে গেলে তাদের কী করা উচিত? তারা রাস্তায় নামবে, প্রতিবাদ করবে আর ৯ লাখ সেনা তখন তাদের গুলি করে মারবে? ঠিক? তারা বিগত ৬ বছর ধরে কাশ্মীরিদের উপর প্যালেট গান ব্যবহার করে হাজারো তরুণকে অন্ধ করে দিয়েছে। এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে তারা সেখানে।
মি. প্রেসিডেন্ট, কাশ্মীরিরা আবার চরমপন্থার দিকে ঝুঁকবে। আমি আশঙ্কা করছি আরেকটা পালওয়ামার এবং স্বভাবসুলভাবে ভারত আমাদের দায়ি করবে। অবশ্য ইতোমধ্যে তারা আমাদের দায়ি করা শুরু করেছে। তারা বলছে, যা কিছু ঘটছে, তার সবটুকুর পেছনে পাকিস্তান। ভারতের ডিফেন্স মিনিস্টার বলেছেন, সীমান্তে ৫০০ পাকিস্তানী সন্ত্রাসী কাশ্মীরে যাওয়ার অপেক্ষা করছে। দেখুন, ৯০০,০০০ সৈন্যের মোকাবিলায় পাকিস্তান ৫০০ সন্ত্রাসী পাঠিয়ে আদৌ কী করবে! পরিস্থিতি বদলাতে এই ৫০০ জন আদতে কোনো প্রভাব তৈরি করতে পারবে? তারা সেখানে কী করবে? আমরা যখন জানি, কোনো সন্ত্রাসী হামলা হলেই ৯ লাখ সৈন্য কাশ্মীরিদের হত্যা করার উৎসব শুরু করবে, তখন আমরা কেন সন্ত্রাসীদের পাঠাব? আমরা ৯ লাখ সেনার বন্দুকের মুখে নিরীহ কাশ্মীরিদের কেন তুলে দেবো? আমরা কেন ভারতকে ‘ইসলামি টেরোরিজম’ কার্ড খেলতে দেবো?
যখনই কেউ ‘ইসলামি টেরোরিজম’ কার্ডে খেলে দেয়, তখন গোটা বিশ্ব মুখে কুলুপ আঁটে। তখন আর মানধিকারের গল্প সামনে আসে না; আপনি ইচ্ছামতো সব করতে পারেন। কাশ্মীরে এখন ঠিক এই খেলাটাই ভারত খেলছে এবং সামনে খেলতে চায়। তারা সচেতনভাবে একটা টার্ম ব্যবহার করছে ‘ইসলামি টেরোরিজম’। অবশ্য ভারতের এই কার্ড খেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই; কারণ, অন্য কোনো বয়ান তাদের সামনে অবশিষ্ট নাই আর। আমরা কেন তাদের এটা খেলতে দেবো?
কারফিউ যখন প্রত্যাহার হবে, তখন যা কিছু হবে, তার জন্য পাকিস্তানকে দায়ি করা হবে। কিন্তু আরেকটা পালওয়ামা ঘটার আশঙ্কা থেকেই যাবে। কাশ্মীরিরা বোমা হাতে সামনে আসতেই পারে এবং তখন নতুন এক পর্ব শুরু হবে।
আসলে নরেন্দ্র মোদি এখন কী ভাবছে? ভারতের ১৮০ মিলিয়ন মুসলমানরা এখন কী ভাবছে? তারা কি কাশ্মীরিদের অমানবিক আটকবস্থা দেখছে না? ভারতের মুসলমানরা কি তখন চরমপন্থার দিকে ঝুঁকবে না? আমি আপনাদের ১৮০ মিলিয়ন মুসলমানদের কথা ভাবতে বলছি। সমগ্র ভারত তো ঝুঁকির মুখে পড়বে। ঠিক তখন আমাদের দায়ি করা হবে। আমি আপনাদের সতর্ক করছি আজ, তখন আমাদের দায়ি করা হবে।
মি. প্রেসিডেন্ট, আমি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ১.৩ বিলিয়ন মুসলমানদের কথা বলছি। তারা এসব জুলুম দেখছে না? তারা দেখছে, কাশ্মীরিদের ওপর অত্যাচারের একমাত্র কারণ—তারা মুসলিম। কাশ্মীরি হিন্দুদের সাথে অত্যাচার হচ্ছে না। মুসলমানরা দেখছে, শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কাশ্মীরিরা জুলুমের শিকার হচ্ছে। বলুন তো, দুনিয়াব্যাপী মুসলমানরা তখন কী চিন্তা করবে? শুধু ধর্মীয় কারনে ইহুদিদের সাথে এমন হলে, তারা কী চিন্তা করত? ৮ মিলিয়ন বাদ দিন ৮ হাজার লোককে এভাবে আটকে রাখলে তারা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাত? ইউরোপিয়ানরা এমন পরিস্থিতিতে কী চিন্তা করত? আমি মনে করি, যেকোনো মানবিক সমাজের সদস্যদের কেউ এভাবে খাঁচায় বন্দি থাকলে সবাই-ই শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাত। আমরা কী একই স্রষ্টার সন্তান নই? আমাদের কি অন্তরে কাশ্মীরিদের জন্য ব্যাথা অনুভূত হয় না?
এখন আমি বলব, এসবের প্রতিক্রিয়া কী হবে? ১.৩ বিলিয়ন মুসলমানদের মধ্য থেকে কেউ অস্ত্র হাতে তুলে নিবে। আমি ফিল্ম দেখে দেখে বড়ো হয়েছি। পশ্চিমা অনেক মুভি দেখেছি। মুভিতে দেখেছি—সুন্দর চেহারার ভদ্র ও সাদাসিধে যুবক ন্যায়বিচার না পেয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিল এবং নিজেই ন্যায়বিচার আদায় করতে শুরু করল। নিউইয়র্কের বিখ্যাত এক মুভির নাম Death Wish। এই মুভিতে তিনি নিষ্ঠুর মজার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রীকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল এবং অন্যায়ের কোনো প্রতিকার পাননি। একসময় তিনি নিজে হাতে অস্ত্র তুলে নেন এবং একটার পর একটা খুনিদের হত্যা করছিলেন। তখন মুভির দর্শকবৃন্দ নায়কের পক্ষে জয়োল্লাসে চিৎকার করছিল।
এখন মুসলমানদের অবস্থা বিবেচনা করে আপনারা কী ভাবছেন? কাশ্মীরে যদি কোনো রক্তগঙ্গা শুরু হয়, তাহলে মুসলমানরা চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়বে। ইসলামের কারণে তারা চরমপন্থার দিকে যাবে না; বরং তারা যাপিত জীবনে যে অবিচার ও জুলুম দেখছে, তার কারণে চরমপন্থী হবে। তারা দেখছে, মুসলমানদের জন্য কোনো ন্যায়বিচার নাই। তারা রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখেছে। আল্লাহ জানেন, তাদের এখন কী ভয়াবহ অবস্থা। লাখো লাখো রোহিঙ্গা বনি আদমকে জাতিগত নিধনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে, দেশছাড়া করা হয়েছে। বিশ্ববাসী তাদের জন্য সত্যিকারার্থে কী করেছে? এখন বলুন, ১.৩ বিলিয়ন মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত?
আমি কল্পনায় নিজেকে কাশ্মীরে নিয়ে গিয়ে দেখি। আমি ৫৫ দিন ধরে বন্দি। আমার মা-বোনের ওপর ভারতীয় সেনারা ধর্ষণের উৎসব করছে। আমি কি এই অপমান মেনে নিতাম? আমি কি বাঁচতে চাইতাম? এভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করত? আমি ইমরান অস্ত্র হাতে তুলে নিতাম। আপনারা মানুষকে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। মানুষের যখন বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা মরে যায়, তখন আর সে মানুষ থাকে না; অন্য কিছু হয়ে যায়। আপনারা যদি মানুষের সাথে অন্যায় করতে থাকেন, তাহলে মূলত তাদের চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
মি. প্রেসিডেন্ট, আমি পুনরায় বলছি, আমরা এক ক্রান্তিলগ্নের মুখোমুখি। কাশ্মীরি জনগণ প্রতিক্রিয়া দেখাবে, পাকিস্তান অভিযুক্ত হবে। পরমানু শক্তিধর দুটো দেশে মুখোমুখি লড়াইয়ে নামবে; যেমনটা আমরা গত ফেব্রুয়ারিতে মুখোমুখি হয়েছিলাম। এই অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার আগেই জাতিসংঘকে দায়িত্বশীল ভূমিকায় আসতে হবে। ঠিক এই দায়িত্ব নিতেই জাতিসংঘ ১৯৪৫ সালে গঠিত হয়েছিল। জাতিসংঘকে এই আশু সঙ্কট মোকাবিলা করা উচিত। ১৯৩৯ সালে এভাবেই মিউনিখ দখল করে নিয়েছিল চেকোশ্লাভাকিয়া। তাহলে পরেরটা কী কাশ্মীর?
আপনাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আপনারা কি ১.২ বিলিয়ন ভারতীয় মার্কেটের দিকে তাকাচ্ছেন, নাকি ন্যায়বিচার ও মানবতার পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন। এখানে ভুল খেললে আপনারা ভালো কিছুর আশা করুন, তবে মারাত্মক কিছু্র অপেক্ষা করুন (Hope for the best, but be prepared for the worst.)। যদি স্বভাবসুলভ যুদ্ধ দুটো দেশের মধ্য শুরু হয়ে যায়, সেখানে অনেককিছুই ঘটতে পারে।
ধরে নিন, এমন দুটো দেশের মধ্য যুদ্ধ হচ্ছে, যার একটার চেয়ে অন্যটা ৭ গুণ ছোটো। আপনার সামনে দুটো অপশন; হয় আত্মসমর্পণ করুন, নয়তো মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই করুন। দুটোর একটা অপশন বেছে নিতে বলা হলো। কোনটা বেছে নেওয়া উচিত? আমি নিজেকে নিজেই এই প্রশ্ন করেছি। আমার বিশ্বাসী চেতনায় আছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ- আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নাই’। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি—মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই করব।
তবে মনে রাখবেন, যখন দুটো পরমানু শক্তিধর রাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধে নামবে, তখন সে যুদ্ধের ভয়াবহতা বিবাদমান রাষ্ট্র দুটোর সীমানা পেড়িয়ে অনেক দূরে গিয়ে পৌঁছবে। এটাই যুদ্ধের আল্টিমেট পরিণতি! যে কারণে আজ আমি এখানে এসে অনুরোধ করছি, কথা বলছি। আমি কেবল আপনাদের আশু বিপদের ব্যাপারে সতর্ক করছি, এটা কোনো থ্রেট নয়। এটা উদ্বেগজনক চিন্তার ব্যাপার, যা সামনে ঘটতে যাচ্ছে।
আমি এখানে আজ জাতিসংঘের সবাইকে বলতে এসেছি, আপনাদের অবশ্যই একটা ভূমিকা নিত্ট হবে। এটা জাতিসংঘের জন্য একটা বড়ো পরীক্ষা। জাতিসংঘই একমাত্র আশার জায়গা, যে কাশ্মীরি জনগণকে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে পারে। কাশ্মীরিরা খুব বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। এটাই উপযুক্ত সময় সমাধানের; তবে তা যেন ১৯৩৯ সালের মতো সমাধান না হয়। এখনই সময় কার্যকর এ্যাকশন নেওয়ার। আর প্রথম এ্যাকশন হচ্ছে, ৫৫ দিনব্যাপী চলা অমানবিক ভারতীয় কারফিউ প্রত্যাহার করতে হবে। অবশ্যই রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে, বিশেষ করে ১৩০০ গুম হয়ে যাওয়া যুবককে ফিরিয়ে দিতে হবে; জানি না এখন তারা কোথায়। এরপর বিশ্বসভ্যতাকে অবশ্যই কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
ধন্যবাদ আপনাদের।
.................................................................................
জাতিসংঘে ইমরান খানের ঐতিহাসিক ভাষণ (পর্বঃ ০২)
..................................................................................
তৃতীয়ত আমি যেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই, তা হলো ইসলামোফোবিয়া (Islamophobia)। বর্তমানে বিশ্বে মুসলমানের সংখ্যা ১৩০ কোটিরও বেশি। আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও লক্ষ কোটি মুসলমান সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস করছে। ৯/১১-এর পর ইসলামোফোবিয়া ভয়াবহ গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের মধ্যে নানা সম্প্রদায় থাকলেও তারা একই সাথে বসবাস করবে, এটাই প্রত্যাশা। তাদের মধ্যে পারষ্পরিক সমঝোতা ও বোঝাপড়াও থাকবে; কিন্তু ইসলামোফোবিয়া মানুষের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করে দিচ্ছে।
ভাবতে পারেন—মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধান এখন অনেক দেশেই একটি বড়ো ইস্যুতে পরিণত হয়েছে! হিজাব এখন একটা ইস্যু! হিজাবকে এমনভাবে দেখা হচ্ছে, যেন এটা মারাত্মক কোনো মারনাস্ত্র। একজন নারী স্বল্প কাপড় পরিধান করতে পারবেন, কিন্তু চাইলেই তিনি পুরো শরীর ঢাকতে পারবেন না। ভাবতে পারেন? কেন হিজাব পড়া নিয়ে এত সমস্যা হচ্ছে? শুধুমাত্র ইসলামোফোবিয়ার কারণে। আদতে কখন এই ইসলামোফোবিয়া শুরু হলো? ৯/১১-এর পর থেকেই। কীভাবে শুরু হলো? বেশ কয়েকজন পশ্চিমা নেতা ইসলামকে সন্ত্রাসের সাথে মিলিয়ে ফেলেছিলেন। তারা ইসলামিক টেরোরিজম নামে নতুন একটি বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন। আরেকটি নামও তখন থেকেই শোনা গিয়েছিল; র্যাডিক্যাল ইসলাম বা ইসলামি মৌলবাদ। র্যাডিক্যাল ইসলাম কী?
এরকম কোনো শব্দ ইসলামে নেই। ইসলাম একটাই, যা আমাদের সামনে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আদর্শ হিসেবে রেখে গেছেন। এর বাইরে আলাদা কোনো ইসলাম নেই। র্যাডিক্যাল ইসলাম, ইসলামিক টেরোরিজম প্রভৃতি শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে তারা বিশ্বকে কী বার্তা দিতে চেয়েছেন? ইসলামোফোবিয়ার প্রসার এভাবেই ঘটেছে। নিউইয়র্ক, আমেরিকার অন্য কোনো শহরে কিংবা ইউরোপের কোনো দেশে থাকা একজন ব্যক্তি কীভাবে র্যাডিক্যাল মুসলিম আর একজন মডারেট মুসলিমের (উদারমনা মুসলমান) মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করবে? আসলে কোনো ধর্মেই সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই। পশ্চিমা নেতাদের কেউ কেউ যত্রতত্র এই ইসলামিক রেডিক্যালিজম বা ইসলামিক টেরোরিজম শব্দগুলো ব্যবহার করার কারণেই ইসলামোফোবিয়ার উত্থান ঘটেছে।
ইসলামোফোবিয়ার কারণে বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা কষ্ট পাচ্ছে। যখনই কোনো মুসলিম অন্য কোনো দেশে বেড়াতে যায়, সে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়। অন্যদিকে, ইউরোপীয়ান দেশগুলোতে এই ইসলামোফোবিয়ার কারণেই মুসলমানদেরকে কোনঠাসা করে ফেলা হচ্ছে। আর আমরা সবাই জানি যে, কোনো গোষ্ঠীকে কোনঠাসা করে ফেলা হলে তাদের মধ্য থেকে চরমপন্থার সূচনা হয়। সিরিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় আমরা অনেক সময় যে উগ্রবাদি মুসলমানদের দেখতে পাই। তারাও দীর্ঘদিন কোনঠাসায় থাকার কারণেই এই পর্যায়ে এসেছে। আমি চাই, আমরা সবাই যেন এই বিষয়টা নিয়ে আরেকটু তৎপর হই।
অত্যন্ত দু:খের সাথে আমি বলতে চাই—মুসলিম দেশগুলোর নেতারাও এই বিষয়ে বলিষ্ঠ ভুমিকা পালন করতে পারেননি। ৯/১১-এর পর যখন র্যাডিক্যাল ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সূচনা করা হয়, তখন মুসলিম নেতাদের দায়িত্ব ছিল সবাইকে (বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোকে) বোঝানো—র্যাডিক্যাল ইসলাম বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ইসলামে নেই। প্রতিটি মানব সম্প্রদায়েই কিছু মানুষ থাকে, যারা কট্টরপন্থী। আবার কিছু মানুষ থাকে, যারা উদারমন্ আবার কেউ-বা মধ্যমপন্থী। খৃষ্টান বা ইহুদী সমাজে এবং অন্য যেকোনো সম্প্রদায়েই এরকম বিভিন্ন মানসিকতার লোকদেরকে পাওয়া যায়। কিন্তু ইসলাম কখনোই র্যাডিক্যাল নয়। জুডাইজম, খৃষ্টধর্ম, হিন্দুধর্ম কেউই র্যাডিক্যাল নয়। কেউই চরমপন্থা অবলম্বনের শিক্ষাও দেয় না। সকল ধর্মেরই মুল কথা হলো সহানুভূতি ও ন্যায়বিচার। আর এই বৈশিষ্টের কারণেই আমরা অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, পশ্চিমা সেই প্রচারণার মুখে মুসলিম নেতৃবৃন্দ র্যাডিক্যাল মুসলমান হিসেবে চিত্রায়িত হওয়ার ভয়ে এতটাই তটস্থ হয়ে পড়েন যে, তারা পাল্লা দিয়ে মডারেট হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে যান।
পাকিস্তানও একই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গেছে। পাকিস্তান তখন এই ঝড়ের মুল কেন্দ্রস্থলেই অবস্থান করছিল। আর আমাদের তৎকালীন সরকারগুলো নতুন একটি শব্দেরই প্রচলন করে ফেলে; যা হলো, ‘Enlightened moderation’। কেউই তখন বোঝেনি যে, এই শব্দের অর্থটাই-বা কী! কিন্তু দেখা যেতো, অনেকেই নিজেকে মডারেট প্রমান করার জন্য হঠাৎ করে কোর্ট বা স্যুট পরিধান শুরু করেছিল কিংবা সবাই কমবেশি ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করে দিয়েছিল। মডারেট কাকে বলে, এটা নিয়ে কারও মাঝে তেমন কোনো ধারনাই ছিল না। কার্ আমরা মুসলমানেরা পশ্চিমাদেরকে বোঝানোর চেষ্টাই করিনি যে, র্যাডিক্যাল ইসলাম বলতে কোনো ধারণারই অস্তিত্ব নেই।
৯/১১-এর পর ইসলামকে সন্ত্রাসের সাথে মিলিয়ে ফেলার একটা বড়ো কারণ ছিল আত্মঘাতি বোমা হামলা। কারণ, নাইন-এলিভেনের আক্রমনকারীরা আত্মঘাতি হামলাই চালিয়েছিল। আর তারপর থেকেই নানা ধরনের তত্ব আমাদের সামনে আসতে শুরু করে। বলা হয়েছিল, মুসলমানরা আত্মঘাতি বোমা হামলায় জড়িত হয়। এভাবে জীবন দিলে তাদেরকে জান্নাত পাওয়ার সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনেক নারী বোমা হামলাকারীও ছিল। তাদের ব্যাপারে আবার অন্য কথা। এভাবে সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। আত্মঘাতি হামলাকে ইসলামের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়। অথচ কেউ গবেষণা করেনি যে, ৯/১১-পূর্বে বিশ্বে যত আত্মঘাতি বোমা হামলা হয়েছে, তার সিংহভাগের সাথে জড়িত ছিল তামিল টাইগাররা; যারা ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে হিন্দু। তখন কেউ সেই আত্মঘাতি হামলার জন্য হিন্দুত্ববাদকে দায়ি করেনি। হ্যাঁ, হিন্দুত্ববাদকে দায়ি না-করাটাই সঠিক। শ্রীলংকায় সংঘটিত এসব বেপরোয়া আত্মঘাতি হামলার সাথে হিন্দুত্ববাদের কিই-বা সম্পর্ক আছে?
আমরা সবাই জাপানের কেমিকেজ পাইলটদের কথা জানি; যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আত্মঘাতি হামলা চালিয়েছিল। কেউ তখন তাদের ধর্মকে দোষ দেয়নি। অথচ আমরা এখানে পশ্চিমাদের সামনে ইসলামের প্রকৃত স্বরূপকে তুলে না ধরে বরং মডারেট হওয়ার চেষ্টা করছি। ইসলামোফোবিয়া সম্পর্কে আলোচনার এই পর্যায়ে আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথা বলতে চাই। আমি এখন যা বলব, গুরুত্ব বুঝি। কারণ, আমি পেশাদার খেলোয়াড় জীবনের একটি বড়ো অংশ পশ্চিমা দেশগুলোতে কাটিয়েছি। তাই আমি খুব ভালো করেই জানি—পশ্চিমারা কীভাবে চিন্তা করে, কীভাবে চিন্তা করতে শিখে। কীভাবে তারা ধর্মকে মুল্যায়ন করে? কিংবা ইসলাম সম্পর্কে এই ভ্রান্ত ধারণাগুলোর সূত্রপাত কীভাবে হয়?
১৯৮৯ সালে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে আমাদের প্রিয় নবিজি (সা.)- কে ব্যাঙ্গ করে, হেয় করে তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে অসংখ্য তথ্য সন্নিবেশিত হয়। মুসলিম দেশগুলোতে এই বইটির বিরুদ্ধে ব্যপক প্রতিবাদ হয়েছিল। কিন্তু তখনও পশ্চিমারা প্রকৃত সংকটকে অনুধাবন করতে পারেনি। কারণ, পশ্চিমা দেশগুলোতে ধর্মকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভংগিতে দেখা হয়। ধর্মের আবেদন পশ্চিমা আর আমাদের কাছে অনেকটা ভিন্ন। তারা ধর্মকে আমাদের মতো করে ভাবে না। এই কারণেই পশ্চিমারা ইসলামকে অসহনশীল ধর্ম হিসেবে গণ্য করে, যেখানে ব্যক্তির বাক স্বাধীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। আজ থেকে ৩০ বছর আগের বাস্তবতা এমনই ছিল। প্রতি দুই বা তিন বছর পর পর কেউ ইসলামকে নিয়ে, নবীজিকে (সা.) নিয়ে কোনো বাজে মন্তব্য করত; তার প্রতিবাদে মুসলিম দেশগুলোতে প্রতিবাদ হতো, বিক্ষোভ হতো। তারপর আবার ইসলামকে একটি অসহনশীল ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
বর্তমানেও একই ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। আমি এই জন্য পশ্চিমা নেতৃবৃন্দের ক্ষুদ্র একটি অংশকে দায়ি করব। কারণ, তারা জেনে বুঝে ও স্বজ্ঞানে ইসলামকে এরকম নেতিবাচক উপায়ে চিত্রায়িত করছেন। আর স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমা দেশগুলোর জনগণের অধিকাংশই বিষয়টির গভীরতা বুঝতে পারছে না।
অন্যদিকে, মুসলিম নেতৃবৃন্দও নানাভাবে মুসলমানদেরকে হেয় করেছেন। আমাদের উচিত ছিল তাদেরকে বোঝানো যে, রাসুল (সা.) আমাদের কাছে কতটা গুরুত্বের, কতটা সম্মানের। এখন আমি রাসুলের (সা.) গুরুত্ব সম্পর্কে একটু বোঝানোর চেষ্টা করব।
রাসুল (সা.) এর উপর পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে। আল কুরআন নাজিল হয়েছে আমাদেরকে সত্য পথের দিশা দেয়ার জন্য। আর রাসুল (সা.) হলেন সেই কুরআনের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। কুরআনে যা আছে, তা-ই তিনি নিজের জীবনে অনুসরণ করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। তাই তিনিই হলেন সেই আদর্শবান ব্যক্তিত্ব, যার মতো আমরা সকলেই হতে চাই, হওয়ার স্বপ্ন দেখি। রাসুল (সা.) মদিনায় ইসলামের প্রথম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মদিনার সেই রাষ্ট্রব্যবস্থাই ছিল মুসলিম সভ্যতার ভিত্তিমূল; যার উপর দাঁড়িয়ে পরবর্তী ৭০০ বছর মুসলমানরা গোটা পৃথিবীকে শাসন করেছে।
মদিনা রাষ্ট্রের চেতনা কী ছিল? এখন আমি ইসলাম সমন্ধে অদ্ভুত সব কথা শুনি। অনেক সময় শুনি—ইসলাম নারীদের অধিকারের বিরুদ্ধে, ইসলাম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে। অথচ মদিনায় যে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা ছিল বিশ্বের প্রথম কল্যান রাষ্ট্র। কল্যান রাষ্ট্রের ধারনাটাই এসেছে মদিনার সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে। মদিনা রাষ্ট্র নিজেই বিধবা, এতিম, দরিদ্র, প্রতিবন্ধীদের দায়িত্ব গ্রহন করেছিল। মদিনায় বড়োলোকদের নিকট থেকে কর আদায় করে গরিব নাগরিকদের কল্যাণে ব্যবহার করা হতো।
মদিনা রাষ্ট্রেই সর্বপ্রথম ঘোষনা করে—সকল মানুষই আদমের সন্তান, আর তাই তারা সবাই সমান। গায়ের রং দিয়ে কাউকে বিচার করা হবে না। এর আগে কয়েকশ বছর আরবে ও পশ্চিমা জগতে ক্রীতদাস প্রথার প্রচলন ছিল। সমাজের সার্বিক ব্যবস্থা এই ক্রীতদাস প্রথার উপর জারি ছিল। তাই একে একবারেই বিলুপ্ত করা হয়নি। কিন্তু নবিজি (সা.) বলে গিয়েছিলেন—সবচেয়ে উত্তম কাজ হলো একজন ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দেওয়া। তিনি ক্রীতদাসকে বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের মতো করেই বিবেচনা করতে বলেছিলেন। তার এইসব ঘোষণার কারণে মুসলিম সভ্যতায় এমন কিছু বিপ্লব ঘটে যায়, যা অন্য কোনো সভ্যতায় দেখা যায়নি। এমনকি মামলুকদের মতো ক্রীতদাস বংশেরও মিসরের শাসক হয়ে যাওয়ার ইতিহাস রচিত হয়। ভারতবর্ষেও ক্রীতদাস বংশের শাসনের ইতিহাস রয়েছে।
এরপর আসা যাক, সংখ্যালঘু প্রসঙ্গে। অনেকেই শুনেছেন যে, ইসলাম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অথচ প্রকৃত সত্য মোটেও তেমনটা নয়। আমাদের রাসুল (সা.) বলেছেন—প্রত্যেকের নিজ নিজ ধর্ম অনুশীলন করার স্বাধীনতা রয়েছে। অন্য ধর্মের উপাসনালয়কে সংরক্ষন করা আমাদের সবার নৈতিক ও পবিত্র দায়িত্ব। রাসুল (সা.) আরো বলেছেন—ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে আইনের চোখে সবাই সমান বলে গন্য হবে। এই প্রসঙ্গে আমি একটি ঘটনা বলতে চাই। আমি প্রায়শই বিভিন্ন ফোরামে এই ঘটনাটিকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করি, যেখানে ইসলামের চতুর্থ খলিফা একজন কাজির আদালতে একজন ইহুদী নাগরিকের কাছে মামলায় হেরে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়—মদিনা রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই সত্যটি প্রমান করা হয় যে, কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়। প্রমান করা হয় যে, ইহুদি ব্যক্তিও নাগরিক হিসেবে সমান সুবিধা পাবে। তাই যদি কোনো মুসলিম সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অন্যায় করে, তাহলে তা ইসলামের মূল চেতনা ও নবিজির (সা.) আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক হয়।
এই বিষয়গুলো বোঝা খুবই জরুরি। আমাদের রাসুল (সা.) আমাদের হৃদয়ের গভীরে সম্মানের আসনে বসে আছেন। আমরা সবাই জানি—কারো মনে আঘাত লাগলে, তা শারীরিক আঘাতের চেয়েও অনেক বেশি কঠিন হয়, অনেক বেশি ব্যাথার উদ্রেক করে। তাই আমাদের হৃদয়ের গভীরে থাকা রাসুলকে (সা.) নিয়ে যখন কেউ পরিহাস করে, অপমান করে, ব্যাঙ্গ করে, তখন আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরন হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানরা প্রতিক্রিয়া দেখায়। আমি প্রায়শই ভাবতাম, যদি কখনো এই ধরনের বড়ো ফোরামে আসার সুযোগ পাই, তাহলে আমি বিষয়গুলোকে নিয়ে কথা বলব। কারণ, পশ্চিমে বসবাস করে কখনোই এই প্রকৃত সত্যগুলোকে উপলব্ধি করা যায় না। আমি যখন আমার টিনেজ বয়সে প্রথম ইংল্যান্ডে যাই, তখন সেখানে যিশুখৃষ্টকে নিয়ে একটি কমেডি সিনেমা চলছিল। মুসলিম সমাজে এই ধরনের কোনো চিত্র কল্পনাই করা যায় না।
আমাদেরকে অনুধাবন করতে হবে, মানব সমাজে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ থাকে এবং আমাদের কখনোই এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে অন্য কারও কষ্ট হয়, কেউ আঘাত পায়। পশ্চিমা সমাজে খুব ন্যায্যভাবেই হোলোকাস্টকে তীব্র আবেগ ও অনুভূতির সাথে বিবেচনা করা হয়। কারণ, হোলোকাস্টের এই ঘটনার স্মৃতি রোমন্থনে ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকেরা কষ্ট পায়। আমরা ঠিক এই কথাটিই বলতে চাই। দয়া করে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে আমাদের পবিত্র ধর্মকে নিয়ে, আমাদের রাসুলকে নিয়ে বাজে কোনো মন্তব্য করবেন না। এতে আমাদের কষ্ট হয়। আমরা মানসিকভাবে ব্যাথা পাই। আমাদের হৃদয়ে যন্ত্রনার বন্যা বয়ে যায়।
অনুবাদক পরিচিতি
আলী আহমাদ মাবরুর
.................................................................................
জাতিসংঘে ইমরান খানের ঐতিহাসিক ভাষণ (পর্বঃ ০১)
.,,,,,,,,,,,,...........................................................................................................
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
ইয়া কানা’ বুদু ওয়া ইয়াকা নাসতাইন। আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি, তোমারই কাছে সাহায্য চাই।
জনাব সভাপতি, মাননীয় মহাসচিব এবং সম্মানীত অতিথিবৃন্দ,
বিশ্ব নেতৃবৃন্দের এই প্লাটফর্ম-এ আমি আমার দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়ে সম্মানিতবোধ করছি। এখানে আমরা বিশ্বের বিদ্যমান বেশ কিছু সমস্যা ও সংকট নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পাব। আমি অনেকগুলো সংকট নিয়ে কথা বলতে পারতাম; তবে আজকের জন্য আমি প্রধানত ৪টি মৌলিক বিষয় বাছাই করেছি। ঠিক এই মুহুর্তে, আমার দেশ একটা কঠিন সময় পার করছে। তা স্বত্বেও আমি এই ফোরামে এসেছি বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার জন্যেই। আমি হয়তো নাও আসতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, এই সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। এই ইস্যুগুলোতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট নিয়ে আমি শুরু করতে চাই। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এরই মধ্যে ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু মাননীয় সভাপতি, আমি এই ইস্যুতে আন্তরিকতার ভীষন অভাব দেখতে পাই। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মধ্যে যাদের এই ব্যাপারে অনেক কিছুই করার ছিল, তারা হয়তো এই সমস্যার ভয়াবহতাই ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারেননি। আমাদের অনেকেরই অনেক সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা আছে। তবে কথায় আছে, টাকা ছাড়া পরিকল্পনা মোহভ্রান্তি (Hallucinations) ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমি আমার দাবির স্বপক্ষে আমার নিজের দেশ পাকিস্তানের কথা বলতে পারি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে একটি হলো পাকিস্তান। আমরা ভীষণভাবে আমাদের নদীগুলোর উপর নির্ভরশীল। আমরা মূলত একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এই সব নদীর পানির ৮০ শতাংশই আসে হিমবাহ থেকে। এই হিমবাহগুলোর কিছু অংশ যেমন পাকিস্তানে আছে, আবার কিছু অংশ ভারতের সীমানায়ও পড়েছে। ভারতেও গঙ্গাসহ অসংখ্য নদীর পানির উৎসও এই হিমবাহগুলো। হিমালয়, কারাকোরাম বা হিন্দুকুশে থাকা হিমবাহ থেকে এই পানি আসে। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, এই হিমবাহগুলো ভয়াবহ আকারে গলে যেতে শুরু করেছে। আমরা এই পর্যন্ত ৫ হাজারটি হিমবাহকে সনাক্ত করেছি, যেগুলো ইতোমধ্যেই তুমুল বেগে গলে যাচ্ছে। যদি এভাবেই চলতে থাকে, যদি আমরা এই হিমবাহগুলোকে রক্ষা করতে না পারি, তাহলে মানবজাতি একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যাবে।
আমার দল যখন প্রথমবারের মতো খাইবার পাখতুনখাওয়া (কেপি) প্রদেশে ক্ষমতাসীন হয়, আমরা সেখানে ৫ বছরে কয়েক লাখ গাছের চারা রোপন করেছিলাম। এবার ক্ষমতায় এসে আমরা গোটা পাকিস্তানে ১০ বিলিয়ন গাছের চারা রোপন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এই পরিকল্পনা গ্রহণ করার মূল কারণ—জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকারক প্রভাবকে মোকাবেলা করা। তবে বাস্তবতা হলো, একটি দেশ এককভাবে তেমন কিছুই করতে পারে না। এক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। বাস্তবতার প্রদীপ থেকেই আশার আলো দেখতে পাই; কারণ, সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে অনেক বেশি সক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। বেঁচে থাকার সহজাত প্রবৃত্তি থেকে আমরা যেকোনো কিছুই করতে পারি। সেই জায়গা থেকে আমি আশা করি, জাতিসংঘ এই ইস্যুতে কার্যকর কিছু উদ্যেগ গ্রহন করবে। এই ইস্যুতে আরও গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। ধনী দেশগুলোকে আরও বেশি চাপ দিতে হবে। মূলত, যে দেশগুলো গ্রীন হাউস গ্যাস নি:সরণের জন্য দায়ি, তাদেরকে আরও বেশি চাপ দিতে হবে। আমাদের মতো দেশগুলো খুব যৎসামান্য গ্রীন হাউস গ্যাসই নি:সরণ করে থাকে। তাই জাতিসংঘের এই বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা দরকার।
দ্বিতীয় যে ইস্যুটি নিয়ে আমি কথা বলতে চাই, তা আরও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর ছোটো ছোটো দরিদ্র দেশগুলো থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বেরিয়ে যায় আর ধনী দেশগুলোতে গিয়ে সেই অর্থ জমা হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর দূর্নীতিবাজ রাজনীবিদরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার করে দিচ্ছে। তারা পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের ব্যাংকের অফশোর একাউন্ট-এ টাকা পাচার করছে। ধনী দেশগুলোতে দামি দামি সম্পত্তি কিনছে, নানা ধরনের কোম্পানি গঠন করে তার আড়ালে বিপুল অংকের টাকা পাচার করে দিচ্ছে। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো রীতিমতো ধ্বংসের মুখে পড়ে গেছে। ফলত ঋণ বাড়ছে, দারিদ্রতার বিকাশ ঘটছে এবং সার্বিকভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলো একটি বিপর্যস্ত পরিস্থিতি পার করছে। এই কারণে ধনী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যকার ব্যবধান আরও বেড়ে যাচ্ছে। মানি লন্ডারিং-এর কারণে দরিদ্র দেশগুলো থেকে টাকা-পয়সা ধনী দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে। অনেক নেতিবাচক কারণেও টাকা পাচার হয়। মাদক ব্যবসা বা সন্ত্রাসের আর্থিক যোগান দেওয়ার কাজেও টাকা পাচার হয়। তবে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টা ঠিক এরকম নয়। মূলত, মানি লন্ডারিং-এর মাধ্যমে অভিজাত শ্রেণির লোকেরা দরিদ্র দেশগুলোকে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।
এক বছর আগে আমি যখন আমার দেশে সরকারের দায়িত্ব নেই, তার আগের ১০ বছরে গোটা দেশের ঋণ তার ৪ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। তার মানে হলো, পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর থেকে যত টাকার ঋণগ্রস্ত ছিল, ওই ১০ বছরে তার থেকে ৪ গুণ বেশি ঋণ নেওয়া হয়। এর নির্মম পরিণতি এখন আমরা ভোগ করছি। আমরা সারা বছর যত টাকা রাজস্ব অর্জন করি, তার অর্ধেক বিগত সময়ের নেওয়া ঋণের দায় পরিশোধ করতেই খরচ হয়ে যায়। তাহলে আমরা দেশের ২২ কোটি জনগণের উন্নয়নের পেছনে কোথা থেকে টাকা খরচ করব? ক্ষমতাসীন মহল দেশটিকে অবাধে লুট করেছে বলেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা খুব সহজে, কোনো ধরণের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সেই টাকা বিদেশে পাচার করে দিয়েছে।
আরেকটি বাস্তবতা হলো, দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিং-এর নামে যে টাকাগুলো ধনী দেশগুলোতে পাচার করা হয়েছে, মূল্যবান সব সম্পত্তি কেনা হয়েছে, আমরা যখন সেগুলোকে সনাক্ত করে সেই অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলাম, তখন বুঝতে পারলাম—বিষয়টা মোটেও সহজ কাজ নয়। পাচারকৃত টাকাগুলো ফিরিয়ে আনতে পারলে আমরা মানব সম্পদ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারতাম।
পাচারকৃত এই টাকা ফিরিয়ে নিয়ে আসা খুব বেশি কঠিন। এমনভাবে আইন প্রণয়ন করে রাখা হয়েছে, যা দিয়ে অপরাধীরা খুব সহজেই পার পেয়ে যায়। ভালো আইনজীবী নিয়োগ করে মামলা লড়া কিংবা বা অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে টাকা উদ্ধার করে নিয়ে আসার মতো পর্যাপ্ত টাকা আমাদের হাতে নেই। এক্ষেত্রে আমাদের উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন। ধনী দেশগুলোর অবশ্যই এই ব্যাপারে কার্যকর রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা থাকতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সহযোগিতা করতে অতটা আগ্রহী নন। তাহলে কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হবে? তাহলে জাতিসংঘ এসডিজিসহ আরও নানা প্রকল্পের নামে মানুষের উন্নয়নে যে কাজগুলো করতে বলছে, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো তা কীভাবে বাস্তবায়ন করবে? আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, বড়ো বড়ো দেশগুলো অর্থনৈতিক উদ্বাস্তুর আগমন ঠেকাতে বিশাল বিশাল দেয়াল নির্মানের কথা ভাবছে। যতক্ষন না তা হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে টাকা পাচার বন্ধ করার জন্য তাদের কিছু বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। দুর্নীতিবাজ শাসকরা যাতে কোনোভাবেই ধনী দেশগুলোর ব্যাংক একাউন্ট-এ টাকা পাচার করতে না পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
আমি আরেকটা বিষয়ও বুঝি না—ধনী দেশগুলোতে কেন এই ট্যাক্স মওকূফের সুযোগটা রাখা হয়েছে? কেন সেখানে এভাবে টাকা পাচার করার সুযোগ উম্মুক্ত রাখা হয়েছে? কেন ধনী মানুষগুলো কর পরিশোধ করবেন না। তাদেরকে এই মওকুফ সুবিধা দেয়ার কারণটা কী? কেন এই সুযোগটি দেওয়া হচ্ছে—এই হলো ট্যাক্স হ্যাভেন, বা এই হলো গোপন ব্যাংক একাউন্ট, যেখানে আপনি সব অবৈধ টাকা জমা রাখতে পারবেন! কেন আপনারা বুঝতে পারছেন না—বিশ্ব প্রতি মূহুর্তেই পাল্টে যাচ্ছে, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটছে।
যদি ধনী শুধু ধনীই হয় আর গরিব শুধু গরিবই হয়, তাহলে আজ হোক বা কাল হোক আমাদের সবাইকেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হবে। এই ছিল আমার দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয়। আমি আশা করি, জাতিসংঘ এই বিষয়েও কার্যকর উদ্যোগ নেবে। অবশ্যই এখানে জাতিসংঘের ভূমিকা প্রয়োজন। কারণ, এই প্রক্রিয়ার সাথে আইএমএফ, ওয়াল্ড ব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ নানা আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও জড়িত। এই সকল প্রতিষ্ঠানকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর লুটতরাজ বন্ধে কিছু কার্যকর উপায় বের করতেই হবে।
অনুবাদক পরিচিতি
আলী আহমাদ মাবরুর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন