আলী আহমাদ মাবরুর
ইয়া কানা’ বুদু ওয়া ইয়াকা নাসতাইন। আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি, তোমারই কাছে সাহায্য চাই।
জনাব সভাপতি, মাননীয় মহাসচিব এবং সম্মানীত অতিথিবৃন্দ,
বিশ্ব নেতৃবৃন্দের এই প্লাটফর্ম-এ আমি আমার দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়ে সম্মানিতবোধ করছি। এখানে আমরা বিশ্বের বিদ্যমান বেশ কিছু সমস্যা ও সংকট নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পাব। আমি অনেকগুলো সংকট নিয়ে কথা বলতে পারতাম; তবে আজকের জন্য আমি প্রধানত ৪টি মৌলিক বিষয় বাছাই করেছি। ঠিক এই মুহুর্তে, আমার দেশ একটা কঠিন সময় পার করছে। তা স্বত্বেও আমি এই ফোরামে এসেছি বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার জন্যেই। আমি হয়তো নাও আসতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, এই সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। এই ইস্যুগুলোতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট নিয়ে আমি শুরু করতে চাই। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এরই মধ্যে ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু মাননীয় সভাপতি, আমি এই ইস্যুতে আন্তরিকতার ভীষন অভাব দেখতে পাই। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মধ্যে যাদের এই ব্যাপারে অনেক কিছুই করার ছিল, তারা হয়তো এই সমস্যার ভয়াবহতাই ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারেননি। আমাদের অনেকেরই অনেক সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা আছে। তবে কথায় আছে, টাকা ছাড়া পরিকল্পনা মোহভ্রান্তি (Hallucinations) ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমি আমার দাবির স্বপক্ষে আমার নিজের দেশ পাকিস্তানের কথা বলতে পারি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে একটি হলো পাকিস্তান। আমরা ভীষণভাবে আমাদের নদীগুলোর উপর নির্ভরশীল। আমরা মূলত একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এই সব নদীর পানির ৮০ শতাংশই আসে হিমবাহ থেকে। এই হিমবাহগুলোর কিছু অংশ যেমন পাকিস্তানে আছে, আবার কিছু অংশ ভারতের সীমানায়ও পড়েছে। ভারতেও গঙ্গাসহ অসংখ্য নদীর পানির উৎসও এই হিমবাহগুলো। হিমালয়, কারাকোরাম বা হিন্দুকুশে থাকা হিমবাহ থেকে এই পানি আসে। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, এই হিমবাহগুলো ভয়াবহ আকারে গলে যেতে শুরু করেছে। আমরা এই পর্যন্ত ৫ হাজারটি হিমবাহকে সনাক্ত করেছি, যেগুলো ইতোমধ্যেই তুমুল বেগে গলে যাচ্ছে। যদি এভাবেই চলতে থাকে, যদি আমরা এই হিমবাহগুলোকে রক্ষা করতে না পারি, তাহলে মানবজাতি একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যাবে।
আমার দল যখন প্রথমবারের মতো খাইবার পাখতুনখাওয়া (কেপি) প্রদেশে ক্ষমতাসীন হয়, আমরা সেখানে ৫ বছরে কয়েক লাখ গাছের চারা রোপন করেছিলাম। এবার ক্ষমতায় এসে আমরা গোটা পাকিস্তানে ১০ বিলিয়ন গাছের চারা রোপন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এই পরিকল্পনা গ্রহণ করার মূল কারণ—জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকারক প্রভাবকে মোকাবেলা করা। তবে বাস্তবতা হলো, একটি দেশ এককভাবে তেমন কিছুই করতে পারে না। এক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। বাস্তবতার প্রদীপ থেকেই আশার আলো দেখতে পাই; কারণ, সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে অনেক বেশি সক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। বেঁচে থাকার সহজাত প্রবৃত্তি থেকে আমরা যেকোনো কিছুই করতে পারি। সেই জায়গা থেকে আমি আশা করি, জাতিসংঘ এই ইস্যুতে কার্যকর কিছু উদ্যেগ গ্রহন করবে। এই ইস্যুতে আরও গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। ধনী দেশগুলোকে আরও বেশি চাপ দিতে হবে। মূলত, যে দেশগুলো গ্রীন হাউস গ্যাস নি:সরণের জন্য দায়ি, তাদেরকে আরও বেশি চাপ দিতে হবে। আমাদের মতো দেশগুলো খুব যৎসামান্য গ্রীন হাউস গ্যাসই নি:সরণ করে থাকে। তাই জাতিসংঘের এই বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা দরকার।
দ্বিতীয় যে ইস্যুটি নিয়ে আমি কথা বলতে চাই, তা আরও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর ছোটো ছোটো দরিদ্র দেশগুলো থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বেরিয়ে যায় আর ধনী দেশগুলোতে গিয়ে সেই অর্থ জমা হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর দূর্নীতিবাজ রাজনীবিদরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার করে দিচ্ছে। তারা পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের ব্যাংকের অফশোর একাউন্ট-এ টাকা পাচার করছে। ধনী দেশগুলোতে দামি দামি সম্পত্তি কিনছে, নানা ধরনের কোম্পানি গঠন করে তার আড়ালে বিপুল অংকের টাকা পাচার করে দিচ্ছে। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো রীতিমতো ধ্বংসের মুখে পড়ে গেছে। ফলত ঋণ বাড়ছে, দারিদ্রতার বিকাশ ঘটছে এবং সার্বিকভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলো একটি বিপর্যস্ত পরিস্থিতি পার করছে। এই কারণে ধনী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যকার ব্যবধান আরও বেড়ে যাচ্ছে। মানি লন্ডারিং-এর কারণে দরিদ্র দেশগুলো থেকে টাকা-পয়সা ধনী দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে। অনেক নেতিবাচক কারণেও টাকা পাচার হয়। মাদক ব্যবসা বা সন্ত্রাসের আর্থিক যোগান দেওয়ার কাজেও টাকা পাচার হয়। তবে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টা ঠিক এরকম নয়। মূলত, মানি লন্ডারিং-এর মাধ্যমে অভিজাত শ্রেণির লোকেরা দরিদ্র দেশগুলোকে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।
এক বছর আগে আমি যখন আমার দেশে সরকারের দায়িত্ব নেই, তার আগের ১০ বছরে গোটা দেশের ঋণ তার ৪ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। তার মানে হলো, পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর থেকে যত টাকার ঋণগ্রস্ত ছিল, ওই ১০ বছরে তার থেকে ৪ গুণ বেশি ঋণ নেওয়া হয়। এর নির্মম পরিণতি এখন আমরা ভোগ করছি। আমরা সারা বছর যত টাকা রাজস্ব অর্জন করি, তার অর্ধেক বিগত সময়ের নেওয়া ঋণের দায় পরিশোধ করতেই খরচ হয়ে যায়। তাহলে আমরা দেশের ২২ কোটি জনগণের উন্নয়নের পেছনে কোথা থেকে টাকা খরচ করব? ক্ষমতাসীন মহল দেশটিকে অবাধে লুট করেছে বলেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা খুব সহজে, কোনো ধরণের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সেই টাকা বিদেশে পাচার করে দিয়েছে।
আরেকটি বাস্তবতা হলো, দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিং-এর নামে যে টাকাগুলো ধনী দেশগুলোতে পাচার করা হয়েছে, মূল্যবান সব সম্পত্তি কেনা হয়েছে, আমরা যখন সেগুলোকে সনাক্ত করে সেই অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলাম, তখন বুঝতে পারলাম—বিষয়টা মোটেও সহজ কাজ নয়। পাচারকৃত টাকাগুলো ফিরিয়ে আনতে পারলে আমরা মানব সম্পদ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারতাম।
পাচারকৃত এই টাকা ফিরিয়ে নিয়ে আসা খুব বেশি কঠিন। এমনভাবে গাইন প্রণয়ন করে রাখা হয়েছে, যা দিয়ে অপরাধীরা খুব সহজেই পার পেয়ে যায়। ভালো আইনজীবী নিয়োগ করে মামলা লড়া কিংবা বা অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে টাকা উদ্ধার করে নিয়ে আসার মতো পর্যাপ্ত টাকা আমাদের হাতে নেই। এক্ষেত্রে আমাদের উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন। ধনী দেশগুলোর অবশ্যই এই ব্যাপারে কার্যকর রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা থাকতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সহযোগিতা করতে অতটা আগ্রহী নন। তাহলে কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হবে? তাহলে জাতিসংঘ এসডিজিসহ আরও নানা প্রকল্পের নামে মানুষের উন্নয়নে যে কাজগুলো করতে বলছে, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো তা কীভাবে বাস্তবায়ন করবে? আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, বড়ো বড়ো দেশগুলো অর্থনৈতিক উদ্বাস্তুর আগমন ঠেকাতে বিশাল বিশাল দেয়াল নির্মানের কথা ভাবছে। যতক্ষন না তা হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে টাকা পাচার বন্ধ করার জন্য তাদের কিছু বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। দুর্নীতিবাজ শাসকরা যাতে কোনোভাবেই ধনী দেশগুলোর ব্যাংক একাউন্ট-এ টাকা পাচার করতে না পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
আমি আরেকটা বিষয়ও বুঝি না—ধনী দেশগুলোতে কেন এই ট্যাক্স মওকূফের সুযোগটা রাখা হয়েছে? কেন সেখানে এভাবে টাকা পাচার করার সুযোগ উম্মুক্ত রাখা হয়েছে? কেন ধনী মানুষগুলো কর পরিশোধ করবেন না। তাদেরকে এই মওকুফ সুবিধা দেয়ার কারণটা কী? কেন এই সুযোগটি দেওয়া হচ্ছে—এই হলো ট্যাক্স হ্যাভেন, বা এই হলো গোপন ব্যাংক একাউন্ট, যেখানে আপনি সব অবৈধ টাকা জমা রাখতে পারবেন! কেন আপনারা বুঝতে পারছেন না—বিশ্ব প্রতি মূহুর্তেই পাল্টে যাচ্ছে, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটছে।
যদি ধনী শুধু ধনীই হয় আর গরিব শুধু গরিবই হয়, তাহলে আজ হোক বা কাল হোক আমাদের সবাইকেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হবে। এই ছিল আমার দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয়। আমি আশা করি, জাতিসংঘ এই বিষয়েও কার্যকর উদ্যোগ নেবে। অবশ্যই এখানে জাতিসংঘের ভূমিকা প্রয়োজন। কারণ, এই প্রক্রিয়ার সাথে আইএমএফ, ওয়াল্ড ব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ নানা আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও জড়িত। এই সকল প্রতিষ্ঠানকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর লুটতরাজ বন্ধে কিছু কার্যকর উপায় বের করতেই হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন