ফরহাদ মজহার
সাধারনত যারা শাহবাগে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের অধিকাংশের মধ্যে কখনও স্পষ্ট এবং কখনও প্রচ্ছন্নভাবে কিছু অবসেশান বা ভূত কাজ করে। সেটা হোল ইসলাম বিদ্বেষ এবং ইসলাম ভীতি। এটা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি পক্ষপাতের কারন এবং একই সঙ্গে পক্ষপাত প্রদর্শনেরও একটা ধরণ। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ভালো বিএনপি-জামাত খারাপ। এই আতংক ও ভীতির সঙ্গে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ এবং উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদ ও ভারতীয় আগ্রাসনের সঙ্গে সম্বন্ধ তারা ধরতে পারে না কিম্বা সজ্ঞানে আড়াল করে। বুদ্ধিমানরা ইসলাম আতংক ও ইসলাম বিদ্বেষ সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ না করে জামায়াতে ইসলামিকে সামনে নিয়ে আসে। যতো ঘৃণা জামাতের বিরুদ্ধে ঢা্লো! অনেক সময় সেটা সঙ্গত। কিন্তু এর প্রচ্ছন্ন কিন্তু প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মূলত খোদ ইসলামকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো।
এদের গালি দেবার নানান ধরণ আছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমাকে বিএনপি জামাত বলা। এইসবে আমি অভ্যস্ত এবং ধাতস্থ হয়ে গিয়েছি। ধরেন আপনি ইন্টেলিজেন্ট, আগামবেন ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ফুকো পড়েন। এখন আপনি নিশ্চয়ই ফরহাদ মজহারকে অন্যদের মতো গালি দেবেন না। আপনার গালি জাস্টিফাই করার জন্য আপনি বিরাট বুদ্ধিবৃত্তিক জিজ্ঞাসা নিয়ে হাজির হবেন। কিন্তু সেটা আবার করবেন বাংলাদেশের চিন্তা ও রাজনৈতিক ইতিহাস এবং চলমান বাস্তবতার বিচার বাদ দিয়ে। এই রকম একটি মন্তব্য আমার একজন বন্ধুর সুবাদে আমার নজরে এসেছে। সেখানে প্রশ্ন করা হয়েছে ফরহাদ মজহার “কেনো বিএনপি-জামায়াতের সহিংস ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে বৈধতা দিলেন?” অর্থাৎ ‘আমি বিএনপি-জামায়াতের সহিংস ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে বৈধতা’ দিয়েছি। এটা যদিও ডাহা মিথ্যা ও প্রপাগান্ডা, কিন্তু এর বৈশিষ্ট্য বাস্তব রাজনীতির প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে মন্তব্যকারীর প্রশ্ন তোলার ধরনে।
আমাকে সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে তুলনা করবার জন্য বলা হয়েছে, সলিমুল্লাহ খান ‘বল প্রয়োগ করে ক্ষমতায় টেকার চেষ্টা করা আওয়ামী লীগকে ছাড় দেয়ার নীতি গ্রহণ’ করেছেন। আওয়ামী লিগকে শুধু ‘ছাড় দেওয়া”? এই ক্ষেত্রে দেখছি শাহবাগ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ কিম্বা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোন আলোচনা বা তর্ক নাই। সলিমুল্লাহ খানের রাজনীতি কি স্রেফ ‘ছাড় দেওয়া’ নাকি ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও মিডিয়ার মুখপাত্র হওয়া? সেই গুরুতর আলোচনা অনুপস্থিত। অথচ ফরহাদ/সলিম বাইনারি হাজির করা হয়েছে সিরিয়াস পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা হিশাবে। এটা আসলে আওয়ামি লীগ/বিএনপি-জামাত মার্কা প্রাচীন বাইনারি। পাল্টা মন্তব্য আসলে নিষ্প্রয়োজন। তবে মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা নোক্তা হিশাবে বলে রাখা দরকার বোধ করছি।
১. বাংলাদেশের বাস্তব রাজনৈতিক পরিবেশে আমাকে বিএনপি-জামাত ট্যাগ দেওয়া সেকুলার, বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং ইসলাম বিদ্বেষীদের চিরাচরিত অস্ত্র। যাকে নিন্দা করতে চাই তাকে ঘায়েল করবার জন্য ‘জামাতি’ বলা কিম্বা ‘বিএনপি-জামাত’ বলা। অথচ ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান থাকলেই বোঝা যায় বিএনপি আর জামাতের রাজনীতি এক নয়, উদ্ভবের ইতিহাস আলাদা। বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের ভূমিকাও ভিন্ন। মন্তব্যকারী ভুলে গিয়েছেন যে বিএনপির আমলে আমাকে জেল খাটতে হয়েছে।
বিএনপি জামাতের মাঝখানের হাইফেন মূলত আওয়ামী লীগেরই বসানো হাইফেন। বিএনপির সঙ্গে জামাত জুড়ে দেওয়া। এটা আওয়ামী প্রপাগান্ডার মুখ্য শ্লোগান। বিএনপিকে যুদ্ধাপরাধীদের দল প্রমাণ করার জন্যই এই হাইফেন ব্যবহার করা হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় এইসব স্রেফ বালখিল্যতা। এই ধরনের ট্যাগ প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগ এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষাবলম্বন ছাড়া আর কিছুই নয়। আগামবেন-বেঞ্জামিন আওড়ানোর আড়ালে ফ্যসিস্ট রাষ্ট্র ক্ষমতার পক্ষাবলম্বন বিরক্তিকর।
শিক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বাস্তবতা বাদ দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক জিজ্ঞাসা বিমূর্ত এবং অর্থহীন পণ্ডিতি তর্ক। নিজের রাজনীতি আড়াল করাও বটে। যারা আগাম্বেন-বেঞ্জামিনের সঙ্গে পরিচিত নন বা বলপ্রয়োগ, গাঠনিক ক্ষমতা, রাষ্ট্র ইত্যাদি তর্কের সঙ্গে অপরিচিত, তারা বুঝতে পারবেন না মন্তব্যকারী কার পক্ষালম্বনকে করছেন। আরাম!
২. আমোদ বোধ করেছি যে ফরহাদ মজহারের সমালোচনার সময় ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র, একটি অক্ষরও উল্লেখ করা হোল না। যেন ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার উল্লেখ বা পর্যালোচনা ছাড়া ফরহাদ মজহারের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের সমালোচনা করা যায়। এটা আওয়ামী রাজনীতির জের নাকি পদ্ধতিগত ভুল সেটা বিচার করার অবসর আমার নাই। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে নানান প্রতিরোধ ও সংগ্রামের ধারার সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য, পার্থক্য বা সম্পর্ক না বুঝে সব বিরোধিতাই বিএনপি- জামাতেরই বিরোধিতা বলে সমীকরণ টানা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ভয়ংকর বিপজ্জনক। সুবিধা হচ্ছে এতে ফরহাদ মজহারের ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী লড়াইকেও বিএনপি-জামাতি রাজনীতিকে ‘বৈধতা দেওয়া’ বলা যায়। চরম মিথ্যাচার ও বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা করবার সুযোগও তৈরি হয়।
বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে কোন গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের গায়ে ‘জামাতি’ বা ‘বিএনপি’ ট্যাগ মেরে দিয়ে সেই লড়াইকেই খামোশ করে দেওয়া, বাঙালী জাতীবাদী আবেগ দিয়ে নস্যাৎ করার চেষ্টা নতুন কিছু না। পরিণতি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা জারি রাখা এবং দীর্ঘস্থায়ী করা। যদি আমরা নিম্নশ্রেণীর ট্যাগমারুয়া হয়ে পড়ি এবং ফরহাদ মজহারকে জামাত-বিএনপি বানাই, তাতে কী লাভ হয় আমি বুঝতে পারি না। সম্ভাব্য ইতিবাচক তর্কবিতর্কের পথও এতে রুদ্ধ হয়ে পড়ে।
৩. দার্শনিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যালোচনায় আমার আগ্রহ প্রচুর, সেই ক্ষেত্রে আমি ছাত্র বনে যাই। কিন্তু বাস্তব রাজনীতি বর্জিত পণ্ডিতি তর্কে আমার বিশেষ উৎসাহ নাই। কোন সন্দেহ নাই সামগ্রিক ভাবে ইসলাম এবং সুনির্দিষ্ট ভাবে বৃহৎ বাংলায় ইসলাম সম্পর্কে আমার দার্শনিক ও রাজনৈতিক আগ্রহ বিপুল। ফ্যাসিস্ট বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের বিপরীতে বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলমান, ক্ষুদ্র জাতি সত্তাসহ বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে নতুন রাজনৈতিক পরিসর নির্মান করবার কথা আমি ভাবি, কাজ করি, যেখানে প্রত্যকেরই নাগরিক, প্রত্যকেরই মানবিক এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। নিদেন পক্ষে এই অবস্থা অর্জন কিম্বা অর্জনের চেষ্টা বাংলাদেশে প্রধান গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের কাজ। সবাইকে অন্তর্ভূক্ত রেখে নতুন রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিশাবে আমাদের বিশ্বের দরবারে দাঁড়াতে চেষ্টা করা। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে চিন্তার কাজ তাহলে সেই রাজনৈতিকতার সম্ভাব্য রূপ নিয়ে ভাবা।
৪. রোহিঙ্গা ইস্যু, ভারতের নাগরিক পঞ্জী এবং কাশ্মিরের ঘটনায় উপমহাদেশের পরিস্থিতি বাংলাদেশের জনগণের জন্য ভয়ংকর চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। আমার আশংকা বাংলাদেশের জনগণের জন্য বড় ধরনের বিপদ অত্যাসন্ন। খেয়াল করলাম সমালোচনার সময় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সজ্ঞানে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আমলে নিলে আমাকে বোঝা সহজ হোত।
এড়িয়ে যাওয়া অবশ্য দারুন ইন্টারেস্টিং। বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক উভয় দিক থেকে। ইন্টারেস্টিং কারন আওয়ামী লীগের দোষ আগাম্বেন-বেঞ্জামিন পড়া ভাষায় স্রেফ: ‘বল প্রয়োগ করে ক্ষমতায় টেকার চেষ্টা করা’। এটাই আওয়ামী লীগ!! বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ফ্যাসিবাদের সম্বন্ধ নিয়ে কোন উক্তি নাই। উপমহাদেশের পরিসরে দিল্লীর হিন্দু জাতীয়তাবাদী বা হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার সম্বন্ধ নিয়েও কোন আলোচনা নাই। এমনকি শাহবাগ নিয়েও না। দারুন!
৫. শাহবাগ শুধু জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট উৎক্ষেপ মাত্র ছিল না, বাংলাদেশের ‘আভ্যন্তরীণ বিষয়’ হওয়া সত্ত্বেও শাহবাগকে সকল কূটনৈতিক নিয়ম নীতি ভঙ্গ করে সমর্থন জানিয়েছিলেন সেই সময় ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী সালমান খোরশেদ। এই সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা অনুল্লেখ রেখে আমার চিন্তা ও রাজনীতির সমালোচনা বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা। ভারতের হস্তক্ষেপ ও হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন রুখে দেবার জন্য আমরা হাতে গোনা দুই তিনজন লড়েছি। সন্দেহ নাই, আমি অবশ্যই শাপলা সমর্থন করেছি। কারন বিএনপি জামাতের চরম ব্যর্থ রাজনীতির কারণে হেফাজতের আন্দোলনই ছিল আমাদের কাছে ভারতীয় আগ্রাসন রুখে দেবার একমাত্র পথ।
শাহবাগ টেকে নি। কিন্তু যারা সরল মনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শাহবাগে গিয়েছিলেন অচিরেই তাদেরও মোহভঙ হয়েছে। কট্টর হিন্দুত্ববাদী এজেন্ট না হলে এখন অন্যরাও নিজের ভূমিকা নিজেরাই পর্যালোচনা করতে সক্ষম হবেন।
৬.. আওয়ামী লীগের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী প্রীতি এবং বিএনপি জামাতের রাজনীতিকে ‘সহিংস ক্ষমতা দখলের রাজনীতি’ বলে আমাকে দাঁড় করানো হোল সলিমুল্লাহ খানের কাতারে। সলিমুল্লাহ খান ফ্যাসিস্ট মিডিয়া ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র শক্তি ও রাষ্ট্রের সহযোগী হতে পেরেছেন তার এতো জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও। শাহবাগে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এবং জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টদের পক্ষেই ‘সর্বজন’ পত্রিকায় নানান বয়ান হাজির করেছিলেন।
আমি সলিমুল্লাহ খান নই। আমি তার মতো চিন্তা করি না। ফ্যাসিস্ট গণমাধ্যমগুলোর অধিকাংশকেই সন্ত্রাস ও সহিংসতার মুখপাত্র হিশাবে আমি বহু আগেই পরিত্যাগ করেছি। আহমদ ছফার গুণমুগ্ধ ভক্ত হিশাবে আমি আশা করেছিলাম শাহবাগ ও পরবর্তী সময়ে সলিমুল্লাহ খানও ইতিবাচক ভূমিকা নেবেন। কিন্তু নেন নি। তাতে আক্ষেপ করি, কিন্তু কিছুই করার নাই।
৭. কিন্তু দুই সম্পূর্ণ ভিন্নচিন্তা ও রাজনীতির মানুষকে এক কাতারে নামানোর কারন কি? প্রথম কারণ বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে চরম অজ্ঞতা; দ্বিতীয়ত এই হিংস্র ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ব্যবস্থা বিশ্লেষণে চরম বুদ্ধিবৃত্তিক অনীহা। ফলে গণমাধ্যমে এবং রাষ্ট্রিয় ভাবে সংগঠিত ফ্যসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তিকে প্রধান রাজনৈতিক সংকট হিশাবে চিহ্নিত না করে বিএনপি ও জামাতকে প্রধান দুষমণ হিশাবে চিহ্নিত করা হয়। এটাতো ক্ষমতাসীনদেরই পক্ষাবলম্বন।
ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি পক্ষপাতের আরেকটি অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য আছে। সেটা হোল, বাংলাদেশে এবং উপমহাদেশে ইসলাম নির্মূলের সহিংস রাজনীতি আড়াল ও অস্বীকার করা। বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের হাতিয়ারও বটে। তাই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র শক্তি ও ব্যবস্থার বিরোধিতা না করার অর্থ দিল্লীর আগ্রাসী নীতি ও হিন্দুত্ববাদ প্রতিরোধের কর্তব্য অস্বীকার করা। তখন হিন্দুত্ববাদ প্রতিরোধের চেয়েও বিএনপি-জামাতের রাজনীতি ঠেকানো ফ্যসিস্টদের প্রধান কর্তব্য হয়ে ওঠে। ফরহাদ মজহার ‘বিএনপি-জামায়াতের সহিংস ক্ষমতা দখলের রাজনীতিকে বৈধতা দিয়েছেন’– এই মন্তব্যের এটাই এই সময়ে প্রধান রাজনৈতিক মর্ম।
৮. বলাবাহুল্য দলকেন্দ্রিক আলোচনা আমাদের কোত্থাও নেবে না। বিএনপি জামাতের রাজনীতির সমালোচনা/পর্যালোচনা হতেই পারে। বরং আলোচনা দরকার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবার পথ ও পদ্ধতি কি হবে? বুদ্ধিবৃত্তিক দিকে থেকে আলোচনার বিষয় হচ্ছে ইসলাম এবং নানান ধারার জাতীয় চেতনার ইতিবাচিক ভূমিকা কি হতে পারে? সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনারও ভূমিকা থাকবে। কারন একাত্তর বাদ দিলে ‘বাংলাদেশ’ কথাটার কোন মানে দাঁড়ায় না।
৯. পাশাপাশি সকল প্রকার জাতিবাদী ও সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় রাজনীতি্র বিরোধিতা করবার নীতি ও কৌশল নিয়েও ভাবতে হবে। বিশেষত যে সকল চিন্তার বীজ ও রাজনীতির মধ্যে ফ্যাসিস্ট প্রবণতা নিহিত আছে তাদের মোকাবিলার পথ কি হবে? সেই ক্ষেত্রে আমি মনে করি, বাংলাদেশের জনগণকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে ইসলাম জাতিবাদ বরদাশত করে না। তাই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জাতিবাদী ও সাম্প্রদায়িক ইসলামের রাজনীতি ও ঝাণ্ডা জনগণকে পরিহার করতে হবে। জনগণের ধর্মীয় আবেগ যেন জাতিবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে পর্যবসিত না হয় তার জন্য সবাইকে সতর্ক রাখা এবং নিজেদের সতর্ক রাখা দরকার।
স্রেফ কাণ্ডজ্ঞান থেকেই যে কেউই বুঝতে সক্ষম বাংলাদেশে এবং উপমহাদেশে মতাদর্শ হিশাবে ইসলামের ভূমিকা থাকবে। থাকবেই। সেই ভূমিকার রূপ কি হবে তা নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক পর্যালোচনাই এখনকার প্রধান দার্শনিক কাজ। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে সঠিক পথ সম্ভবত ধর্মের পর্যালোচনা এবং ধর্মের অন্তর্নিহিত ভাব ও চিন্তার বিকাশের মধ্য দিয়ে জনগণের চিন্তাশক্তির ক্ষমতা এবং সচেতনতার বিকাশ ঘটানো। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সেই কাজ আমাদের হবে।
১০. এই সহিংস ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরোধিতাই এখনকার প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই গণশক্তির (Constituent power) পরিগঠন ঘটানো সম্ভব। গণশক্তিতে বলীয়ান জনগনের বিজয়ের মধ্য দিয়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার কায়েমের জন্য বিজয়ী জনগণের আহ্বানে একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সভা (Constituent Assembly) ডাকা এবং খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ইত্যাদি আলোচনার বিষয় হতে পারে। এই কথাগুলো আমি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি।
উপমহাদেশে একদিকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ, আরেকদিকে ভারতের হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন এবং তৃতীয় ফ্রন্টে মায়ানমারের হিংস্র বৌদ্ধ জাতিবাদীদের হাত থেকে বাংলাদেশের জনগণকে বাঁচাতে হলে এই দেশের জনগণকে অবশ্যই নতুন করে রাষ্ট্র এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আর কোন বিকল্প নাই। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, জর্জিও আগাম্বেন, তালাল আসাদ প্রমুখের পঠন পাঠন কাজে লাগতে পারে। নইলে পণ্ডিতি তর্ক অর্থহীন। বাংলাদেশের এখনকার সুনির্দিষ্ট কর্তব্যের প্রশ্ন বাদ দিয়ে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও ফ্যাসিস্ট মিডিয়ার সক্রিয় সহযোগী হয়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার আওড়ানো তামাশা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
আমার চিন্তা ও রাজনীতি একই কাতারের পণ্ডিতি-তামাশা না। স্রেফ লিগালিটি ও লেজিটিমিসির মামলাও নয়। সেইসব নিয়েও অন্যত্র আলোচনা হবে। ফেসবুক থেকে
পাঠক মন্তব্য
জাতীয়তাবাদীদের বিপরীতে বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলমান, ক্ষুদ্র জাতি সত্তাসহ বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে নতুন রাজনৈতিক পরিসর নির্মান করবার কথা আমি ভাবি, কাজ করি, যেখানে প্রত্যকেরই নাগরিক, প্রত্যকেরই মানবিক এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। নিদেন পক্ষে এই অবস্থা অর্জন কিম্বা অর্জনের চেষ্টা "বাংলাদেশে প্রধান গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের কাজ। সবাইকে অন্তর্ভূক্ত রেখে নতুন রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিশাবে আমাদের বিশ্বের দরবারে দাঁড়াতে চেষ্টা করা। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে চিন্তার কাজ তাহলে সেই রাজনৈতিকতার সম্ভাব্য রূপ নিয়ে ভাবা।"
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন