ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে জওহরলাল নেহরুর মতো এতো চতুর, শঠ ও বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিক আর আসেনি। নিজে কাশ্মীরি পণ্ডিত হওয়ার পরও কাশ্মীরিদের সঙ্গে শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তিনি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ ও প্রিন্সলি এস্টেট কাশ্মীরের হিন্দুশাসক মহারাজা হরি সিং চেয়েছিলেন ভারত কিংবা পাকিস্তানে যোগদান না করে একটি স্বাধীন কাশ্মীরি রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু চতুর জওহরলাল নেহরু শেখ আব্দুল্লাহকে বন্ধুত্বের ছলনায় ভুলিয়ে ভারতে যোগ দেয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন এবং প্রধানত তার কারণেই নেহরু কাশ্মীরকে ভারতে পান। শের-ই-কাশ্মীর নামে খ্যাত শেখ আব্দুল্লাহ যদি শের-ই-বাংলা ফজলুল হকের মতো শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে যোগ দেয়ার জন্য মনোস্থির করতেন, কাশ্মীর কখনো ভারতের ভাগ্যে জুটতো না। শেখ আব্দুল্লাহ ১৯৪৬ সালে স্বাধীন কাশ্মীর চাওয়া রাজা হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে ‘কুইট কাশ্মীর’ আন্দোলন শুরু করে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ স্বাধীন সত্তাকে নস্যাৎ করেন।
মাথা গরম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ শেখ আব্দুল্লাহকে চতুর নেহরুর খপ্পরে পড়তে দেখে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে রাজা হরি সিংয়ের বাণিজ্য চুক্তি থাকা সত্তে¡ও নেহরু-আব্দুল্লাহ হাতে তার উপায়হীনতা বুঝে শক্তি প্রয়োগ করে কাশ্মীরকে পাকিস্তানে আনতে চাইলেন। এ অবস্থায় রাজা হরি সিংয়ের কোনো উপায় ছিলো না ভারতীয় ডোমিনিয়নের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটনের কাছে সামরিক সাহায্য ছাড়া। আর সেই সুযোগে নেহরু তাকে রাজা হরি সিংকে দিয়ে ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাসেশন’ সই করিয়ে নেন। কাশ্মীর-রাজ হরি সিং ‘ইনস্ট্রমেন্ট অফ অ্যাসেশন’ স্বাক্ষর করলেও তিনি তার ফরওয়ার্ডিং লেটারে লিখেন যে, তিনি চান কাশ্মীর হানাদারমুক্ত হওয়ার পর যেন জনগণের ইচ্ছার প্রতিফল ঘটিয়ে তার রাষ্ট্রিক অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত করাকালে শেখের সঙ্গে নেহরু সহমত হয়ে প্রতিরক্ষা, বিদেশ নীতি ও যোগাযোগ ব্যতীত বাকি সব বিষয়ে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন মেনে নিয়ে সংবিধানে ৩৭০ ধারা যুক্ত করেন। কিন্তু শেখ আব্দুল্লাহ যখন রাজাবিহীন কাশ্মীরের সর্বময় কর্তা হিসেবে আবির্ভুত হন তখন খোদ জওহরলাল নেহরুই শেখ আব্দুল্লাহকে ১৯৫৩ সালে কাশ্মীর ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন।
শেখ আব্দুল্লাহকে কারাগারে রেখে জওহরলাল নেহরু ১৯৫৪ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে ৩৭০ ধারাকে বাস্তবে অকার্যকর করে একটি সাংবিধানিক অধ্যাদেশ জারি করান, যার মাধ্যমে বাস্তবে কাশ্মীরের শুধু প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক-সম্পর্ক ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে নয় বরং সব ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনস্থ হয়। হার্ভার্ডের অধ্যাপক সুগত বসুর ভাষায় : After Sheikh Abdullah’s imprisonment in August 1953, a Constitutional Order was promulgated by the President of India in 1954 upon the advice of Nehru’s government empowering the central government to legislate on all subjects on the Union list, not only defense, foreign affairs and communication.
The 1954 Order also imposed restrictions on fundamental rights and enabled the suspension of the freedom of speech and association on ‘grounds of security’. In less than two years Article 370 had been reduced to a shadow and a husk of what it was originally meant to be’ অর্থাৎ, ‘১৯৫৩ সালের অগাস্টে শেখ আব্দুল্লাহর কারাদণ্ড হওয়ার পর নেহরু সরকারের পরামর্শে ১৯৫৪ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি একটি সাংবিধানিক অধ্যাদেশ জারি করেন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে আইন তৈরির ক্ষমতা দিয়ে সমস্ত বিষয়ে, শুধু প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয় ও যোগাযোগ নয়।
এছাড়াও ১৯৫৪ সালের অধ্যাদেশ ‘নিরপত্তার কারণে’ মৌলিক অধিকারসমূহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং সমাবেশ ও বাক-স্বাধীনতা রহিত করে। দু’বছরের কম সময়ের মধ্যে ৩৭০ ধারাকে তার আদি রূপ থেকে একটি শুষ্ক খোলস ও ছায়ায় নামিয়ে আনা হয়।’ ফলে, কাশ্মীর ও কাশ্মীরীদের সঙ্গে ভারতে আদি বিশ্বাসঘাতক হচ্ছেন খোদ কাশ্মীরেরই সন্তান পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং তার শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষেত্র, অজ্ঞাতসারে হলেও তৈরি করে দেন শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, যাকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ কাশ্মীরের সব মানুষ বিশ্বাস করে তাদের প্রাণ ঢেলে সমর্থন জানিয়েছিলো।
যদিও কাশ্মীরের হযরতবাল মসজিদে রক্ষিত নবী মুহাম্মদের কেশগুচ্ছ চুরি হওয়ার প্রতিবাদে ও পুনরুদ্ধারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পরিণতি ভেবে চতুর নেহরু ১৯৬৪ সালে কাশ্মীরিদের শান্ত করার জন্য শেখ আব্দুল্লাহ উপর থেকে অভিযোগ ও কারাদণ্ড তুলে নিয়ে মুক্তি দেন, কিন্তু ততোক্ষণে শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে নয়, খোদ কাশ্মীরের সংবিধানে পরিবর্তন এনে গণতান্ত্রিক পন্থায় দেশটির কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার সুযোগকে সুদূর পরাহত করে তোলা হয়। শেখ আব্দুল্লাহ মুক্তি পেয়ে নেহরুর হয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে দেখা করতে পাকিস্তানে গিয়ে তাকে ভারত সফরে সম্মত করান, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ নেহরুর অকস্মাৎ মৃত্যুতে সেই সফর আর হয়ে ওঠেনি, যদিও তার পক্ষ থেকে বিদেশ মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতে এসেছিলেন নেহরুর শেষকৃত্যে যোগ দিতে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ খুবই গভীরভাবে লক্ষ্য করছিলেন শেখ আব্দুল্লাহ। আর কাশ্মীরি পণ্ডিত নেহরুপুত্রী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শক দুর্গা প্রসাদ ধর বা ডিপি ধর খোদ কাশ্মীরি ও শেখ আব্দুল্লাহ প্রাক্তন সহযোদ্ধা হওয়ার সুবাদে তিনি এর রাজনৈতিক ও সামরিক তাৎপর্য অনেকটা ভেতর থেকে বুঝতে পেরেছিলেন। আমার ধারণা নিজের বয়স, দীর্ঘ কারাবাস ও ভারতের শক্তি সম্পর্কে অতি মূল্যায়নজনিত কারণে শেখ আব্দুল্লাহ কাশ্মীরের জনগণের হাতে কাশ্মীরের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের স্বপ্ন পরিত্যাগ করেন। ফলে ১৯৭৪ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সমঝোতা করে দীর্ঘকাল পর ১৯৭৭ সালে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন এবং ১৯৮২ সালে ক্ষমতা নিয়েই মৃত্যুবরণ করেন, যদিও ক্ষমতায় ফিরে আসার নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ছিলো তার বিরুদ্ধে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন