জাবাল তারিক
সম্ভবত এ বছরের মে মাসের ২ তারিখ আমি কোনও এক প্রসঙ্গে বলেছিলাম আমরা যারা পিএইচডি করতেছি তাঁরা আসলে করতেছি ঘোড়ার ডিম। ১০০ ভাগ খাঁটি কথা এটা। বিভিন্ন কারণে এটা ঘোড়ার ডিম। সাধারণ জনগণ এইটাকে যেই দৃষ্টিতে দেখে সেই হিসেবে এটা আসলে কিছুই না। কিন্তু এই ডিগ্রীর মাধ্যমে আপনি একটা লম্বা সময় ধরে মেজর ফোকাস রেখে একটা নিজিসই শিখেন, সেটা হচ্ছে কিভাবে গবেষণা করতে হয়। যাস্ট এতটুকুই। এখানে প্রচুর জ্ঞান হয় এইটা কখনও সত্য না। তবে হ্যাঁ আপনি যখন একটা বিষয়ের ক্ষুদ্র একটা টপিকে রিসার্চ করবেন তখন ঐ টপিকের খুঁটিনাটি কোথায় পাওয়া যাবে সেইটা আপনি জানবেন। ফলে এই বিষয় সম্পর্কিত যেকোনও রিসার্চে আপনি অনায়াসে হাত দিতে পারবেন। অন্যরা যেখানে হাবুডুবু খাবে। ফলে এটা একটা হাইলি স্পেশালাইজড ডিগ্রী। এজন্য একটা বিষয়ে যতো বেশি কাজ হয় সেই বিষয়ের যেকোনও রিসার্চ টপিক ততো বেশি স্পেসিফিক হয়। এজন্য যিনি এটা বুঝেন তিনি খুব ভালো করে জানেন যে- উনি যা করছেন তা খুবই ক্ষুদ্র একটা বিষয়।
যদিও এটা তেমন একটা বিষয় না তবুও এটা করা খুবই কঠিন। এটা এজন্য নয় যে কাজটা খুব কঠিন বাট এজন্য যে প্রসেসটার সাথে নৈতিকতা, এথিকস এবং সায়েন্টিফিক পদ্ধতি জড়িত। এই প্রসেসটা শুধু কঠিনই না বরং এই প্রসেস দিয়ে যাওয়ার সময় আপনি শ্রেফ আত্মহত্যা করতে চাইবেন। ফলে যিনি এই প্রসেসের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন তিনি কখনও বিশ্বাস করতে পারবেন না যে- একজন মানুষ ক্রাইসিস মুহুর্তে একটি মেজর দায়িত্ব নিয়ে সারা দেশ ঘুরেছেন, আবার অন্যান্য ডিগ্রীর পাশাপাশি পিএইচডিও করেছেন। এইটা সিম্পলি অসম্ভব। আপনি আল্লামা ইকবাল হইলে ভিন্ন কথা কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে যে আপনি আল্লামা ইকবাল না।
আপনি যে বিষয়ে পিএইচডি করতেছেন সেই বিষয়ে এক্সপার্ট কেউ যদি আপনার সুপারভাইজরি কমিটিতে না থাকে তাহলে আপনার পিএইচডি প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন ধরেন, আপনি লিডারিশিপ প্রসেসের ইসলামী ও অনৈসলামি দিক তুলনা করতেছেন। এখানে কনভেনশনাল লিডারশীপ প্রসেসের সাথে জানাশোনা লোক যেমন লাগবে তেমনি ইসলামী লিডারশীপ প্রসেসের সাথে জানাশোনা লোকও লাগবে। যারা আপনার থিসিসের ড্রাফট ও ইন্টার্নাল প্রেজেন্টেশন দেখে বলতে পারবে যে আপনি সঠিক পথে আগাচ্ছেন কি না। কিন্তু দেখা গেলো আপনার সুপারভাইজরি কমিটির একজন হিন্দু প্রফেসর যিনি থিওলজির কেউ না এবং আর আরেকজন মুসলমান হইলেও ইসলামী থিওলজিতে উনার কোনও এক্সপার্টিজ নাই। এরকম লোকের আন্ডারে আপনি কি করে ইসলামী নেতৃত্ব আর কনভেনশনাল নেতৃত্বের গবেষণা মূলক কাজ করেন? আবার দেখা গেলো আপনি থিসিসের ভেতরে ইসলামী ব্যাংক আর নন-ইসলামী ব্যাংকের তুলনা দিয়ে ভরে রাখসেন। তার মানে আপনার টপিক ঠিক নাই। আপনার টপিক বলছে লিডারশীপ ইন জেনারেল। কিন্তু ভেতরে আপনি কর্পোরেট লিডারশীপের তুলনা করতেছেন। এটা মানহীন পিএইচডি হিসেবেও টিকে না।
পিএইচডি থিসিস কিভাবে গরুর রচনা থেকে ভিন্ন? পিএইচডির থিসিসে আপনি কোন চ্যাপ্টারে কি লিখবেন তা মোটামুটি ফিক্সড এন্ড ফরমেটেড। এই গন্ডি আপনি ভাংতে পারবেন না। আর গরুর রচনা আপনি যেভাবে ইচ্ছা শুরু করে যেভাবে ইচ্ছে শেষ করতে পারেন। গরুর রচনায় আপনি যেকোনও বাক্য আপনি লিখতে পারবেন। যেমন "কালো গরু দেখতে অনেক অনেক সুন্দর"। এটা আপনি গরুর রচনায় লিখতে পারবেন। কিন্তু থিসিসে লিখতে হলে আপনাকে আগে বলতে হবে কোন জাতের গরুর কথা আপনি বলতেছেন এমনকি গরু বলতে আপনি কি বুঝাচ্ছেন। এগুলো পরিষ্কার করে যদি আপনি উপরের বাক্যটি লিখতে চান তাহলেও আপনাকে পর্যাপ্ত ইম্পেরিক্যাল স্টাডির রেফারেন্স দিয়া তা সমর্থন দেখাইতে হবে। এখানে গরুর উদাহরনটা ইনটেনশনাল। কারণ থিসিসে গরুকে বাঁধার এবং এর গন্ডি ফিক্সড করার একটা ব্যাপার আছে। অন্যের গরু ছাড়া থাকুক সমস্যা নেই কিন্তু থিসিসের গরু বান্ধা থাকতেই হবে। এটা ইজি কিন্তু কঠিন। খুবই মামুলী কাজ কিন্ত করতে ঠেলা লাগে।
একজন ইভালুয়েটর আপনার থিসিসটা হাতে নিয়ে প্রথমে টাইটেল দেখবে, এবস্ট্রাক্ট পড়বে, এর পর টেবিল অফ কনটেন্ট পড়ে সোজা চলে যাবে রেফারেন্স সেকশনে। সর্বোচ্চ ১০ থেকে ২০ মিনিট। এর মধ্যেই বুঝা হয়ে যাবে যে উনি আপনার ইন্ট্রোডাকশন পড়বেন কি না। পাতিলের সব ভাত যেমন টিপে টিপে দেখতে হয় না তেমনি থিসিসের কাজটাও তেমন। আপনার থিসিস বিটুইনদ্যা লাইন পড়বেন আপনার সুপারভাইজরি কমিটির সদস্যরা আর পড়বেন এক্সামিনাররা। এটা তাঁরা করবে ভাইভা বোর্ডে আপনাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে ধরার জন্য। এই প্রসেসটা যদি সঠিক ভাবে ঘটে তাইলে "বিন" এর যায়গায় কখনও, দুনিয়া উলটে গেলেও "কন্টেইনার" থাকবে না। "মুহাম্মদ জাফর ইকবালের" জায়গায় কখনও "প্রফেট জাফর ইকবাল" থাকবে না। ইম্পসিবল। কারণ পিএইচডি মানহীন হোক আর যাই হোক- এই থিসিস ডজনখানেক বার লেখক ব্যতীত অন্য থার্ড, ফোর্থ এন্ড ফিফিথ পারসন দ্বারা পঠিত হবে। এই প্রসেসের মধ্যদিয়া গেলে আপনার দুর্বল ইংরেজির হয়তো বেশি উন্নয়ন হবে না কিন্তু "বিন" এর যায়গায় "কন্টেইনার", "মুহাম্মদের" জায়গায় "প্রফেট" কিংবা প্রচুর পরিমানে অসংলগ্ন ও মিনিংলেস বাক্য কখনই থাকবে না। সুতরাং মানহীন পিএইচডি আর গার্বেজের মধ্যে খুব সুস্পষ্ট ও আকাশ পাতাল তফাত আছে। মানহীন পিএইচডিও পিএইচডি কিন্ত গার্বেজ ও গরুর রচনা কখনই পিএইচডি না। যখন কোনও গরুর রচনা পিএইচডির ডিগ্রী পায় তখন বুঝতে হবে যে এটা অনৈতিক পন্থায় নেয়া হয়েছে। কন্টেইনার আর বিন তো দুরের কথা- থিসিসে রেফারেন্স ছাড়া আপনি কোনও স্ট্রং স্টেটমেন্টই লিখতে পারবেন না। সুপারভাইজর আপনাকে সেটা অতি অবশ্যই ধরিয়ে দেবেন। অতএব এরকম ভুল থাকেই- এইসব ফালতু যুক্তি তারাই দিচ্ছেন যারা কখনও পিএইচডি করেন নাই।
থিসিসের ভেতরে না পড়েই রেফারেন্স সেকশনে আমি কেন যাবো? এর অনেক গুলো কারণ আছে। তবে প্রধান কারণ হচ্ছে- আপনি যে বিষয়ে থিসিস লিখেছেন সে বিষয়ে যে পরিমাণ কাজ হয়েছে তার তুলনায় আপনি কি পরিমাণ কাজ রিভিউ করেছেন সেটা দেখার জন্য। আরেকটা কারণ হল- আপনি যে সময়ে থিসিস লিখেছেন সে সময় থেকে লাস্ট পাঁচ বছরে হওয়া অন্যান্য অথারের কাজ আপনি কতটুকু বিবেচনায় নিয়েছেন সেটা দেখার জন্য। গার্বেজের সাথে থিসিসের পার্থক্য এইটাই। যদি এগুলো না থাকে তাহলে আপনার থিসিসটা মানহীন পিএইচডিও হবে না- যাস্ট গার্বেজ হবে। যেমন লিডারশীপের উপর কনভেনশনাল বলেন আর ইসলামিক ফিল্ডে বলেন- হিউজ পরিমানে কাজ হয়েছে। হিউজ মিন্স হিউজ। ২০১০-১৪ সময়ে IIUM এর দুইজন বাংলাদেশি ছাত্র লিডারশীপের উপরে পিএইচডি করেছিলেন। একজন থিওলজির স্টুডেন্ট আরেকজন সাবেক মেজর। দুজনেই এখব বেশ ভালো পর্যায়ে জব করছেন। উনাদের সাথে তখনই আমাদের উঠতে বসতে লিডারশীপের উপরে হওয়া কাজ নিয়ে কথা হতো। একদিন মেজর জিয়া ভাই আমাকে উনার রুমে নিয়ে গেলেন উনার থিসিসের কনসেপচুয়াল ফ্রেমওয়ার্কটা দেখানোর জন্য। একটা পাঁচ মিটার প্রশস্ত দেয়ালের পুরোটা জুড়ে উনার ডায়াগ্রাম দেখে আমি ছানাবড়া। ছবি তুলতে চাইলে তিনি বারণ করলেন। কারণ তখনও উনার ডিগ্রী হয় নাই। পরে দুজনের থিসিসই আমি দেখেছি। অসাধারণ কাজ করেছেন দুজনেই। সুতরাং লীডারশীপের উপরে কি পরিমাণ কাজ হয়েছে তা আমার জানা আছে। এখন আমি যখন দেখবো একটা ৩৫০ প্লাস পেইজের রেফারেন্স মাত্র ৭ পৃষ্ঠার তার উপর সেখানে একই রেফারেন্সকে তিন বার চারবার করে লিস্ট করা (সাইট না) হয়েছে তাহলে কি আর সন্দেহ থাকে যে এটা থিসিস না বরং গার্বেজ?
অতএব উই আর নট টকিং এবাউট "মানহীন পিএইচডি", আমরা কথা বলছি অনৈতিক পিএইচডি সম্পর্কে। এসব বিষয় ছাড়াও পিএইচডির নভেলটি নিয়ে প্রশ্ন আছে, যে প্রতিষ্ঠান পিএইচডি দিয়েছে সে প্রতিষ্ঠান নিয়ে প্রশ্ন আছে। আপনি বিদেশে পিএইচডি করতে যাবেন এবং কোইন্সিডেন্টলি সেটা ভারতের অখ্যাত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হবে, সেইটার নাম আবার ইউজিসির ব্ল্যাক লিস্টে থাকবে, আপনার পেপারটা এমন একটি নন-ইন্ডেক্স জার্নালে পাবলিশড হবে যেখানে আপনার সুপারভাইজর নিজেই এডিটর এবং আপনার থিসিসে
বিনের জায়গায় কন্টেইনার আর মুহাম্মদের জায়গায় প্রফেট চইলা আসবে- কতগুলা কোইন্সিডেন্ট একসাথে ঘটতে পারে বলেন তো? আপনি পিএইচডি করুন আর নাই করুন- আপনার যদি এ সম্পর্কে এ বি সি ও জানা থাকে তাহলে আপনি নিশ্চই জানেন যে- পিএইচডি কোনও কোইন্সিডেন্টাল ডিগ্রী না, এইটা সম্ভব না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন