মাহমুদ নোমান
সালাফীজম ব্যাপারটা আসলেই চরম গোলকধাঁধার। এর দল উপদলগুলো এত বৈপরীত্বে ঠাসা যে এগুলোর মধ্যে পার্থক্য বোঝা আসলেই দুষ্কর।
যেমন আমাদের দেশের কথাই ধরুন। তাকফীরি এবং মাদখালী এই দুই দল সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। একে অপরের বিরুদ্ধে সদা কামান দাগায়। তাকফীরিরা মাদখালীদেরকে মুনাফিক মুরজিয়া বলে। বিপরীতে মাদখালীরা তাকফীরিদেরকে খারেজী জাহান্নামের কীট বলে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, দুই দলই সালাফী আলেমদের দ্বারা প্রভাবিত। তাকফীরিরা আইএস'সহ যেসব আরব উগ্রপন্থী জিহাদী শায়খের অনুসরণ করে তারা সবাই সালাফী। তারাও মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব রহ. এর আদর্শ অনুযায়ী তাউহীদী রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। আইএস শাসিত ইরাক সিরিয়ার প্রতিটি মাদরাসায় ছাত্রদের অত্যাবশ্যকীয় পাঠ তালিকায় থাকতো শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব রহ. এর কিতাবুত তাউহীদ।
আবার মাদখালীরাও সেই মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রহ. কেই বিক্রি করে। তারাও তাঁর মত অনুযায়ী আকীদায়ে ইসলামে বিশ্বাস করে। নিজেদের মতকে তাঁর মত বলে চালায়।
এই দুই দলের বিপরীতে আরেক দল সালাফীকে দেখবেন, যারা জিহাদের নামে উগ্র তাকফীরিও নয়, আবার মাদখালীদের মতো শয়তানের পা চাটা গোলামও নয়। এরা আকীদা এবং ফিকহের ক্ষেত্রে সালাফী মতবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু রাজনীতি ও শাসনকার্যের ব্যাপারে অনেক অগ্রসর চিন্তা লালন করে। মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করার পাশাপাশি ইসলামী শাসনব্যাবস্থা কায়েম করার কাজে ব্রতী হওয়ার কথা বলে। দুইটার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। আরবদের বড় একটি অংশ এই সালাফী গ্রুপের অংশ। মিসরের অধাকাংশ মুখলিস সালাফীরা এই ঘরানার। তারা কোনদিন মুরসির সাথে বেঈমানী করেনি। জালিমের গোলামী করেনি। এদের নেতাদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ব্যাক্তিত্ব হচ্ছেন শায়খ হাযেম সালাহ আবু ইসমাইল হাফি.। তাঁকে মিসরের সবচেয়ে বিচক্ষন রাজনীতিবিদ মনে করা হয়। মুরসির বিরুদ্ধে ঘটিত ক্যুয়ের দিন হাজার হাজার নেতাকর্মীর সাথে তিনিও গ্রেপ্তার হন। এখনো কারাগারেই বন্দী আছেন। তিনি শেষ দিন পর্যন্ত মুরসির পাশে থেকেছিলেন। পরামর্শ দিয়েছিলেন। ইখওয়ানের সাথে তাদের সামন্য কিছু মতভিন্নতা আছে, তবে এরা কেউ একে অপরের প্রকাশ্য বিরুধীতা করে না। মুরসির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পেঁছনে এদের অনেক বড় অবদান আছে। ইখওয়ানের সর্বসাকুল্যে দলীয় ভোট ছিল ৫ মিলিয়নের মতো। কিন্তু মুরসি নির্বাচনে প্রায় ১৩ মিলিয়ন ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন, যার মধ্যে বড় একটি সংখ্যায় সালাফীদের ভোট ছিল। নির্বাচনের দিন কীভাবে সালাফীরা অনেক দূর থেকে গাড়ী ভাড়া করে নিজেদের মা, বোন, বউদের নিয়ে এসেছিল মুরসিকে ভোট দেয়ার জন্য তা আমরা নিজের চোখে দেখেছি। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে সালাফী মেয়েরা মুরসিকে ভোট দিয়েছে। এগুলো ভুলে গেলে চলবে না। এখনো প্রেসিডেন্ট মুরসির শাহাদাতে তারা নিরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে। এরা অনেক মুখলিস। সাইয়েদ কুতুব শহীদ রহ. সহ ইখওয়ানের বড় বড় আলেমদের দ্বারা তারা অনেক প্রভাবিত। শায়খ আব্দুল্লাহ আযযাম শহীদ রহ. কে এই ক্যাটাগরীতে রাখা যায়। সোভিয়েত বিরুধী আফগান জিহাদের প্রতি জনমত তৈরি করার জন্য তিনি এবং তাঁর সাথীরা শায়খ কুতুবের জিহাদ বিষয়ক কিতাবাদির সাহায্য নিয়েছিলেন।
সৌদী আরবে এই ঘরানার সালাফীদের একটা আন্দোলন ছিল আস সাহওয়াহ্ নামে। পরবর্তিতে সৌদী সরকার এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে এবং সন্ত্রাসী ট্যাগ দেয়। শায়খ সাফার আল হাউলি, শায়খ সালমান আল আওদাহ সহ যেসব বড় বড় আলেম এখন সৌদী জেলে বন্দী তারা সবাই সাহওয়াহ্ ঘরানার সালাফী। এরা মধ্যপন্থী, মুখলিস এবং বহুমুখী ইলমের অধিকারী। এদেরকেও মাদখালীরা খারেজী বলে।
তাছাড়াও সালাফী মতবাদের প্রচুর ইতিবাচক দিক আছে। প্রচলিত মাযহাবগুলোকে সর্বাবস্থায় আঁকড়ে ধরে রাখার মানসিকতা অনেক সত্যকে গ্রহন করতে আমাদেরকে বাঁধা দেয়। প্রচলিত অনেক ভুলের উপর থেকে যাই শুধু এই দোহাই দিয়ে যে, এটা আমাদের অমুক আকাবির করেছেন। সালাফী মতবাদের নতুন করে আত্মপ্রকাশের কারণে আমাদের সেই অবস্থানগুলো পূনর্বিবেচনা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
তো, সালাফী মতবাদের সরল অর্থ এবং এর প্রকারভেদের উপর ড. ইয়াসির ক্বাদীর একটি খুব ভালো একাডেমিক আলোচানা আছে। এটি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছ। কমেন্টে লিংক দেয়া থাকবে। সময় নিয়ে সবাইকে পড়ার অনুরোধ করছি। এটা পড়ার পর প্রচিলত সালাফীদের ব্যাপারে জন্ম নেয়া মারপ্যাঁছ ও সংশয়গুলো কেটে যাবে বলে আশা করি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন