শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরিটাস অধ্যাপক। এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। বহু আগে শ্রেণিকক্ষ থেকে অবসর নিলেও বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকৃত উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র করে তোলার জন্য তার ভাবনা ও কর্মে কখনো ছেদ পড়েনি। একাধিকবার উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। মনোযোগী হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি প্রকৃত জ্ঞান উৎপাদন ও চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য।
সমাজ-রূপান্তর অধ্যায়ন কেন্দ্রের উদ্যোগে গত ৭ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে অধ্যাপক আহমদ কবির প্রথম স্মারক বক্তৃতা দেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বক্তৃতার বিষয় ছিল 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ: বিচারের দুই নিরিখে'।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এই স্মারক বক্তৃতার কথাগুলো ৭ পর্বে প্রকাশিত হবে দ্য ডেইলি স্টার বাংলায়। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একশ বছরের ইতিহাস সংগ্রামের, অগ্রগামিতার ও গৌরবের। কিন্তু কোনো ইতিহাসই সরল রেখায় এগোয় না, ছেদ-বিচ্ছেদ ঘটে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের ইতিহাসেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা নানাভাবে বিঘ্নিত হয়েছে, এমনও ঘটনা ঘটেছে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়টি টিকতে পারবে কি না তা নিয়েই সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
আধুনিককালে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কেই হয়তো এত প্রতিবন্ধকতা হটিয়ে সামনে এগুতে হয়নি। আবার সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে দায়িত্ব পালন করেছে তাও অসামান্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন ও গৌরবকে স্মরণ করার সময় ওইসব বাধা-বিঘ্ন ও দায়-দায়িত্বের বিষয়গুলো বিস্মৃত হলে চলবে না। সমসাময়িক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ইতিহাসের ভেতর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তার অগ্রগমন অব্যাহত রাখতে হয়েছে। প্রতিবন্ধকতা ভেতর থেকে তেমন আসেনি, যেমনটা এসেছে বাইরে থেকে। রাষ্ট্র বিরূপ ছিল, সমাজও যে অনুকূল ছিল তা নয়।
আপাত-বিবেচনায় সমাজের পক্ষে বিরূপ হবার কথা নয়। অবহেলিত, প্রান্তিক, অনগ্রসর বাংলা প্রদেশে দ্বিতীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা তো সুখবরই হবার কথা; কিন্তু সমাজের সকল মহল ঘটনাটিকে সেভাবে নেয় নি। এর কারণ সাম্প্রদায়িকতা। অগ্রসর হিন্দু সমাজের একাংশ মুসলমান-প্রধান পূর্ববঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিল। বস্তুত ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনটি শুরুতে যেমন অভিন্ন বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনাকে ধারণ করেছে, পরবর্তীতে তেমনটা পারেনি; সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যে 'বন্দেমাতরম' রণধ্বনি হিন্দু সম্প্রদায়ের তরুণদের উজ্জীবিত করেছিল, সেটাই বিভাজনের একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই ধ্বনির অন্তর্গত হিন্দু মাতৃমূর্তির ধারণাটিকে মুসলিম সম্প্রদায় গ্রহণে অসম্মত হয়েছে।
এবং পরে, ১৯১১ সালের শেষে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ হলো তখন পূর্ববঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায় হতাশ হয়েছে; কারণ নতুন প্রদেশে তাদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটবে এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল বৈকি। ওদিকে ১৯০৬ সালে ঢাকাতেই নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামে মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়ে গেছে, এবং ইংরেজ সরকার পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা কায়েম করে দুই সম্প্রদায়ের ভেতর স্বার্থগত স্বপ্নের বিভাজনকে নতুন গভীরতায় নিয়ে গেছে। এরই পাশাপাশি বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকারীদের শাস্তি দেবার অভিলাষে ভারতবর্ষের রাজধানীকে কলকাতা থেকে দিল্লীতে সরিয়ে দেবার সিদ্ধান্তও বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়কে মোটেই সন্তুষ্ট করেনি। এভাবে সব দিক থেকেই জাতীয়তাবাদী স্বদেশী আন্দোলন সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। গান্ধীজি এসে এক বছরের মধ্যে স্বরাজ আনবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিলেন, এবং যাতে তিনি খেলাফতপন্থীদেরও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন, সে-আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার দরুন বড় রকমের হতাশা দেখা দেয়। এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গড়বার প্রচেষ্টাটি ভেঙে যাওয়ার ফলস্বরূপ হতাশার ও ব্যর্থতাবোধের ভেতর থেকে উল্টো সাম্প্রদায়িকতাই নতুন শক্তি অর্জন করতে পেরেছিল। বলাই বাহুল্য ইংরেজরা এই বিরোধের বিকাশে সমানে উৎসাহ যোগাচ্ছিল।
এই রকমের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। এবং সেটা ঘটেছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের দাবীর মুখে। তাঁরা চাইছিলেন বঙ্গভঙ্গ রদ করার ক্ষতিপূরণ (কমপেনসেশন) হিসেবে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। ইংরেজরা তাতে সায় দিচ্ছে দেখে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের খুশি হবার কথা নয়; সেটা তাঁরা হনও নি। তাঁদের মনে হয়েছিল প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বিভাজন বৃদ্ধিতে ব্যর্থ হয়ে সরকার নতুন এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক অভ্যন্তরীণ বিভাজন ঘটানোর চেষ্টা চলবে।
রমেশচন্দ্র মজুমদার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিককার অধ্যাপকদের একজন এবং পরবর্তীতে তিনি উপাচার্যের দায়িত্ব পান। তিনি স্মরণ করেছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে হিন্দু সমাজের একাংশের পক্ষ থেকে বেশ জোরালো আপত্তি উঠেছিল। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, 'তাদের আপত্তির প্রধান কারণ ছিল যে এর ফলে রাজনৈতিক ভাগের পরিবর্তে বাংলাদেশকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে দুই ভাগ করা হবে।' (রমেশচন্দ্র মজুমদার, 'ঢাকার স্মৃতি', আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সম্পাদক আশুতোষ ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ সংস্করণ, ঢাকা, ২০২১, পৃ. ৬৯)
একই কারণে কলকাতার হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের কয়েকজন খ্যাতিবান প্রতিনিধি বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাতিল করার দাবি জানিয়েছিলেন। আপত্তি উঠেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকেও। পূর্বপ্রতিষ্ঠিত ওই বিশ্ববিদ্যালয় চায়নি তার একক কর্তৃত্ব ও আধিপত্য খণ্ডিত হোক। এই আপত্তির ভেতরও সাম্প্রদায়িকতার উপাদান যে ছিল না তা নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল হিন্দু মধ্যবিত্তের অনেকটা একচ্ছত্র আধিপত্য, তাদের আপত্তিটাকে তাই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবার সুযোগ ছিল বৈকি।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে ইংরেজদের যে আগ্রহ ছিল তা মোটেই নয়। বাংলায় উচ্চশিক্ষার বিস্তারে তারা উদ্বিগ্নই ছিল, কারণ তারা টের পাচ্ছিল যে এর দরুন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, আর সেই সঙ্গে জেগে উঠছে তাদের অসন্তোষ। নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে ওই অসন্তোষকে আরও উৎসাহ দেবে এমন অভিপ্রায় তাদের ছিল না। তবে অসন্তুষ্ট মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবির মুখে ওই সম্প্রদায়কে কিছুটা ছাড় দেবার ইচ্ছাতেই তারা সম্মত হয়েছিল ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে। ছাড় (কনসেশন) শব্দটা তারা ব্যবহারও করেছে। তবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় যে মধ্যবিত্তের ভেতর হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে এগিয়ে নেবে এমন আশাও তাদের ছিল বৈকি। বস্তুত ওই আশাটি ছিল ইংরেজ শাসনের সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই অংশ। জনসংখ্যার হিসাববিবরণী প্রস্তুতের (সেনসাসের) শুরুতেই তারা হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সদস্যদেরকে আলাদা করে দেখিয়েছে; ভারতের ইতিহাসকেও হিন্দু যুগ ও মুসলমান যুগ হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করেছে। প্রথম দিকে তাদের বিশেষ রকমের বিদ্বেষ ছিল মুসলমানদের প্রতি, কারণ মুসলমান শাসকদের কাছ থেকেই তারা রাজ্যশাসন ছিনিয়ে নিয়েছিল। পরে ১৮৫৭-তে যে সিপাহী অভ্যুত্থান ঘটে তাতে হিন্দু-মুসলিমের মারমুখী ঐক্য লক্ষ্য করে তারা একদিকে যেমন প্রমাদ গুণেছিল, অপর দিকে তেমনি তাতে নবগঠিত শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অনুপস্থিতি দেখে কিছুটা সন্তুষ্টও হয়েছিল। তাদের শঙ্কা ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যদি সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলিত হয় তাহলে পরবর্তী অভ্যুত্থানটি হয়তো ফরাসী বিপ্লবের মতোই ভয়ঙ্কর ঘটনায় পরিণত হবে। মধ্যবিত্তকে তাই আলাদা করা চাই; মধ্যবিত্তের ক্ষোভবিক্ষোভের জন্য একটা প্রকাশমুখ খোলাও দরকার। এই বোধ থেকেই তারা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গঠনকে উৎসাহিত করে। এবং পরবর্তীতে যখন দেখে যে খুব একটা কাজ হচ্ছে না, কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদন নীতিতে মধ্যবিত্তের বিক্ষুব্ধ অংশ সন্তুষ্ট নয়; তখন তারা বঙ্গভঙ্গ, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ দান, পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা ইত্যাদি বিভেদাত্মক চতুর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বঙ্গভূমিই যেহেতু ইংরেজবিরোধী তৎপরতার প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, বাংলাকে তাই ভাগ করা; এবং পরে ভাগ যখন রদ করতে হলো তখন শাস্তিস্বরূপ তো বটেই, আন্দোলনকে দুর্বল করবার অভিলাষেও রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গেল দিল্লীতে আসাম ও বিহারকে বিচ্ছিন্ন করা হলো বাংলা প্রদেশ থেকে। হিন্দু সমাজের প্রতিনিধিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকে ওইসব পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা হিসেবেই গণ্য করেছিলেন। তাঁরা নিজেদের সম্প্রদায়গত স্বার্থকেই বড় করে দেখেছেন, সমগ্র বঙ্গের সামাজিক অগ্রগতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাব্য ভূমিকাকে বিবেচনার ভেতর না নিয়ে।
রমেশচন্দ্র মজুমদার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ভেতর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আপত্তির যে কারণটির কথা বলেছেন সেটিকেই আরও পরিষ্কার ভাবে পাওয়া যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন সাবেক ছাত্রের লেখাতে। রমেশ মজুমদারের লেখাটি আছে আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামের একটি সঙ্কলন গ্রন্থে, অপর লেখাটিও রয়েছে একই সঙ্কলনে। লেখক অনাথবন্ধু বেদজ্ঞ বলছেন যে, ১৯১১-তে এসে বঙ্গভঙ্গকামী শাসকগোষ্ঠী পথ পরিবর্তন করেছে মাত্র, মত পরিবর্তন করে নি। তিনি লেখেন, 'হিন্দু মুসলমান মিলন তাদের রাত্রির নিদ্রা হরণ করল। তাই তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির কর্মসূচী তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ। মন্দির ও মসজিদে পূজায় ও নামাজ আচরণে ও প্রকরণে এই দুই জাতি যে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ইহা সঙ্কীর্ণতাবাদী, ধর্মীয় গোঁড়ামি দ্বারা আচ্ছন্নবুদ্ধি লোকদের দ্বারা প্রবলভাবে প্রচারিত হতে লাগল।' (অনাথবন্ধু বেদজ্ঞ, 'একটি বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায়', প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭)
এই লেখকের মতে ওই কর্মসূচীরই একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। নিজের অজান্তেই হবে, অনাথবন্ধু বেদজ্ঞ বলছেন যে বাঙালী হিন্দু ও মুসলমান এক জাতি নয়, দু'টি পৃথক জাতি। শাসক ইংরেজেরও কিন্তু বড় একটা ভরসা ছিল সম্প্রদায়কে জাতি হিসেবে চিহ্নিত করার ওপরই।
তবে বিভাজনবৃদ্ধির সন্দেহটা যে নীরব ছিল তা নয়। কলকাতায় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যেভাবে বড়লাটের কাছে সশরীরে গিয়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার 'অন্যায়' সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন, অকুস্থল ঢাকাতে তা আরও সংগঠিত রূপ নিয়েছিল। অনাথবন্ধু বেদজ্ঞ জানাচ্ছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রতিবাদে ঢাকায় জনসভা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। সদরঘাটের করোনেশন পার্কের এক জনসভায় ঢাকা শহরের লব্ধপ্রতিষ্ঠত একজন আইনজীবী বলেন, "প্রারম্ভে এর আড়ম্বর ও জাঁকজমক দেখে মনে হলো এটা একটা Pucca University, কিছুদিনের মধ্যে মনে হলো এটা একটা Mecca University, তারপর বর্তমান উপলব্ধি এটা একটা ফাক্কা University ৩ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিহাস করে Mecca of the East বলা হতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। নিজের সাধনায় ও যোগ্যতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য প্রমাণ করেছে যে এটি মক্কা নয়, ফাক্কাও নয়, পাক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়ে উঠেছিল।
তবে রাষ্ট্রের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধির অনুপ্রেরণার উপলদ্ধিটিও যে মিথ্যা ছিল না তার প্রমাণ শাসক আমলাদের উক্তিতেই পাওয়া যায়। কনসেশন বা কমপেনসেশন যাই বলা হোক না কেন, তাতে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত করা হচ্ছে এমন ভঙ্গিটা চাপা থাকে নি। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৩ সালে। ওই সমাবর্তনে বাংলার তখনকার গভর্নর লর্ড লিটন যে ভাষণ দেন তাতে দু'টি উক্তি ছিল বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। দু'টোই ছিল আশাবাদী। প্রথমটিতে তাঁর বক্তব্য :
I have already stated in public that in my opinion this University is Dacca's greatest possession. And will do more than anything else to increase and spread the fame of Dacca beyond the limit of Bengal or of India itself. (Dhaka University : The Convocation Speeches, vol. I, compiled by Serajul Islam Choudhury, Dhaka Bishwabidyalay Prokashona, Sangstha, Dhaka, 1988, p. 30)
এটি তাঁর প্রথম আশাবাদ; তাঁর দ্বিতীয় আশাবাদটিতে কিন্তু কিছুটা প্ররোচনাও ছিল। এতে তিনি বললেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যা হতে পেরেছে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তা হওয়া কখনোই সম্ভব হবে না; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে আবাসিক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সেটা কিছুতেই হতে পারবে না। কিন্তু ঢাকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর একটি সম্ভাব্য বৈশিষ্ট্যের কথাও তিনি বললেন,
Situated as it is in Eastern Bengal, Dacca will naturally become the centre of Mohammedan learning and devote special attention to higher Islamic studies. (Dhaka University : The Convocation Speeches, vol. I, compiled by Serajul Islam Choudhury, Dhaka Bishwabidyalay Prokashona, Sangstha, Dhaka, 1988, p 31)
যেন কথিত সেই মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় হলেই তাঁরা খুশি হতেন। লর্ড লিটনরা বাঙালীপ্রীতির জন্য খ্যাত ছিলেন না; বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়াতে এঁরা মোটে খুশি হন নি, এবং সাম্প্রদায়িকতাকেই উৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন।
লর্ড লিটনের প্রথম প্রত্যাশাটা অর্থাৎ ঢাকার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মহত্তম সম্পত্তি হওয়া এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ঢাকার খ্যাতি বৃদ্ধি করা ও সেই খ্যাতিকে ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে দেওয়াটা অনেকাংশেই পূরণ হয়েছিল; কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম শিক্ষার কেন্দ্র হবে এই প্রত্যাশাটি মোটেই পূরণ হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় না হয়ে একটি পাক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়েছে। এখানে জ্ঞানের অনিয়ন্ত্রিত ও অব্যাহত চর্চা সম্ভব হয়েছে, এবং সাম্প্রদায়িকতা তো নয়ই, বরং ধর্মনিরপেক্ষতারই একটি সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে গড়ে উঠেছে, যেটি বাইরেও যে প্রসারিত হয়নি এমন নয়। এর সকল অনুশীলনেই দৃষ্টিটা ছিল ইহজাগতিক এবং অঙ্গীকার ছিল ধর্মকে ব্যক্তিগত আচরণ ও বিশ্বাসের ব্যাপার হিসেবে রেখে রাষ্ট্রব্যবস্থাপনাকে ধর্মীয় পরিচয় গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখার।
এর কারণ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম যিনি উপাচার্য হিসেবে এসেছিলেন তিনি- পি জে হার্টগ-ছিলেন একজন যথার্থ শিক্ষাব্রতী। শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী বিভেদ নীতি প্রয়োগ করার ব্যাপারে তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। তিনি চেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টি জ্ঞানচর্চার একটি আধুনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠুক। সে জন্য তিনি ভালো বেতন ও আবাসের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেছে বেছে মেধাবী শিক্ষকদেরকে সংগ্রহ করেছেন। শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি পরিষ্কারভাবে জানতেন যে শিক্ষার মান নির্ভর করে উপযুক্ত শিক্ষকদের ওপরে। তাই একেবারে প্রথম দিকেই এলেন সত্যেন বসু ও জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, রমেশচন্দ্র মজুমদার, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ও হরিদাস ভট্টাচার্যের মতো গবেষক ও আদ্যোপান্ত শিক্ষকেরা। এই উপচার্যের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যোগ্য শিক্ষক সংগ্রহের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এসেছিলেন মোহিতলাল মজুমদার ও চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। দু'জনের কারোই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছিল না; কিন্তু তাঁরা উচ্চমানের শিক্ষক ও গবেষক ছিলেন; বিবেচনায় ডিগ্রিটা ছিল না, ছিল যোগ্যতাই। অধিকাংশ শিক্ষকই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের কিন্তু তাঁরা মনে-প্রাণে শিক্ষকই ছিলেন, স্বীয় সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন না। এমনকি যে মোহিতলাল মজুমদার পূর্ববঙ্গের মানুষদের ভাষা ব্যবহার নিয়ে কৌতুক করতেন বলে শোনা যায়, তিনিও ভাষার ওই ব্যাপারটাকে আঞ্চলিকতার টান হিসেবেই দেখেছেন, সাম্প্রদায়িক পশ্চাৎপদতা হিসেবে নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজে তখন সাম্প্রদায়িক বিরোধ ক্রমশ সংঘর্ষের রূপ নিচ্ছিল, তার প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনাতে যে অনুপ্রবেশ করেনি তা নয়। ১৯৪৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের মূল ফটকে নাজির আহমদ নামে একজন ছাত্র নিহত হয়েছেন ঘাতকদের ছুরিকাঘাতে; তিনি দাঙ্গা করতে যান নি, গিয়েছিলেন দাঙ্গা থামাতে। তবে মর্মান্তিক ও কলঙ্কজনক সেই হত্যাকাণ্ডটি ছিল একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা, এবং সেটি ঘটেছিল সেই সময়ে ভারতবর্ষের যখন সাম্প্রদায়িকতার অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হবার দশা, রাজনীতি যখন অনিবার্যভাবে দেশভাগের দিকে এগুচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অবশ্যই রাজনীতি-সচেতন ছিল, কিন্তু সে রাজনীতির মূল ধারাটি ছিল ব্রিটিশবিরোধিতার। বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা শুরু করে মোট ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে, তাদের মধ্যে মাত্র ১৭৮ জন ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের। হিন্দু সমাজের অগ্রসর ছাত্রদের রাজনীতির কেন্দ্রে ছিল ব্রিটিশকে তাড়ানোর অঙ্গীকার; মুসলমান সম্প্রদায়ের সহপাঠীদেরকে শত্রু ভাববে এমনটা তাদের পক্ষে সম্ভবই ছিল না। তাদের শত্রু ছিল ইংরেজ। মুসলমান ছাত্রদের অধিকাংশই এসেছে গ্রাম থেকে, যাদের নির্ভরতা কৃষি উৎপাদনের ওপর। এই ছাত্ররা ব্রিটিশবিরোধিতা অবশ্যই সমর্থন করেছে, কিন্তু তাদের মূল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল শিক্ষাজীবনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার এবং ছাত্রত্ব শেষ করে উপার্জনশীল হওয়ার দিকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অনুৎসাহী শাসকদের ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি বৃদ্ধির দুষ্ট বুদ্ধিটা যে অনুপস্থিত ছিল না, সেটা তো জানাই গেছে। কিন্তু সেই অভিসন্ধি অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। মুসলমানদের সুবিধা করে দেয়ার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, এই রকমের ঘোষণা সত্ত্বেও প্রথম দিকে মুসলমান শিক্ষার্থী কিন্তু প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়নি, আর্থ-সামাজিক কারণে। হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা অধিকাংশই এসেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে; ১৯২১ সালে এই শ্রেণীর মধ্যে ব্রিটিশবিরোধিতা বেশ সরব হয়ে উঠেছিল। একাংশ তো তখন রীতিমত বিপ্লবী তৎপরতায় যুক্ত হয়ে গেছে। ঢাকা শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কম হয় নি, তবে এমনকি দাঙ্গার কালেও শহরের তরুণরা গোপন অনুশীলন দলের অনুপ্রেরণায় ও শিক্ষায় সশস্ত্র পথে ইংরেজ উচ্ছেদের কাজে যোগ দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিপ্লবীদের যোগ ছিল, এবং শিক্ষার্থীদেরও কেউ কেউ যে ওই কর্মধারায় যুক্ত হয়ে পড়েনি এমনও কিন্তু নয়।
অপরদিকে মুসলমানদের ভেতরও সমাজসচেতনতা দেখা দিয়েছিল তার প্রমাণ মুসলিম হলকে কেন্দ্র করে গড়ে-ওঠা 'বুদ্ধির মুক্তি' আন্দোলন। এই দলের লড়াইটা মূলত ছিল নিজেদের সমাজের পশ্চাৎপদতা ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে; হিন্দু সমাজকে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবলেও ভাবতে পারে, কিন্তু মোটেই শত্রু ভাবে নি। যেটা উল্লেখ করেছি, শিক্ষকদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের, কিন্তু শিক্ষার্থীদেরকে এঁরা শিক্ষার্থী হিসেবেই দেখতেন। অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন যাঁরা, যেমন দর্শন বিভাগের হরিদাস ভট্টাচার্য এবং বাংলা বিভাগের মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁরা বরঞ্চ অধিক পরিচিত ছিলেন নিজেদের অসাম্প্রদায়িকতার জন্যই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন