জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিম জাতির ঘুম দীর্ঘদিনের। বলা যায়, কয়েকশ বছরের। ২০০৫ সালে বিশ্বের ১৭টি আরবি ভাষাভাষী দেশ সম্মিলিতভাবে যতগুলো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে, শুধু হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ই তার চেয়ে বেশি করেছে। পৃথিবীর মোট ১৬০ কোটি মুসলিমের মধ্যে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ী আছে মাত্র তিনজন। এরমধ্যে জীবিত আছেন শুধু তুর্কি বিজ্ঞানী আজিজ সানজার। তিনিও বাস করেন যুক্তরাষ্ট্রে।
অপরদিকে এই দুই বিজ্ঞানে বিশ্বে ইহুদি নোবেলজয়ীর সংখ্যা ৮৯। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থাভুক্ত (ওআইসি) ৫৭টি মুসলিম দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, গবেষণা ও উন্নয়নে তাদের ব্যয় জিডিপির মাত্র ০.৮১ শতাংশ। অথচ এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় জিডিপির ২.৯ শতাংশ এবং ইসরায়েলের ৪.৪ শতাংশ।
অযৌক্তিকভাবে অনেকে বলে থাকেন, বিজ্ঞানের সঙ্গে ইসলামের একটি বৈরী সম্পর্ক রয়েছে। পাকিস্তানের ইসলামাবাদে কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাদের ক্যাম্পাসে মসজিদের সংখ্যা চারটি কিন্তু কোনো বইয়ের দোকান নেই। বেশিরভাগ মুসলিম দেশেই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গবেষণামূলক জ্ঞানের চেয়ে গৎবাঁধা মুখস্ত ধারা অনুসরণ করা হয়। ২০১৩ সালে সৌদি আরব সরকারের একটি বইতেও বিশ্বাস ও যুক্তির বিরোধ দেখানো হয়েছে।
মুসলিম দেশগুলোর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই রাজনীতি ও ধর্ম নিয়ে পড়াশোনায় যতটা জোর দেয়া হচ্ছে, বিজ্ঞানে ততটা দেয়া হচ্ছে না। লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান গবেষক ও পাকিস্তানের বিখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী পারভেজ হুদভয় তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞান বিভাগে ইসলাম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে একটি কোর্স চালু করেছিলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই চুক্তি আর নবায়ন করেনি।
তবে এতকিছু সত্ত্বেও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়: প্রথমত, বিজ্ঞানে মুসলিমদের পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে। দ্বিতীয়ত, জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিমদের পিছিয়ে থাকার কারণ শুধু গোঁড়া ধর্মনেতারাই নয়; ধর্মনিরপেক্ষ (সেক্যুলার) শাসকরাও। নিজেরা নগদ অর্থ কামানোর ব্যাপারে তারা যতটা আগ্রহী, তার চেয়ে বেশি আগ্রহী স্বাধীন চিন্তা দমনে।
অথচ মুসলিমদের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে ভিন্ন চিত্র। অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে- ইউরোপ যখন ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল- সেই সময়ে মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে একের পর এক বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন বিশ্বকে চমকে দিচ্ছিল। আব্বাসীয় শাসনামলে শিক্ষাখাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। ১১ শতকে ইবনে সিনা প্রকাশ করেন চিকিৎসা শাস্ত্রের বিখ্যাত বই ‘আল কুনান ফি আল-তাবিব’। ইউরোপে কয়েকশ বছর পর্যন্ত এই বইটিকে পাঠ্য ধরে পড়ানো হতো। নবম শতকে মোহাম্মদ আল খারিজমি বীজগণিতের মূলনীতি আবিষ্কার করলেন। প্রকাশ করলেন তার বই ‘কিতাব আল-জাবর’, যার কারণে বীজগণিতকে ইংরেজিতে ‘অ্যালজেবরা’ বলা হয়। আলো ও চোখের দৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন আল-হাসান ইবনুল হাইসাম। আবু রায়হান আল বিরুনি পৃথিবীর মানচিত্র প্রথম এঁকেছিলেন। প্রাচীন গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সংরক্ষণে মুসলিমদের ভূমিকার কোনো তুলনা হয়না। মুসলিমদের সংরক্ষিত সেসব বিজ্ঞানই পরে ইউরোপে বিপ্লব ঘটিয়েছিল।
এসব উদাহরণ থেকে দেখা যায়, ইসলাম এবং বিজ্ঞান শুধু সামঞ্জস্যপূর্ণই নয়; বরং বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের দরজা খুলে দিয়েছিল ইসলাম। যেমন, রমজান বা ঈদের চাঁদ কখন দেখা গেলো- তা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন গবেষণা করতে পারেন। কুরআনের প্রথম নাজিলকৃত আয়াতেই বলা হয়েছে, ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, যারা জানে ও যারা জানে না, তারা কখনো সমান হতে পারে না। হাদিসে বলা হয়েছে, জ্ঞান মুসলিমদের হারানো সম্পদ; যেখানেই পাও তা কুড়িয়ে নাও।
২০১৩ সালে মুসলিমদের স্বর্ণযুগের ‘১০০১ উদ্ভাবন’ নিয়ে কাতারের রাজধানী দোহায় একটি প্রদর্শনী হয়। এতে দেখা যায়, গবেষণাপত্র প্রকাশের অর্থনৈতিক মূল্য নিয়ে মুসলিম শাসকরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ২০০৯ সালে চালু করা সৌদি আরবের বাদশা আবদুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার জন্য ২০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও অনেক বেশি।
ইতোমধ্যে বিদেশীরা গবেষণার জন্য সেখানে পাড়ি দিচ্ছে। অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলে সেখানকার গবেষকরা কাজ করছেন। পাশের দেশ কাতারও থেমে নেই। গবেষণায় বরাদ্দ ০.৮ শতাংশ থেকে ২.৮ শতাংশ করেছে তারা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে তুরস্ক। ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রতিবছর ১০ শতাংশ করে গবেষণা বরাদ্দ বাড়িয়েছে তারা, বর্তমানে যা নরওয়ের দ্বিগুন।
ইতোমধ্যে এর সুফলও দেখা দিয়েছে। ২০০০ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে তুরস্কে বিজ্ঞান গবেষণাপত্রের পরিমাণ পাঁচ হাজার থেকে বেড়ে ২২ হাজার হয়েছে। ইরানের ক্ষেত্রে বিপ্লব আসছে। এই সময়ে তাদেরও গবেষণাপত্রের সংখ্যা এক হাজার ৩০০ থেকে বেড়ে ১৫ হাজার হয়েছে। যদিও পরিমাণ দিয়ে মান হিসেব করা যায় না। তবে মানের দিক থেকেও এসব গবেষণাপত্র উঁচুদরের। এসব গবেষণাপত্র শুধু মুসলিম বিশ্বেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষকরা এগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে গবেষণা করছেন।
২০১১ সালে রয়টার্সের এক গবেষণায় দেখা যায়, নব্বইয়ের দশকে বিশ্বের অন্য দেশের গবেষণাপত্রের তুলনায় গবেষকরা মিসর, ইরান, জর্দান, সৌদি আরব এবং তুরস্কের গবেষণাপত্রের উদ্ধৃতি দিয়েছেন চারগুণ কম। কিন্তু ২০০৯ সালে এসে দেখা যায়, গবেষণায় প্রায় অর্ধেক উদ্ধৃতি এসব দেশের গবেষকদের থেকে দেয়া হয়েছে। গণিতে গুণগত মানের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো গবেষণাপত্র প্রকাশে ইরান অন্যতম। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে- এমন এক শতাংশ গবেষণাপত্রের মধ্যে ১.৭ শতাংশ ইরানের। এক্ষেত্রে মিসর ও সৌদি আরবও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। আর প্রকৌশল বিদ্যায় তুরস্ক এখন বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
কৃষি, চিকিৎসা, রসায়ন গবেষণা দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোতে। প্রায়োগিক বিজ্ঞানেও জোর দিচ্ছে মুসলিম দেশগুলো। সম্প্রতি জার্মানি থেকে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে পিএইচডি করে দেশে ফিরে গিয়েছেন পাকিস্তানের নাগরিক ফাজেল মোহাম্মদ খান। লাহোরের সরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন তিনি। তাকে বলা হয়েছে, ব্ল্যাক হোলের মতো উদ্ভট আইডিয়া বাদ দিয়ে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কিছু করার জন্য। এটা একটা ইতিবাচক দিক।
এছাড়া বিজ্ঞান মুসলিমদের আঞ্চলিক বিভেদও কমাচ্ছে। ২০০০ সালে মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম ‘সিসেম’ (SESAME) নামে কণাপদার্থবিজ্ঞান গবেষণার ল্যাবরেটরি করা হয় জর্দানে। ইউরোপীয় গবেষণা সংস্থা সার্নের আদলে করা হয়েছে এটি। এই গবেষণাগারে যুদ্ধকালীন সময়ে বৈরী দেশগুলোর গবেষকরা একসঙ্গে কাজ করছেন।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন