কবি আল মাহমুদের ৮১তম জন্মদিন আজ। তিনি ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যর অন্যতম কবি। বাংলা কবিতায় তিনি অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে অল্পসময়েই পাঠকনন্দিত হয়েছেন তিনি। ১৯৬৮ সালে মাত্র দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি একাধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার ভেতর দিয়ে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, থেকে শুরু করে বাঙালী নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহ তার কবিতার প্রধান উপজীব্য। বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে থেকেও কবিতায় স্বাভাবিক এবং স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তার এক অনন্য কীর্তি। তিনি গল্প-উপন্যাস-ছড়া লিখেও সাফল্যের শীর্ষ ছুঁয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো; গ্রল্পগ্রন্থ: পানকৌড়ির রক্ত, গন্ধ বণিক, সৌরভের কাছে পরাজিত; উপন্যাস : উপমহাদেশ, কাবিলের বোন এবং ছড়াগ্রন্থ: পাখির কাছে ফুলের কাছে। তিনি বাংলা একাডেমী, একুশে পদক-সহ পেয়েছেন দেশ-বিদেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। সম্প্রতি এই শব্দের কারিগর গল্পের ফাঁকে ফাঁকে তার কাব্যভাবনা নিয়ে নানান কথা বলেছেন তরুন কবি অহ নওরোজ– এর সাথে। আজ তার জন্মদিনে কথোপকথনের চুম্বক অংশ সাক্ষাৎকার হিসেবে প্রকাশ করা হল।
অহ : আপনি মাঝে মধ্যে কবিতা এবং গদ্য লিখছেন। কবিতার থেকে গদ্যে সময় লাগে বেশী। চোখের সমস্যার সাথে আপনি সময়ের তাল মেলান কিভাবে?
আল মাহমুদ : আমার মনে তো আর সমস্যা নেই। প্রায়শই অনেক কিছু ভুলে যায় কিন্তু অনুভূতি তো আর ভোলা যায়না।এই লেখাগুলো তো বাস্তবের সাথে অনুভূতির মিশেল। সে কারনে কোন গদ্য লিখতে গিয়ে কয়েকদিন লাগলেও লেখার পূর্বে আমি যখন আগেরটুকু শ্রবণ করে আমি মনে করতে পারি। চোখ না থাকলেও মনের সাপোর্টে লেখাটা হয়ে যায়।
অহ: এসব অবস্থার মধ্যে দিয়ে গিয়েও আপনি কি আসলে ভালো আছেন ?
আল মাহমুদ : ভালো তো আছি। কিন্তু শরীরের সমস্যাগুলো মাঝে মাঝে কষ্ট দেয়। কি আর করা, বয়স তো বাড়ছে। এগুলো তো মেনে নিতে হবে।
অহ : আপনার কবিতা লেখাটা শুরু হয়েছিল কিভাবে? সেই ঘটনাগুলো কি এখনো কি মনে পড়ে?
আল মাহমুদ: তা তো কিছু কিছু মনে পড়েই। আমি স্কুলে থাকা অবস্থায় কবিতা লিখতাম। এমন হয়েছে যে- স্কুলের পড়া যখন করছি তখন খাতার ভেতর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে অন্ত্যমিল করে কবিতা লিখেছি।
অহ : তাইলে তো বলা যায়, অন্ত্যমিলের প্রতি আপনার আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই।
আল মাহমুদ : সে তো বলা ই যায়। কিন্তু আমি তো শুধু অন্ত্যমিল নিয়েই পড়ে থাকিনি। আমার অধিকাংশ কবিতা বিভিন্ন ছন্দের পাশাপাশি গদ্য ছন্দেও লেখা হয়েছে।
অহ : মাহমুদ ভাই, প্রথমদিকে কার কবিতা আপনাকে প্রথমে সব-থেকে বেশী প্রভাবিত করেছিল?
আল মাহমুদ : শুরুর দিকে আমাকে অনেকে প্রভাবিত করেছেন। জীবনানন্দ দাশের কথা তো বলতেই হয়। তখন আর একজন কবি ছিলেন সমর সেন, গদ্য কবিতা লিখতেন। তার কবিতাও আমাকে ভারি টানতো। জীবনানন্দের কবিতা দিয়ে একসময় আমি প্রভাবিত হয়েছিলাম সত্যি; কিন্তু আমার কবিতাকে তো সবাই ‘আল মাহমুদের কবিতাই’ বলে। এটা আমি হয়তো পেরেছি। জীবনানন্দের কাছে শুধু আমি নই, সব বাংলাভাষীই কৃতজ্ঞ। কারণ- শুধু ‘বনলতা সেন’ই নয়, তার প্রায় সব কবিতাই অনন্য।
অহ : রবীন্দ্রনাথ মহাকাব্য লেখেন নি, কিন্তু তাই বলে কি মহাকাব্যের যুগ শেষ হয়ে গেলো ? এই সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
আল মাহমুদ : রবীন্দ্রনাথের মহাকাব্য লেখার যে সম্ভাবনা সেটি তিনি লিখলেন না, বরং বললেন- ‘আমি নাবব মহাকাব্য-/সংরচনে/ছিল মনে-/ঠেকল যখন তোমার কাঁকন-/ কিংকিণীতে,/কল্পনাটি গেল ফাটি/হাজার গীতে।’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজে মহাকাব্য লেখেননি বলে আর কেউ পারবে না এমন নয়, রবীন্দ্রনাথের লেখেনি তাই লিখবো না, বা হবে না এটা একটা ফালতু অজুহাত। আধুনিক সময়ে মহাকাব্য হতে পারে। যদি মহাকাব্য মহাকাব্যের মতো হয় তাহলে এই আধুনিক যুগেও এসে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে আমি মনে করি।
অহ : আপনার ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবর্তন নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা হয়। মূল ঘটনাটা নিজের মুখে শুনতে চাই।
আল মাহমুদ : আমি বুঝতে পারছি তুমি কোন বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছ। আসলে আমি এক সময় সমাজতন্ত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলাম সত্যি, তবে ‘কাঠ নাস্তিক’ যাকে বলে তা কখনোই ছিলাম না। গণকণ্ঠ সম্পাদনার কারণে যখন জেলে যাই তখন একটা ‘কম্পারেটিভ স্টাডির’ সুযোগ পাই। এরপর সেখান থেকে বের হয়ে সব জেনে-বুঝে সজ্ঞানে আমি ইসলামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করি। এই বিশ্বাস পরিবর্তন কারণে আমাকে গালমন্দ সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে যেটি ঠিক মনে হয়েছে আমি সেদিকে ধাবিত হয়েছি। আমার ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে কোন রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই। হতে পারে আমার এই ব্যাপারটিকে কেউ কাজে লাগাতে চেয়েছে। তবে আমাকে অস্বীকার করলেও আমার কবিতাকে তো কেউ ফেলে দিতে পারবে না। সাহিত্যের গায়ে রাজনীতির পোশাক আমি কখনো পরাইনি। আমি রাজনৈতিক লোক নই। আমাকে যারা নানান অপবাদ দেয় তাদের বোঝা উচিত আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, কি আমার অবদান, কি আমার কবিতা।
অহ: এইবার আপনার দিনযাপন প্রসঙ্গে আসি। আপনার দিন কাটান কিভাবে? নিয়ম করে প্রতিদিন কোন কিছু কি করেন?
আল মাহমুদ : সময় তো আর আমরা কাটাই না। সময় নিজেই কেটে পড়ে। সময় আমাদেরকে ফাঁকি দেয়। আমরা তার ফাঁকে পড়ে যাই।
অহ : এই কেটে পড়া সময়ের কাছে আর কিছু চাওয়ার আছে?
আল মাহমুদ : মূলত আমি একজন কবি। এই জীবনে যা চেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি। একজন প্রকৃত কবির তো পদক পুরস্কার এগুলো চাওয়া থাকে না। সে চায় তার পাঠক তাকে গ্রহণ করুক। তার সৃষ্টিকে ভালোবাসুক। তার কবিতা চর্চা করুক। কবিদের কাজ জাতিকে স্বপ্ন দেখানো।
অহ : যেহেতু বললেন মূলত আপনি একজন কবি, সেক্ষেত্রে আপনি সচেতনভাবেই কি আপনার কবিসত্ত্বা থেকে আপনার অন্য সত্ত্বাগুলোকে কম করে দেখছেন?
আল মাহমুদ : সেটা না। আমি আমার সকল সত্ত্বাকে পছন্দ করি। কিন্তু নিজেকে কবি ভাবতে সবথেকে বেশী পছন্দ করি। কবিদের কাছ থেকে মানুষ সবথেকে বেশী আশাবাদী হতে শিখে।
অহ : আপনার বিভিন্ন কবিতায় নারীকে বিভিন্নভাবে এঁকেছেন। কিন্তু নারীকে আপনি মূলত কিভাবে দেখেন?
আল মাহমুদ: নারীর তো বিবিধ রূপ আছে , যেমন পুরুষেরও আছে। নারী কখনো মা, কখনো স্ত্রী, কখনো বোন। আবার নারী তো প্রেমিকাও তাইনা? তবে আমার কবিতায় বেশিরভাগ সময়ে কবিতায় আমি নারীকে মা এবং প্রেমিকা এই দুইরূপে বেশী এঁকেছি। আমি নারীকে আমার কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ বলে মনে করেছি। আমার মনে হয় নারীকে উপেক্ষা করে কবিতা লেখাটা প্রায় অসম্ভব।
অহ : বর্তমানে দেখা যাচ্ছে হাতেগোনা গুটিকয়েক তরুন ছাড়া বাকি সকল তরুন লিখছেন গদ্য ছন্দে। অনেকে ছন্দও ভালোভাবে জানেন না। আপনি কি মনে করেন তারা পিছিয়ে আছে?
আল মাহমুদ : কে পিছিয়ে আছে, কে এগিয়ে আছে বলা মুশকিল। কারন এটা একমাত্র বিচার করে সময়। তবে আপাত দৃষ্টিতে আমার মনে হয় যারা ছন্দ না জেনেই কবিতা লিখতে আসছে তারা কাজটা ঠিক করছে না। তুমি নিজে কবিতা লেখো তুমিও বুঝবে- কবিতা যে যেভাবে লিখুক না কেন সেটা তার বিষয় কিন্তু কবিতা লিখতে আসলে তার অগ্রজরা আগে কিভাবে লিখে গিয়েছে সেটা জানাটা প্রয়োজন। তারা কি কি ছন্দ তৈরি করেছে, কবিতার দিনবদল কিভাবে ঘটেছে এগুলো জানা উচিত বলে আমি মনে করি। এগুলো যতবেশি জানা থাকে তত নতুন কি সৃষ্টি তার জন্য সহজ হয়ে ওঠে। কারন কবিতায় নতুন কিছু তৈরি করতে গেলে পুরাতন সবকিছু জানতে হয় এবং সচেতনভাবেই সেগুলোকে এড়িয়ে নিজের বলয় তৈরি করতে হয়।
অহ : নিজের কবিতার দিকে তাকিয়ে আপনার কি মনে হয়। আপনি কি আপনার অগ্রজদের ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন?
আল মাহমুদ : সেটা সহজ কাজ নয়। তবে আমি সবসময়ই চেয়েছি আলাদাভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে। কতটুকু পেরেছি সেটা সময় বলতে পারবে। আমি যখন থাকবো না তখন আমার কবিতা যদি থেকে যায় তাহলে মনে করতে হবে আমার নিজস্বতা আছে বলেই আমি টিকে আছি।
অহ : অনেক সময় এমন হয় লেখকরা চিন্তা করেন দিনের পর দিন, কিন্তু কিছু লিখতে পারেন না। এই সময়টাকে আপনি কিভাবে ব্যখ্যা করেন?
আল মাহমুদ: আমার মনে হয় একটা ভালো লেখার পর এমনটি বেশী হয়, আবার অমনোযোগের কারনেও কিংবা চিন্তার ট্রাক চেঞ্জ হলেও এমন হয়। একে অনেকে রাইটার্স ব্লক বলে। আমি মনে করি এটাও একজন দরকার। নতুন একটা সুন্দর লেখার জন্য লেখকে তৈরি করার সুযোগ তৈরি করে দিতে সম্ভবত এটা হয়।
অহ : মাহমুদ ভাই, তরুণদের উদ্দেশে কিছু বলার আছে? একজন অনুজ কবি হিসেবে আমি যদি আপনার কাছে পরামর্শ চাই তাইলে কোন পরামর্শগুলো আমাকে দেবেন?
আল মাহমুদ : আমি তোমাকে বলবো তুমি বেশী বেশী পড়বে। পড়তে থাকলেই নিজেকে আবিষ্কার করতে শিখে যাবে। আরেকটা বিষয় খেয়াল রাখবে সেটা হল সচেতন ভাবে মনে রাখা যে সবকিছুকে পর্যবেক্ষণের চোখে দেখা কবিদের জন্য জরুরী। সাথে সাথে চিন্তা করা।
অহ : বিভিন্ন পত্রপত্রিকার জন্য লেখা ছাড়া আপনি কিছু কি লিখছেন ? মানে নতুন কোন বই?
আল মাহমুদ : একটা উপন্যাস লিখছি।
অহ : কোন নাম রেখেছেন এখনো ?
আল মাহমুদ : এখন বলা যাবেনা। আজ তুমি যাও। আজ আমার শরীরটা বেশী ভালো না। অনেক কথা বলে ফেলেছি। গল্পটা শেষ করতে হবে। কাল বিকেলের দিকে একটু এসো।
অহ : ঠিক আছে মাহমুদ ভাই । আমি আজ আসি তাহলে। ভালো থাকবেন।
আল মাহমুদ : আচ্ছা।
***
ছবিতে : আল মাহমুদের সাথে কবি অহ নওরোজ।
ছবি : রাসেল আবেদীন তাজ
***
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন