অ্যাসিড হামলার শিকার সুমি (ছন্দনাম) চোখের দৃষ্টি খুইয়েছেন। ঘরে-বাইরে তিনি অবজ্ঞার পাত্র। সিলেটের অধিবাসী সুমি জানান, অ্যাসিডে ক্ষতিগ্রস্ত মুখায়ব ও শরীর নিয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছি।
১৩ বছর ধরে আমার পোড়া শরীরের জ্বালা-যন্ত্রণা মোটেই কমছে না। হামলাকারীর চূড়ান্ত বিচারও পাইনি। আর সিরাজগঞ্জের স্বপ্না (ছদ্মনাম) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ২০০৮ সালে অ্যাসিড দিয়ে আমার শরীরের প্রায় অর্ধেক জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। হামলাকারীর ফাঁসি হয়নি। এমন ঘটনা শুধু সুমি বা স্বপ্নার ক্ষেত্রে ঘটেছে তা নয়।
সারা দেশে অ্যাসিড হামলাকারী ১৪ আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও কার্যকর করা হয়নি। মাত্র ৯ শতাংশ মামলায় অপরাধীদের সাজা হয়েছে। আর নির্যাতিতাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার হার খুব নগণ্য। আক্রান্তদের মাত্র ২ শতাংশ ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। সামাজিক সহায়তার ছবিটা মোটেও উজ্জ্বল নয়। বরং আক্রান্তরা সর্বস্তরে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে।
অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন-২০০২ অনুযায়ী-৯০ কর্মদিবসের মধ্যে মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ করার কথা। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, মাত্র ৯ শতাংশ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির সাজা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও একটিও কার্যকর হয়নি।
আইন অনুযায়ী-হামলার শিকার নারীর ৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। কিন্তু ক্ষতিপূরণ পাওয়ার হার মাত্র ২ শতাংশ। অ্যাসিড হামলার শিকার অনেক পরিবার চিকিৎসা-ব্যয় মেটাতে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে, অনেকে পরিবার আবার নিঃস্ব হওয়ার পথে।
জানা গেছে, দুই দশক আগে দেশে অ্যাসিড সন্ত্রাস ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছিল। ওই সময় প্রতিদিন ২-৩ জন অ্যাসিড হামলার শিকার হতো। আন্দোলন, সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন এবং আইনের কড়াকড়িতে অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা কমতে শুরু করে। তবে তা থেমে নেই। বর্তমানেও বর্বর-নিষ্ঠুর অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে।
নারী-শিশুসহ বিভিন্ন বয়সি মানুষ এর শিকার হচ্ছে। গত বছরও ৩৯ জন অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছেন। ১৯৯৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৪ হাজার ২৫০ ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ৩ হাজার ৯০০ জন আক্রান্ত হন। আক্রান্তদের মধ্যে ৯৯ শতাংশই নারী। আক্রান্তদের বেশিরভাগের বয়স ১৩ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। ২০২০ সালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজন মারা গেছেন।
এছাড়া ২০২১ সালে ১৫ জন এবং ২০২২ সালে ১৮ জন অ্যাসিড হামলার শিকার হন। তাদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী। এদিকে, ৪-৫ বছর ধরে পুরুষরাও অ্যাসিড হামলার শিকার হচ্ছেন।
অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) নির্বাহী পরিচালক সরদার জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, বর্তমানে অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা কমলেও বছরে ১৮টি থেকে ২০টি ঘটনা ঘটছে। এ সব ঘটনায় ২০-২৫ জন আক্রান্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, অ্যাসিড হামলার শিকার নারীর যন্ত্রণা পাহাড়সম। যিনি আক্রান্ত হন শুধু তিনিই যন্ত্রণাটা বোঝেন। এক যুগ পেরিয়ে গেলেও হামলার শিকার কোনো কোনো নারী কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাননি।
তিনি বলেন, বিভিন্ন ক্লাব-সমিতি, ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়নে সরকার তো বরাদ্দ দেয়। কিন্তু অ্যাসিড ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসায় তেমন কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয় না। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চিকিৎসা করাতে হয় বলে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে, অনেকে হচ্ছে। আইন অনুযায়ী-৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের কথা রয়েছে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ প্রদানের হার মাত্র ২ শতাংশ।
জাহাঙ্গীর হোসেন আরও জানান, তার সংস্থা এএসএফের মাধ্যমে আক্রান্তদের চিকিৎসা এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হতো। বর্তমানে সংস্থাটি প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিদেশি বেশ কয়েকটি দেশের সহায়তায় রাজধানীর মিরপুরে এএসএফ কার্যক্রম চালায়। তিন বছর ধরে কোনো দেশ থেকেই কোনো ফান্ড আসছে না। বাংলাদেশ সরকার অথবা দেশীয় কোনো সংস্থা অর্থ দিচ্ছে না। রাজধানীর আদাবরে শুধু আমরা কার্যক্রম পরিচালনা করছি।
তিনি বলেন, চিকিৎসা নিতে আক্রান্তরা প্রতিনিয়ত আমাদের কাছে আসছেন। কিন্তু অর্থের অভাবে আমরা সেবা দিতে পারছি না। চিকিৎসার ফলোআপ বন্ধ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে জাকাতের জন্য আহ্বান করছি। তিনি বলেন, একেকজন আক্রান্ত ব্যক্তির পুরো চিকিৎসায় ২৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
২০২২ সাল পর্যন্ত দেড় হাজারেরও বেশি নারী ও শিশু অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায় ৭০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনা অনুযায়ী বিচার সন্তোষজনক নয়। আইনজ্ঞরা জানান, অ্যাসিড সন্ত্রাস কমলেও বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। অ্যাসিড মামলা তদারক করার জন্য গঠিত জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের তিন মাস পরপর বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও তা যথাযথ হচ্ছে না।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন যুগান্তরকে বলেন, ১৯৮৬ সাল থেকে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার মানুষদের নিয়ে কাজ করছি। এক সময় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল খুব উদ্বেগজনক, এখন অনেকটা কমে এসেছে। তিনি আরও বলেন, অ্যাসিড আক্রান্তদের চিকিৎসায় বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন