বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর এলাকায় সৃষ্ট সুস্পষ্ট লঘুচাপটি আরও ঘণীভূত হয়ে নিম্নচাপ থেকে সন্ধ্যা ছয়টায় গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে।
এ গভীর নিম্নচাপটি আরো পশ্চিম – উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগর এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় এখন অবস্থান করছে।
এর ধারাবাহিকতায় আগামীকাল বুধবার নাগাদ এটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, “কাল আমরা সাইক্লোন ডিক্লেয়ার (ঘূর্ণিঝড় ঘোষণা) করবো।”
‘দানা’ কখন আঘাত হানতে পারে ?
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর এই নিম্নচাপ সম্বন্ধে একটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি (ক্রমিক নম্বর - এক) দিয়েছে। সেখানে নিম্নচাপের বর্তমান অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে।
তাতে বলা হয়েছে, পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও এ সংলগ্ন উত্তর আন্দামান সাগর এলাকায় অবস্থানরত সুষ্পষ্ট লঘুচাপটি পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘণীভূত হয়ে একই এলাকায় নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে।
এটি আরো পশ্চিম- উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘণীভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিলে তা কবে নাগাদ আঘাত হানতে পারে জানতে চাইলে মি. হোসেন বলেন, “কাল তো সাইক্লোনটা ফর্ম করবে। আঘাত হানতে পারে পরশু, মানে ২৪ তারিখ। এটি সিভিয়ার সাইক্লোন হতে পারে।”
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় যখন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করবে তখন এই ঘূর্ণিঝড়ের “ গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার”।
এদিকে, এই নিম্নচাপ সম্বন্ধে আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে (ক্রমিক নম্বর - এক) বলা হয়েছে, এটি সকাল ছয়টায় এটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৮৫ কিলোমিটার ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৭০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে এবং মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ৮২০ কিলোমিটার ও পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্বে অবস্থান করছিলো।
নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৪ কিলোমিটারের মাঝে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ঘন্টায় ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নিম্নচাপ কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল থাকায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে এক নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
সেই সাথে, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে, যাতে স্বল্প সময়ের নোটিশে নিরাপদ আশ্রয় যেতে পারে।
পূর্বাভাসের বিজ্ঞপ্তিতে অধিদপ্তর জানিয়েছে, বুধবার খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় হালকা থেকে মাঝারী ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
সেই সাথে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস
ভারতের আবহাওয়া বিভাগের মঙ্গলবারের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে এই ঘূর্ণিঝড় প্রভাব ফেলতে পারে।
এই নিম্নচাপটি এখন ওড়িশ্যার প্যারাদ্বীপের ৭০০ কিমি দক্ষিণপূর্বে, পশ্চিমবঙ্গের সাগর দ্বীপের ৭৫০ কিমি এবং বাংলাদেশের খেপুপাড়ার ৭৩০ কিমি দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্বে এটি অবস্থান করছে।
২৩শে অক্টোবর পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে বঙ্গোপসাগরের কাছে এটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেবে।
পূর্বাভাসে ভারত বলছে, ২৪শে অক্টোবর সকালের মধ্যে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
একইসাথে উত্তর ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ উপকূল অতিক্রম করার সময় পুরী এবং সাগর দ্বীপের মধ্যে ২৪শে অক্টোবর রাত ও ২৫শে অক্টোবর ভোরের মধ্যে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে।
এ সময় বাতাসের গতিবেগ থাকবে প্রতি ঘন্টায় ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার, দমকা হাওয়া থাকবে ১২০ কিলোমিটার।
যেভাবে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ নামকরণ
এবারের ঘূর্ণিঝড়ের নাম রাখা হয়েছে ‘দানা’। আর এ নামকরণ করেছে কাতার।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এটি আরবি শব্দ। কাতারের দেয়া নাম। অর্থ বড় মুক্তার দানা”।
বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলির নামকরণ করে একটি প্যানেল। এ অঞ্চলে যে ঘূর্ণিঝড়গুলো হয়, ২০০২ সাল থেকে এ প্যানেলের সদস্য দেশগুলো সেগুলোর নামকরণ করে থাকে।
প্রতি চার বছর পর পর সদস্য দেশগুলো বৈঠক করে আগে থেকেই পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে থাকে।
মি. মল্লিক বলেন, “ ইকোনোমিক এন্ড স্যোশাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্যা প্যাসিফিক প্যানেলের অন্তর্ভুক্ত সদস্য দেশগুলো এই অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের আগাম নামকরণ করে থাকে। এই নামকরণই দেশের নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী যেখানে ঘূর্ণিঝড় হয় সেখানে সে নামেই এটি পরিচিত হয়”।
এই তালিকায় রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ইরান, কাতার, ইয়েমেন, ওমান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।
অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা কেমন?
বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় প্রবণতার দুটি মৌসুম রয়েছে বলে জানান আবহাওয়াবিদরা। এ মৌসুম দুটির একটি ‘প্রি মুনসুন’ এর আওতায় মার্চ, এপ্রিল, মে এই তিন মাস অন্তর্ভুক্ত।
আরেকটি ‘পোস্ট মুনসুন’ অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর এ তিন মাস এই মৌসুমের অন্তর্ভুক্ত।
মি. মল্লিক জানান “অক্টোবর মাস ঘূর্ণিঝড় প্রবণ মাস। ১৮৯১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শুধু ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে ৫১ টি। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে ৪৩ টি”।
মোট ৯৪টি ঘূর্ণিঝড় এ সময়ে তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করেছে বলে জানান মি. মল্লিক।
“ গতবছর ২১ থেকে ২৫শে অক্টোবরের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ হয়েছে। এটা চট্টগ্রামে উপকূলের দক্ষিণ দিয়ে অতিক্রম করেছে। এর আগের বছর চিত্রা ঘূর্ণিঝড় এ মাসেই তৈরি হয়েছিল,” জানান মি. মল্লিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন