শীতের শেষে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে মশার উপদ্রব। দিনে মশার উৎপাত কিছুটা কম থাকলেও সন্ধ্যা নামলেই টিকে থাকা দায়। ভুক্তভোগীরা বলছে, অফিস, বাসাবাড়ি বা দোকান, কোথাও স্বস্তি নেই।
ঢাকায় চার মাসে মশা বেড়ে দ্বিগুণগত নভেম্বরের তুলনায় ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় মশার ঘনত্ব বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।
সম্প্রতি এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। সবচেয়ে বেশি মশার ঘনত্ব মিলছে উত্তরা ও দক্ষিণখান এলাকায়। মশার ফাঁদ পেতে এই গবেষণা চালানো হচ্ছে। এতে ৯৯ শতাংশ ধরা পড়ছে কিউলেক্স মশা।
বাকি ১ শতাংশ এডিস, এনোফিলিস, আর্মিজেরিস, ম্যানসোনিয়া। ঢাকা দক্ষিণ সিটির যাত্রাবাড়ী, উত্তর সিটির দক্ষিণখান, উত্তরার দুটি স্থান ও মিরপুর এবং ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মশা পর্যবেক্ষণ করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একটি গবেষকদল। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ওই বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার।
গবেষণায় দেখা গেছে, নভেম্বর মাসে গড়ে ২০০টি করে মশা ধরা পড়ত সব ফাঁদে।
ডিসেম্বরেও গড় সংখ্যা মোটামুটি একই থাকে। তবে জানুয়ারি থেকে এই সংখ্যা ৩০০ হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারিতে ৩৮৮ ও চলতি মার্চে এ সংখ্যা ৪২০টিতে ঠেকেছে।
অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মশার ঘনত্ব জানতে মূলত এই গবেষণা। এর আগে পূর্বাভাসে আমরা বলেছিলাম মার্চে চরমে পৌঁছাতে পারে।
সেই পূর্বাভাস সত্যি হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে প্রতি ফাঁদে মিলছে ৪২০টি মশা। সবচেয়ে বেশি মশা পাওয়া যাচ্ছে উত্তরা ও দক্ষিণখান এলাকায়। গড়ে ৫০০ মশা ধরা পড়েছে।’
কবিরুল বাশার বলেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশার খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই ১৪টি প্রজাতির মশা পাওয়া যায়। এই মশা সাধারণত পচা পানিতে হয়।
তিনি বলেন, মশা যে শুধু ঢাকায় বাড়ছে তা নয়। সারা দেশে কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেড়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ঝড়-বৃষ্টি না হয়, কিউলেক্স মশার উপদ্রব বাড়তে থাকবে।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে ‘কিউলেক্স মশা প্রজননের ভয়াবহ রূপ ধারণের পূর্বাভাস’ দিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কালের কণ্ঠসহ কয়েকটি সংবাদপত্র ও টেলিভিশন। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশন তা আমলে নেয়নি।
সবচেয়ে ঝুঁকিতে শিশু আর বয়স্করা
চাকরিজীবী তরিকুল ইসলাম থাকেন রাজধানীর মেরুল বাড্ডায়। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তিনি চিন্তিত। তরিকুল ইসলাম জানান, ঘরের মধ্যে স্প্রে ছড়িয়ে ছুটে যান বাসার ছাদে। অন্তত ঘণ্টাখানেক সেখানেই থাকেন। অপেক্ষায় থাকেন মশা কখন মরবে। কিন্তু তাঁর স্বস্তি ফেরে না। কারণ ওই স্প্রেতে কোনো কাজ হয় না। ফলে নিরুপায় হয়ে মশারি টানিয়েই থাকেন তিনি।
তরিকুল বলেন, ‘কী বলব আর মশা নিয়ে? অনেক যন্ত্রণায় আছি। ঘরে ফিরলেই মশারির মধ্যে ঢুকতে হয়। বাইরে থাকতে পারি না। বাচ্চারা সারাক্ষণ মশারির ভেতরে থাকে।’
রাজধানীর আগারগাঁও তালতলার বাসিন্দা কামাল মিয়া। স্থানীয় দোকান থেকে কিনছিলেন মশার কয়েল। এ সময় উপস্থিত অন্যদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন তিনি। আলোচনার প্রধান বিষয় ‘মশার যন্ত্রণা’। এ সময় পাশ থেকে একজন বলেন, ‘আগে দোকানে বইসা এক কাপ চা খাইতাম, গল্প করতাম। এখন মশার জ্বালায় দাঁড়ানো যায় না। সবার কথায় একটা বিষয় উঠে আসে, হঠাৎই বেড়েছে মশার উপদ্রব, কোনোভাবেই এ থেকে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না।
কামাল মিয়া বলেন, ‘সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় মশার জ্বালাতন, চলে সারা রাত। সিটি করপোরেশনের নানা উদ্যোগের কথা শুনি। মশা কমতে দেখি না।’
মিরপুর ১২ নম্বরে থাকেন মোহাম্মদ শরীফ। তিনি বলেন, ‘মশারির বাইরে এক মিনিট থাকার উপায় নেই। মশা থেকে বাঁচতে বাজার থেকে স্প্রে, কয়েল, অ্যারোসল নিয়েছি। তবে কোনো কিছুতেই মশা তাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। সন্ধ্যা হলে ঝাঁক বেঁধে মশা ঘরে ঢোকে। বাধ্য হয়ে আমার স্ত্রী বাচ্চা দুটিকে নিয়ে মশারির ভেতরে থাকে।’
বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সব এলাকার চিত্র একই রকম। সড়ক থেকে ঘর, স্টেশন থেকে গণপরিবহন সর্বত্র মশার উপদ্রব।
দুই সিটির কর্তৃপক্ষ যা বলছে
ঢাকা দক্ষিণের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মার্চে মশা বেড়ে গেছে আমি এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত না। মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা সম্পূর্ণ সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছি এবং আমাদের কার্যক্রম সঠিক আছে।’
ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখতে পেয়েছি, বিগত বছরের তুলনায় কিউলেক্স মশা এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। জনগণের পক্ষ থেকে আমাদের কাছে তেমন কোনো অভিযোগ নেই। বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি এলাকা থেকে অভিযোগ এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে সেসব এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি। সব মিলিয়ে আমরা কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি।’
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি, এটা বলব না। এখানে অনেক কারণ জড়িত। বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার বাধা। তবে আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। দূষিত ও বদ্ধ জলাশয়গুলো পরিষ্কার, খাল পরিষ্কার, কচুরিপানা দূর করা, নিয়মিত দুই বেলা ওষুধ ছিটানো—সেগুলো করেছি।’
প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, উত্তরে রাজউকের অনেক খাল-সরকারি জমি রয়েছে, পিডাব্লিউডির জমি আছে। এ ছাড়া রেলওয়ে, মেট্রো রেল আছে, যেখানে সিটি করপোরেশনের কোনো অনুমতি নেই। এর বাইরে নাগরিকদেরও সম্পৃক্ত করার অভাব রয়েছে। বিশেষ করে বড় বড় ভবনের মাঝখানে যেসব জায়গা থাকে, সেখানে ময়লা জমে নিচতলার জানালার কার্নিশ পর্যন্ত চলে আসে, তবু বাড়ির মালিকরা পরিষ্কার করেন না। বাড়ির বেইসমেন্টে বিভিন্ন চৌবাচ্চায় পানি জমে মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের লোকজনকে বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি দেন না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন