মুক্তিযুদ্ধের আগে ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তবে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে তিনি ছিলেন একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। বলেছিলাম অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের কথা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ১৩তম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭১ সালের ১৯ জুলাই তিনি নিয়োগ পান, পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। যদিও বর্তমানে উপাচার্য হিসেবে ঢাবির কোনো নথিপত্রে তার নাম বা ছবি ব্যবহার করা হয় না।
এর আগে অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন ১৯৬৯ সালের ৫ আগস্ট থেকে ঢাবিতে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত অথাৎ ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) চতুর্থ উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যদিও বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্রে উপাচার্যের তালিকায় রয়েছে তার নাম ও ছবি।
জানা যায়, অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন মুক্তিযুদ্ধের সময় দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য দায়িত্ব পালনকালে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করেছিলেন। রাজাকার, আলবদর বাহিনীর অঘোষিত উপদেষ্টার ভূমিকায় ছিলেন তিনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যা, খুন, ধর্ষণের ঘটনাগুলো তিনি গোপন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে।
অন্যদের গোপন রাখার জন্য চাপ দিয়েছিলেন বা প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছিলেন। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে তার কাছে অভিযোগ গেলে তিনি কোনো প্রতিকার করেননি। পাকিস্তানি সেনাদের পশুত্ব যেন বাইরে প্রকাশ না পায়, সে জন্য তিনি সদা ব্যস্ত ছিলেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী হত্যা ধর্ষণের ঘটনাগুলো সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের মদদেই হয়েছে। নাজিম মাহমুদ ‘যখন ক্রীতদাস: স্মৃতি ৭১’ গ্রন্থে লিখেছেন, আমাকে আড়ালে ডেকে ড. হোসেন বললেন ‘ইউ আর দ্য থার্ড ম্যান টু নো ইট’ এরপর নাজিম মাহমুদকে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনকে আরও বলেন, ‘যদি তুমি কোথাও ফাঁস করো, আমাদের জওয়ানেরা এই সব করে বেড়াচ্ছে, তাহলে তোমাকে কিন্তু বাঁচাতে পারবো না। সাবধান।
১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারী অভিযোগ করেছিলেন যে, পাকিস্তানি সেনারা তার স্ত্রী ও কিশোরী মেয়েকে ক্যাম্পাসে ধর্ষণ করেছে! ওই সময় উপাচার্যের কার্যালয়ে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা নাজিব মাহমুদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকিস্তানি সেনাদের নারকীয়তা গোপন করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন। নাজিব মাহমুদ লিখেছেন, ‘নয়ই নভেম্বর মঙ্গলবার রাতে চল্লিশ জন জওয়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে ঢুকে যে নারকীয় দৃশ্য রচনা করে, তাও ভাইস চ্যান্সেলরকে হজম করতে হয়। পরদিন দুপুরে আই.জি. চিফ সেক্রেটারি, হোম সেক্রেটারির সঙ্গে মেয়েদের হল ঘুরে ফিরে দেখলেন ভাইস চ্যান্সেলর, তারপর তিনি বললেন, সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীরা রোকেয়া হলে ঢুকেছিল। কিন্তু কারা এই দুষ্কৃতকারী সে কথা স্পষ্ট উচ্চার তিনি করতে পারলেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় তার নাম নেই কেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ও উপাচার্যের তালিকা অনুসারে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৬৯ সালের ২ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তার পদত্যাগের পরে পাকিস্তানি সামরিক সরকার অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনকে নিয়োগ দিলেও, এই নিয়োগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বীকৃতি দেয়নি।
ঢাবি ভিসি কার্যালয়ে উপাচার্যের তালিকায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পর অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের ছবি নেই
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগেই ইউরোপে ছিলেন। ২৫ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো দেশে পাকিস্তানি সেনারা একযোগে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে তিনি স্বাধীনের আগে আর দেশে ফেরেননি। বিলেতে থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য কাজ করেছেন। বিশ্ব জনমত গঠনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরির ভূমিকা বাঙালি চিরকাল স্মরণ করবে
জানা যায়, আবু সাঈদ ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। একাত্তরের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভা যান। সেখানে জেনেভার একটি পত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্রের মৃত্যু সংবাদ দেখে বিচলিত হয়ে ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শিক্ষা সচিবকে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেরিত এক পত্রে লেখেন, “আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম”। এরপর মুজিবনগর সরকার তাকে প্রবাসী সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়।
মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দ সাজ্জাদের ভূমিকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আশা ইসলাম নাঈম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন। এজন্য তাকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি পাকিস্তানের একাত্মতা রক্ষার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বিপক্ষে ছিলেন।
সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন তার লেখা “একাত্তরের স্মৃতি” বইয়ে বলেছেন, তিনি বৃহত্তর পাকিস্তানের কাঠামোতে সমস্যার সমাধান চেয়েছিলেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ঐক্যের পক্ষে ছিলেন।
জানা গেছে, ১৯৯০ সাল থেকে সৈয়দ সাজ্জাদের নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো তালিকায় দেখা যায়নি। তার ছবি উপাচার্য অফিসে রাখা ছবিগুলোর মধ্যেও নেই।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো তার নাম রয়ে গেছে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এখনো উপাচার্যদের তালিকায় অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের নাম আছে। তালিকায় অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন চার নম্বরে রয়েছেন। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অফিসের অনার বোর্ডেও তার নাম সংযুক্ত রয়েছে বলে জানা গেছে।
রাবির ওয়েবসাইটে চতুর্থ উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের নাম রয়েছে
জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও ২৫তম উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, তালিকায় অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের নাম আছে। উনাকে নিয়ে তর্ক-বির্তক থাকতে পারে। ইতিহাসের অংশ হিসেবে উনার নাম থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন