৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সেপ্টেম্বরের শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) উপাচার্য নিয়োগ করা হয়। নিয়োগের পরপরই নানা বিতর্ক দেখা যায় উপাচার্যকে নিয়ে। সর্বশেষ গত ২৬ নভেম্বর ববির ট্রেজারার নিয়োগ দেওয়া বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক বিতর্কিত রেজিস্ট্রার আবু হেনা মোস্তফা কামাল খানকে। যিনি যোগদান করলেও শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারেননি। এর মাঝে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রাহাত হোসাইন ফয়সাল।
এসব ঘটনায় উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয়টি। সর্বশেষ আজ বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) দুপুরে উপাচার্যের কার্যালয়ে তালা মেরে সিলগালা করে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে তার কক্ষের সামনের নামফলক খুলে ফেলা হয়েছে।
নানা বিতর্কে উপাচার্য
২৬ সেপ্টেম্বর ববিতে যোগদানের পরই নানা ইস্যুতে প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচীতা শরমিন। তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিরোধী দল বানচালের ষড়যন্ত্র করছে’, এমন দাবি করে গত বছরের ২৩ নভেম্বর ৩৫০ বিশিষ্ট নাগরিক ও শিক্ষক যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেখানে ড. শুচীতা শরমিনের নাম ছিল ১০৮ নম্বরে।
এদিকে, সম্প্রতি বেরোবির সাবেক বিতর্কিত উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে ববির শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের পূর্বতন চাকরিকাল গণনা-সংক্রান্ত কমিটি, কাউন্সিলের সদস্য এবং পরীক্ষা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা অধ্যাপক কলিমুল্লাহকে ববির সকল পদ ও কর্মকাণ্ড থেকে অনতিবিলম্বে অব্যাহতি ও ক্যাম্পাসে প্রবেশে অনুমতি না দিতে আবেদন করেছেন। বিভিন্ন কমিটি থেকে অধ্যাপক কলিমউল্লাহ বাদ দিতে তিনদিনের আলটিমেটামও দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে লোকপ্রশাসন বিভাগের পরীক্ষা কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে অধ্যাপক কলিমউল্লাহকে। বাকি দুটি কমিটিতে এখনো বহাল রয়েছেন কলিমউল্লাহ।
জানা গেছে, বেরোবির উপাচার্য থাকাকালে অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। আওয়ামী সরকারের পাতানো নির্বাচনকে বৈধতা দিতে কলিমউল্লাহর জানিপপ প্রথম সারিতে থেকে কাজ করেছে। অভিযোগ রয়েছে, ববি উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন এর সাথে রয়েছে তার বেশ সখ্যতা।
গত ৪ নভেম্বর ববি রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে সামজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন নিয়োগ দেওয়া হয় অর্থনীতি বিভাগের এক শিক্ষককে। একই দিনে এই অফিস আদেশটি বাতিল করে দায়িত্ব দেওয়া হয় লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ইসরাত জাহানকে, যিনি সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে হলের প্রভোস্টের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী,অনুষদের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হবেন ডিন,তাই ডিনের দায়িত্ব পাওয়ার কথা সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক সহযোগী অধ্যাপকের।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রয়োজনীয় ফাইলে যথাসময়ে স্বাক্ষর করেন না ববি উপাচার্য। ফলে একাডেমিক,দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।শিক্ষার্থীদের সাথে অসদাচরণ করায় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির ইস্যু ক্লার্ক বনি আমিনের নামে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।অফিসে না এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষরও করতেন বনি আমিন, যা নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লিখিত দিয়েছে লাইব্রেরি প্রশাসন।জানা যায়, ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য কলিমু্লাহর সুপারিশ করিয়েছেন বনি আমিন।তাই দুই মাস হয়ে গেলেও সেই ফাইল আটকে রেখেছেন উপাচার্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেডিকেলের সেন্টারের ঔষধ কেনার ফাইলে উপাচার্য স্বাক্ষর না দেওয়ায় ঔষধ ছাড়াই চলছে মেডিকেল। ফাইলে নিয়মিত স্বাক্ষর না করায় চরম অসন্তোষ দেখা যায় শিক্ষার্থীদের মাঝে।
এদিকে, গত ১৩ নভেম্বর, বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসনই বিভাগের অফিসিয়াল প্যাডে শেখ হাসিনা সরকার স্লোগান দেখা যায়। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।উপাচার্য নিয়োগের দুই মাস হয়ে গেলেও দৃশ্যমান কোন কাজ দেখতে না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করছেন শিক্ষার্থীরা।
গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে ববিতে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজনের বক্তব্যে, আন্দোলনে শহীদ বা আহতদের কথা স্মরণ না করায় তীব্র ক্ষোভ দেখা যায় শিক্ষার্থীদের মাঝে। সর্বশেষ, গতকাল রাত ৩ টায় সহকারী রেজিস্ট্রার কে তুলে নিয়ে গিয়ে নিয়মবহির্ভূত দায়িত্ব বণ্টন পত্রে স্বাক্ষর করানোর অভিযোগ ওঠে।
বিতর্কিত ট্রেজারার নিয়োগ
গত মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পরেন নবযুক্ত ট্রেজারার শিক্ষার্থীরা তাকে ড. কলিমুল্লাহর দোসর হিসেবে চিহ্নিত করে ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাধা দেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা ট্রেজারার বিপক্ষে মিছিল করেন এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার হিসেবে থাকাকালীন দুর্নীতিতে তিনি যে জড়িয়ে পরেন তা তুলে ধরেন। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ ক্যাম্পাস থেকে গিয়ে বরিশাল সার্কিট হাউজে থাকেন।
যোগদান করতে আসা নতুন নিয়োগ পাওয়া কোষাধ্যক্ষ কর্নেল (অব.) আবু হেনা মোস্তফা কামাল খানকে স্বৈরাচারের দোসর’ আখ্যা দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে বাধ্য করেন শিক্ষার্থীরা। কোষাধ্যক্ষকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের একটি পক্ষ। তার নিয়োগের প্রতিবাদে ও উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে গতকাল বুধবার (২৭ নভেম্বর) ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ হয়।
শিক্ষার্থীরা জানান, এমন দুর্নীতিগ্রস্ত, আওয়ামী লীগের ‘দোসর’ হিসেবে অভিহিত এবং এভাবে ফ্যাসিবাদের দোসরদের পদে পদে পুনর্বাসনের ফলে আতঙ্কিত ও নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে আমরা শঙ্কিত। আমরা শিক্ষার্থীরা সবসময় সৎ,যোগ্য এবং গণঅভ্যুত্থানের স্প্রিট ধারণকারী ব্যক্তিদের প্রশাসনিক দায়িত্বে চাই,স্বৈরাচারের কোনো প্রকার দোসরদের উক্ত পদে দেখতে চাই না।
উপাচার্যের কার্যালয়ে তালা
আজ বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) দুপুর ২টায় উপাচার্যের কার্যালয়ে তালা দেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে গতকাল বুধবার (২৭ নভেম্বর) সন্ধ্যায় উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আজ বেলা ১২টা পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়েছিলেন তারা।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, উপাচার্যের ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডগুলো, তার প্রশাসনের অদক্ষতা, অযোগ্যতা এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থী। তিনি স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে কাজ করছে, তাদের পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং বিশেষভাবে বলতে গেলে যে জানিপপের সভাপতি কলিমুল্লাহ ও তার সিন্ডিকেটকে এই ভার্সিটি কেন্দ্রিক পুর্নাবাসনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
“তিনি দৃশ্যমান উন্নয়নমূলক কোনো কাজ তো করতে পারেননি, বরং পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নেও অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়কে দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক কাজে স্থবির করে দিয়েছেন। সর্বশেষ ট্রেজারার নিয়োগ নিয়ে সম্পূর্ণ একরোখা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সাধারণত শিক্ষার্থীদের বাঁধার মুখেও একের পর এক একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েই যাচ্ছেন।”
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন