অধ্যাপক ড. পরিমল চন্দ্র দত্ত। রাজধানীর আরামবাগে অবস্থিত নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি নিতে ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রেস্টন ইউনিভার্সিটি’ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের তথ্য উল্লেখ আছে তার জীবনবৃত্তান্তে।
যদিও এমন কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন মুলুকে অবস্থানরত কয়েকজন বাংলাদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। যদিও পিএইচডি ডিগ্রিধারী অধ্যাপক হিসেবে বর্তমানে তিনি নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিমাসে প্রায় দেড় লক্ষাধিকেরও বেশি টাকা বেতন গ্রহণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পরিমল চন্দ্র দত্ত শিক্ষকতা পেশায় আসেন ১৯৭৪ সালে। তার জীবন বৃত্তান্ত ঘেটে দেখা গেছে, শিক্ষকতার সময়ে তার অভিজ্ঞতায় রয়েছে জগন্নাথ কলেজ, বেসরকারি ইবাইস বিশ্ববিদ্যালয়, রয়েল ইউনিভার্সিটি এবং নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও জগন্নাথ কলেজ থেকে তিনি অবসরে যাওয়ার পর ২০০৫ সালে ইবাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
আবার শিক্ষকতা জীবন ১৯৭৪ সালে শুরু করলেও পিএইচডি ডিগ্রি নেন ২০০৬ সালে। প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষকতা শুরুর অন্তত ৩০ বছর পরে অবসরে যাওয়ার পরে কেন তিনি নতুন করে পিএইচডি নিলেন!
অধ্যাপক পরিমল চন্দ্র দত্তের সাঙ্গে শিক্ষকতায় যুক্ত ছিলেন নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমন একজনের খোঁজ পায় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। বর্তমানে যিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় আর নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, ‘আমি তাকে (অধ্যাপক পরিমল চন্দ্র দত্ত) ২০১৭ সাল থেকে চিনি। তিনি অবসরে যাওয়ার পরে অনলাইনে নাম সর্বস্ব ‘প্রেস্টন ইউনিভার্সিটি’ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। এটা কোনোভাবেই বৈধ নয়।’
‘প্রিস্টন ইউনিভার্সিটি এখন আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে আগে এটার অস্তিত্ব ছিল, রাজধানীর ধানমন্ডিতে বিদেশি এই উচ্চ শিক্ষালয়টির একটি ক্যাম্পাসও ছিল— ড. পরিমল চন্দ্র দত্ত, অধ্যাপক, বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়
তিনি আরও বলেন, ‘অবসরে যাওয়ার পরে আর্থিক সুবিধা নিশ্চিতে অধ্যাপক পরিমল ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করেন। উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে যেটি তার প্রতারণা। নকল পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে তিনি দুটি অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার অভিজ্ঞতা নেন। উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থা শোচনীয়। এরমধ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরিমল দত্ত আর্থিক সংকুলানের জন্য এ কাজ করেছেন। কিন্তু নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় তার পিএইচডি ডিগ্রি তদন্ত না করার বিষয়টি খুবই হতাশাজনক। এটাও সত্য, তার নিয়োগ হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়টির শুরুর দিকে। আমি আশা করি, নটর ডেম কর্তৃপক্ষ তার বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।’
পরিমল চন্দ্রের সাবেক কর্মস্থল রয়েল ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ করে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। সেখানেও তার পিএইচডি সম্পর্কে কোনো খোঁজ দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, অধ্যাপক পরিমল চন্দ্র দত্ত যখন নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পান তখন বিশ্ববিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত ভিসির দায়িত্বে ছিলেন ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা। এ প্রসঙ্গে নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের মন্তব্য জানতে গত রবিবার (১৭ নভেম্বর) মুঠোফোনে নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তরে যোগাযোগ করলে তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা পরিচয়ে কল রিসিভ করা হয়। এই কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রশাসনের মন্তব্য গ্রহণের পরামর্শ দেন।
পরে মন্তব্য জানতে সোমবার (১৮ নভেম্বর) রাজধানীর আরামবাগে উচ্চ শিক্ষালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস গেটে ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ইমাদ উদ্দিন নামে জনসংযোগ কর্মকর্তা এসে জানান, অধ্যাপক পরিমল চন্দ্র দত্তের বিষয়টি তিনি জানেন না। প্রশাসনের মন্তব্য পেতে হলে উপাচার্য বরাবর আবেদন করে আসতে হবে। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মন্তব্য প্রদান করবে না।
‘বিষয়টি নিয়ে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। তবে উচ্চশিক্ষায় পিএইচডি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন অধ্যাপকের পিএইচডিতে যদি কোনো প্রকার প্রশ্ন থাকে, অবশ্যই সেটা দুঃখজনক হবে। ইউজিসি বিষয়টিকে খতিয়ে দেখবে— অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, সদস্য, ইউজিসি
যদিও এ সম্পর্কে মতামত জানতে অভিযুক্ত অধ্যাপক ড. পরিমল চন্দ্র দত্তের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘প্রিস্টন ইউনিভার্সিটি এখন আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে আগে এটার অস্তিত্ব ছিল, রাজধানীর ধানমন্ডিতে বিদেশি এই উচ্চ শিক্ষালয়টির একটি ক্যাম্পাসও ছিল।’
তবে ধানমন্ডির কোথায় ক্যাম্পাস ছিল এবং পিএইচডি ডিগ্রি অনলাইনে গ্রহণের সুযোগ রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি পুনরায় প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চান। পরিচয় প্রদান করলে তিনি ব্যস্ততার কথা বলে কল কেটে দেন। এরপরে অধ্যাপক পরিমলের সাথে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে চাওয়া হয় উচ্চশিক্ষার তদারক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) কাছে। প্রতিষ্ঠানটির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। তবে উচ্চশিক্ষায় পিএইচডি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন অধ্যাপকের পিএইচডিতে যদি কোনো প্রকার প্রশ্ন থাকে, অবশ্যই সেটা দুঃখজনক হবে। ইউজিসি বিষয়টিকে খতিয়ে দেখবে’
প্রসঙ্গত, এর আগে বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী রেবেকা সুলতার ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির সংবাদ প্রকাশ করে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। রেবেকা সুলতাও ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রেস্টন ইউনিভার্সিটি’ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন বলে তার জীবনবৃত্তান্ত থেকে জানা যায়। যদিও এমন কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন মুলুকে অবস্থানরত কয়েকজন বাংলাদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন