দীর্ঘদিনের দাবি থাকলেও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি ডিগ্রি চালুর অনুমতি নেই। আগের সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। তারা এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি চালুর বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে।
দেশে বর্তমানে ১১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে ১০০টিতে। তবে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। ফলে ঢালাওভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিএইচডি ডিগ্রি চালুর বিপক্ষেই বিশেষজ্ঞরা মত দিচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানের দিক দিয়ে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই কেবল এ সুযোগ দেওয়া যায়। কারণ, পিএইচডি তো দূরের কথা, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় চালু থাকা স্নাতক পর্যায়ের কোর্সগুলিই ঠিক মতো শিক্ষাদান করতে পারছে না।
বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সনদ বাণিজ্যের অভিযোগ ছাড়াও অল্প সময়ে টাকার বিনিময়ে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তবে অনুমোদন না থাকায় এসব পিএইচডি ডিগ্রির আইনগত কোনো বৈধতাও নেই।
চলতি মাসে ইউজিসি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি কোর্স চালুর বিষয়ে খসড়া নীতিমালা করতে একটি ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য ড. অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দকে প্রধান করে কমিটির সদস্যসচিব করা হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক মো. শরিফুল ইসলামকে।
কমিটির বাকি সদস্যরা হচ্ছেন, ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক ড. হাসিনা খান, উত্তরা ইউনিভার্সিটির প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. গৌর গোবিন্দ গোস্বামী, গ্রিন ইউনিভার্সিটির কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো: শহীদুল্লাহ এবং ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক মো. ওমর ফারুখ।
মো. ওমর ফারুখ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নীতিমালা প্রণয়ন করতে কমিটি কাজ করছে। নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন চলমান।। সবদিক বিবেচনা করেই নীতিমালাটি চূড়ান্ত করা হবে।’
ইউজিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও সময়োপযোগী পাঠদান ব্যবস্থা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং অর্থও বরাদ্দ নেই। ২০২২ সালে ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ১টাকাও খরচ করেনি। ১ লাখের কম খরচ করেছে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়।
ইউজিসির ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গবেষণা খাতে এবং ব্যয়ের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি খরচ করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি গবেষণা খাতে ৪ থেকে ৫৮ কোটিরও বেশি টাকা খরচ করেছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিএইচডি ডিগ্রি চালুর দেওয়া হয় মনিটরিংয়েও জোর দিতে হবে। এছাড়া ভালো মানের গবেষণার প্রয়োজনে ইউজিসিকে সঠিক তদারকির বিষয়েও কঠোর হতে হবে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দেশের কয়েকটি বেশ উঁচু মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং সেগুলোতে পিএইচডি ডিগ্রি তত্ত্বাবধান করার মতো যোগ্য শিক্ষকও আছেন। ফলে আমি মনে করি, যারা মান ঠিক রাখতে পারবে, যারা ঠিকমতো তত্ত্বাবধান করতে পারেন এবং যাদের গবেষণা করার সক্ষমতা রয়েছে কেবল তারাই অনুমতি পেতে পারে। কারণ, মান ঠিক না রাখলে এই পিএইচডির গ্রহণযোগ্যতাও থাকবে না।‘
উচ্চশিক্ষায় গবেষণাকে উৎসাহিত করতে ভালো মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ দেওয়া দরকার বলেও মত দেন খ্যাতনামা এই শিক্ষাবিদ।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, `গবেষণাকে উৎসাহিত করা দরকার। কারণ, পিএইচডি করার মতো দেশে খুব একটা জায়গা নেই। আগ্রহী শিক্ষার্থীদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিতে চায় না বা উৎসাহিত করে না।‘
`ফলে গবেষণায় আগ্রহীদের বিদেশে যেতে হয়। আবার বিদেশে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার যোগ্যতা এবং সক্ষমতাও সবার থাকে না। কিন্তু বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো ভালো মানের শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্যই রয়েছে। তাই আমি মনে করি যে এটা খারাপ না‘—যোগ করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, `দেশের ছয় থেকে আটটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খুবই ভালো মানের শিক্ষক দিয়ে অত্যন্ত উঁচু মানের শিক্ষা বা পাঠদান দিয়ে থাকে। ফলে ঢালাওভাবে সব বেসকরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না।‘
`যাদের অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক, গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা এবং শিক্ষোপযোগী অনুকূল পরিবেশ রয়েছে তাদেরকে দেওয়া হলে আপত্তি নেই। কিন্তু আমি মনে করি, এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খুব বেশি বাংলাদেশে নেই।‘
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, `যেসব বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি ডিগ্রির অনুমতি পাবে সেখানে যেন অবশ্যই যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক থাকে। যারা নিজেরা বিদেশের ভালোমানের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের পড়ানোর এবং গবেষণার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এছাড়াও সেগুলোতে ভালোমানের গ্রন্থাগার থাকতে হবে। এসব বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।‘
সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় শর্তসাপেক্ষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিএইচডি ডিগ্রির সুযোগ দেওয়ার পক্ষে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী।
ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, `সব দেশেই পাবলিকের পাশাপাশি প্রাইভেটেও এই সুযোগ থাকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো করে দিয়ে থাকে। তাই সুস্থ প্রতিযোগিতাকে স্বাগত জানাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরও এই সুযোগ দেওয়া উচিত।‘
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে যে ভালো উদ্দেশ্যের জন্য এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে তার সঠিক বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত নীতিমালার প্রথ্যাশা করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির (এপিইউবি) চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন।
ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘এতদিন পর এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটাকে স্বাগত জানাই। তবে যে ভালো উদ্দেশ্যে এটি করা হচ্ছে, সকলের সঙ্গে আলোচনা করে নীতিমালা হলেই সেটি অধিক কার্যকারিতা এবং প্রয়োগ করতেও সুবিধা হবে।‘
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি চালু হলে এবং সঠিকভাবে হলে দেশে গবেষণা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলেই মনে করেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম।
ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘ইউজিসি খুব মহতী উদ্যোগ নিয়েছে। দেশে সত্যিকার অর্থেই ভালোমানের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা এই সুযোগ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। পৃথিবীর ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে নিয়ম আছে নীতিমালা যেন সেভাবেই তৈরি করা হয়। শর্তগুলো যেন কঠোর হয় যাতে যে কেউ পিএইচডিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে ডিগ্রি না দিতে পারে। তাই ভর্তির ক্ষেত্রে খুবই কড়া নিয়ম থাকতে হবে।‘
ড. আতিকুল ইসলাম বলেন, `এছাড়াও পিএইচডি গবেষকের তত্ত্বাবধায়ক (সুপারভাইজার) কারা হবেন, রিসার্চ প্রপোজালসহ গবেষণা সংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়গুলো সুস্পষ্ট উল্লেখ রাখলে ভালো হয়। সবমিলিয়ে ভালো মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এই সুযোগ দেওয়া হোক। শুধু ভালো হলেই হবে না যে বিষয়ে একজনকে পিএইচডির সুযোগ দেওয়া হবে সেই বিষয়ের জন্য সুযোগ্য লোকও সেখানে থাকতে হবে।‘
নর্থ সাউথ ভিসি বলেন, `তবে এ বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব শুধুই ইউজিসিরই নয়। ইউজিসি শুধু গাইডলাইন তৈরি করবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়েরও নিজেদের মান রক্ষার জন্য সচেতন থাকতে হবে।‘
সুযোগ দিলেও চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স রাখার কথা বলছেন শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, `প্রতি বছরে কিংবা দুই বছরে একবার এক্সপার্ট কমিটি করে তদন্ত করতে হবে। যেহেতু ইউজিসি উদ্যোগ নিয়েছে তাদের একটি কমিটি করে বিভিন্ন পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ রয়েছেন তাদেরকে তদারকির দায়িত্ব দিতে পারে।‘
`এই বিশেষজ্ঞরা দেখবেন যেসব শর্ত মেনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুমতি দেওয়া হলো তারা সেসব মেনে গবেষণার কাজ চালাচ্ছে কী না। যদি তারা শর্তগুলো মেনে গবেষণা চলমান রাখে তবে তাদের উৎসাহ দিতে হবে। তবে নাক গলাবেন না। এমন যদি হয় তবে কোনো আপত্তি নেই।‘
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে জনমনে থাকা আস্থার সংকট দূর করার পরামর্শ দিয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, `বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো ভালো মানের শিক্ষক। কারণ যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক থাকলে সেসব বিশ্ববিদ্যালয় মানে ভালো হতে থাকে এবং সমাজে সম্মানও পায়। ফলে সেখানে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীর ডিগ্রিও গ্রহণযোগ্যতা পায়।‘
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন