সম্প্রতি আওয়ার ইসলামে প্রকাশিত রাজধানীর ঢালকানগরের পীর খ্যাত বিশিষ্ট আলেম বাইতুল উলুম ঢালকানগর মাদরাসার মুহতামিম মুফতি জাফর আহমাদ-এর একটি মতামতকে কেন্দ্র করে ঝড় ওঠে নেট পাড়ায়। তিনি ‘একাধিক মাদরাসায় হাদিস পড়ানোর বিষয়কে টিউশনি মাস্টারের মত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আজকাল দেখা যাচ্ছে একজন মুহাদ্দিস ১৫ জায়গায় হাদিস পড়ান। এটা কি ‘কহতর রিজাল’, মুহাদ্দিসের অভাব! না হলে ১৫ জায়গায় কেন যাবে! আমাদের আকাবিরিনদের যুগে কি এমন পদ্ধতি ছিল! হুসাইন আহমাদ মাদানী দশ জায়গায় পড়াতেন! আনোয়ার শাহ কাশ্মেরী বিশ জায়গায় পড়াতেন? আর এখন এটাকে গৌরবের জিনিস হিসাবে মনে করছে’।
এসব বিষয়ে তরুণ মুহাদ্দিস-শিক্ষকরা কী ভাবছেন বা তাঁদের ভাবনায় কী রয়েছে সেসব জানতে হাজির হয় আওয়ার ইসলাম। ‘একজন একাধিক মাদরাসায় বুখারি পড়ানোর কারণে নতুন শাইখুল হাদিস তৈরী হচ্ছে না’ বিষয়ে মতামত চাওয়া হয় দেশের তরুণ মুহাদ্দিস-শিক্ষকদের কাছে।
মাওলানা হাবীবুল্লাহ আশরাফী । শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ১৩টি বছর পাড় করেন। পড়িয়েছেন দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত। হাদিসের কিতাব বুখারী সানী, মুসলিম আওয়ালসহ অনেক কিতাবাদী। মিশকাত আওয়ালের মুকাদ্দিমাতুশ শায়খের প্রথম অনুবাদকও তিনি। এছাড়া ছিলেন কওমি শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’র সাবেক সিনিয়র পরিদর্শক ও সাবেক মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জব্বার জাহানাবাদী রহ, এর দীর্ঘদিনের একান্ত সচিবও। বর্তমানে সুনামগঞ্জ এরুয়াখাইয়ে অবস্থিত জামিয়া ইসলামিয়া আশরাফুল উলূমের পরিচালক।
‘একজন একাধিক মাদরাসায় বুখারি পড়ানোর কারণে নতুন শাইখুল হাদিস তৈরী হচ্ছে না’ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একজন শায়খুল হাদিসের/ মুহাদ্দিসের একাধিক মাদরাসায় হাদীস পড়ানোটা ইলমী ইনহিতাত বা ইলমী অধঃপতন মনে হচ্ছে। তা ছাড়া এতে পরিপূর্ণ আমানতদারিও আদায় হয় না ছাত্রদের। যার দরুন যোগ্য রিজাল তৈরি হচ্ছে না। উস্তাদের সাথে ছাত্রদের কছরতে মুলাযামা পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশে বহু শায়খুল হাদিস আছেন, কিন্তু হাদীসের গবেষণায় পারদর্শী শায়খুল হাদিস নিশ্চয়ই ২/৩ পার্সেন্ট হবে হয়তো! একাধিক মাদরাসায় সময় দেয়ায় গবেষণায়ও সময় ব্যায় করতে পারছেন না শায়খুল হাদিসগণ।
এক্ষেত্রে যত্রতত্র দাওরায়ে হাদীস মাদরাসা খোলাও কম দায়ী নয় ।
হ্যাঁ সফরে বা বিশেষ কোন কারনে কোন মাদরাসায় যোগ্য কোন শায়খুল উপস্থিত হলে, বরকতান হাদীসের দরস প্রদান দোশনীয় নয়। বরং এটা আকাবির থেকে প্রমাণিত। ১০/১৫ জায়গায় হাদীসের দরস আমাদের অনেক আকাবির পছন্দ করতেন না। শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ, এবং বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সাবেক মহাসচিব আল্লামা আব্দুল জব্বার জাহানাবাদী রহ, সহ বহু বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম একাধিক মাদরাসায় হাদীস পড়ানোর ক্ষেত্রে নিরোৎসাহী ছিলেন।
সিনিয়র শায়খুল হাদিসের উচিৎ যোগ্য শায়খুল হাদিস তৈরিতে জুনিয়র উস্তাদদেরকে যোগ্য করে গড়ে তোলা এবং হাদিস গবেষণায় সময় ব্যয় কর ‘।
শিক্ষকতায় ১৩ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মিরপুরের মাদরাসা দারুর রাশাদ-এর শিক্ষক মুফতি আব্দুল আজিজ কাসেমী বলেন, ‘একজন একাধিক মাদরাসায় বুখারি পড়ানোর কারণে নতুন শাইখুল হাদিস তৈরী হচ্ছে না’ এ কথাটির কিছু যৌক্তিকতা রয়েছে। যেমন, খেদমতের শুরুতেই ভালো কোন প্রতিষ্ঠানে কাউকে বুখারী শরীফ পড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয় না। বরং বুখারী পড়ানোর জন্য আগে হাদীসের অন্যান্য কিতাব পড়ানোর দীর্ঘ অভিজ্ঞতাকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অথচ দেখা যায় যে, ইলমী, আমলী ও সার্বিকভাবে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও একজন মুদাররিস ১০-১২ বছরেও মুহাদ্দিস হতে পারছেন না। তিনি সেই সুযোগ পাচ্ছেন না। তাহলে তাদের শাইখুল হাদীস হওয়ার স্বপ্ন কবে পূরণ হবে!
এর একটি কারণ এটাও যে, যারা প্রবীণ ও সিনিয়র মুহাদ্দিস তারা শাইখুল হাদীসের পদে উন্নিত হতে পারছেন না বাইরের একাধিক শাইখুল হাদীস থাকার কারণে, আর মুদাররিসগণ মুহাদ্দিস হতে পারছেন না প্রবীণদের সেই সুযোগ না হয়ে উঠার কারণে। তবে প্রবীণ, যোগ্য ও আ'লা সনদধারী শাইখদের জন্য একাধিক প্রতিষ্ঠানে বুখারী পড়ানোর অবশ্যই প্রয়োজন আছে। এমন না হলে গ্রামে ও ছোট মাদরাসাগুলোতে দাওরায় ছাত্র সংকট দেখা দিবে এবং তারা বহুকিছু থেকে মাহরুম হবে।
শিক্ষকতায় ১২ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সাভারের ঐতিহ্যবাহী যাদুরচর মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি আবদুল্লাহ ফিরোজী। ‘একজন একাধিক মাদরাসায় বুখারি পড়ানোর কারণে নতুন শাইখুল হাদিস তৈরী হচ্ছে না’ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তালিবুল ইলমদের বরাবরই আগ্রহের জায়গা হচ্ছে 'আলী সনদ' বা উঁচু সনদধারী কারো নিকট হাদীসের কিতাব পড়া। উঁচু সনদের মর্যাদার কথা সবারই কমবেশি জানা আছে। উঁচু সনদধারী আহলে ইলম আহলে নিসবত কোন আলেম যদি একাধিক মাদরাসায় বুখারি পড়ান তাতে দোষের কিছুই দেখছি না। এবং সেটাকে জেনারেল কোন শব্দ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করারও আমি পক্ষে না।
একজন একাধিক মাদরাসায় বুখারি পড়ানোর কারণে নতুন শায়খুল হাদীস তৈরী হচ্ছে না’ এটা একটা ভুল ধারণা। যারা যোগ্য তারা ঠিকই শায়খুল হাদীস হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছেন। দেশের অনেকগুলো প্রসিদ্ধ মাদরাসায় তরুণ আলেমরা ইলমি আমলি যোগ্যতার কারণে অল্পদিনেই নিজ তাকসীমে বুখার শরীফ পেয়েছেন। দ্বিতীয়ত নামকাওয়াস্তে শায়খুল হাদীস তৈরিতে কোন কল্যাণ নেই। দেশে আজ ঘরে ঘরে মুফতি অথচ এক পৃষ্ঠা আরবি ইবারত নির্ভুল পড়তে পারে না। এমন মুফতি দিয়ে এই জাতির কী কল্যাণ হয়েছে আর ইলমি অঙ্গনে কী উপকার সাধিত হয়েছে?
আমাদের আকাবির আসলাফরা যোগ্য উস্তাদের থেকে উঁচু সনদের একটা হাদীস গ্রহণের জন্য মাইলের পর মাইল সফর করেছেন। এখন সময় ও যুগ পাল্টেছে। ছাত্রদের মধ্যেও তলবের মাদ্দা কমেছে। তাই যোগ্য মানুষ একাধিক মাদরাসায় বুখারি পড়নোতে বরং তালিবুল ইলমদের উপর ইহসান করা হচ্ছে।
একাধিক মাদরাসায় বুখারী পড়নো কোন শায়েখ যদি ছাত্রদের হক যথাযথ আদায় না করেন সেটা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। ঠিক তেমনই স্বজনপ্রীতি বা দলপ্রীতির জন্য বাইরের কাউকে দিয়ে বুখারী পড়ানোর কারণে নিজ প্রতিষ্ঠানের কোন যোগ্য উস্তাদকে অবজ্ঞা ও বঞ্চিত করা হয় সেটা অবশ্যই নিন্দনীয় ও পরিত্যাজ্য।
নারায়ণগঞ্জের প্রাণকেন্দ্র চাষাড়ায় অবস্থিত জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাতের শিক্ষাসচিব ও সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ ধরে একাধিক মাদরাসায় যিনি শিক্ষকতা করছেন এবং বর্তমানে হাদিসের অনবদ্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ তিরমিজি শরিফ প্রথম খণ্ডের পাঠদান করছেন।
তিনি বলেন, ‘একজন একাধিক মাদরাসায় বুখারি পড়ানোর কারণে নতুন শাইখুল হাদিস তৈরী হচ্ছে না’ কথাটির সাথে আমি একমত। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের উন্নতি-অগ্রগতি নিয়ে যেমন ভাবেন তেমনিভাবে শিক্ষকদের নিয়েও ভাবা উচিত। এতে করে দেখা যাবে সেখানের নবীন শিক্ষকদের মধ্যে ভালো মুহাদ্দিস তৈরি হচ্ছে এবং নবীন মুহাদ্দিসদের মধ্যে যোগ্য শায়খুল হাদিস বের হয়ে আসছে।
এখন দেখা যাচ্ছে, মাদরাসা কর্তৃপক্ষের শিক্ষক গঠনে মনোযোগ না দিয়ে সুনাম-সুখ্যাতির আশায় বড় বড় শায়খুল হাদিস নিয়োগ দেন। এতে সুনাম হয় ঠিকই কিন্তু ছাত্রদের হক অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট হয়। আল্লাহ মাফ করুন, এমনও মাদরাসা আছে যেখানে একজন শায়খ সপ্তাহে মাত্র একটি ঘণ্টা করে বুখারির ১০/১৫ পারা পড়িয়ে দিচ্ছেন। বুখারির এমন কোন অধ্যায়টি আছে যেটি গড়গড় করে পড়ে যাওয়ার মতো!
তবে যেসব শায়খুল হাদিস বিভিন্ন জায়গায় বুখারি পড়ান তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা অপারগ এবং এটা তাদের মহানুভবতা। এতে তাদের অনেক কষ্টও হয়। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ একরকম চাপাচাপি করেই তাদের নিয়োগ দেন। মুরব্বি শায়খরাও মনে করেন, আমার দ্বারা যদি তাদের প্রতিষ্ঠানের একটু উন্নতি হলো তাহলে একটু কষ্ট না হয় করলাম। এটাকে টিউশনির সঙ্গে তুলনা করাটা বেমানান। আল্লাহ আমাদের মুরব্বিদের ছায়া আমাদের ওপর বৃদ্ধি করে দিন।
৮ বছর ধরে শিক্ষকতায় নিয়োজিত মাওলানা হাবীবুল্লাহ সিরাজ। ছিলেন উত্তরা বাইতুল মুমিন মাদরাসার শিক্ষা সচিবও। বর্তমানে জামিয়াতুল উস্তাদ শহিদুল্লাহ ফজলুল বারি রহ-এর শিক্ষক।
‘একজন একাধিক মাদরাসায় বুখারি পড়ানোর কারণে নতুন শাইখুল হাদিস তৈরী হচ্ছে না’ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না আমার মতামতটি পক্ষে যাবে না বিপক্ষে যাবে; আমি প্রথমে যে বিষয়টি উল্লেখ করব, একজন উস্তাদ একজন ছাত্রকে সেই তাইসির থেকে মেশকাত পর্যন্ত পড়ালেন, আর বুখারির জন্য অন্য মাদরাসা থেকে শিক্ষক যাকে শাইখুল হাদিস বলে নিয়োগ দিবেন; এটি সুন্দর না। যে উস্তাদ তাইসির থেকে মেশকাত পর্যন্ত পড়াতে পারল; সেই উস্তাদ কি বুখারি পড়াতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। এই জন্যে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ লক্ষ রাখতে হবে, অন্য মাদরাসার শাইখুল হাদিস নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে যেন নিজ মাদরাসার উস্তাদদের সামনে বাড়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক না হয়। অন্য মাদরাসার বা বড়মাপের শায়খ নিয়োগ হতে পারে অল্প একটু পড়ানোর জন্য; এটি বরকত ও বড়দের সোহবত হিসেবে ধরা হবে। মূল উস্তাদ নিজ মাদরাসার হওয়া বাঞ্চনীয় ‘।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন