রাজধানীর উত্তরার শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের কর্তৃত্ব নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে সরকার দলীয় স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ও কলেজ কর্তৃপক্ষ। শহীদ মনসুর আলী ট্রাস্টের ট্রাস্টিবডির সেক্রেটারি দাবি করে কলেজের কর্তৃত্ব চেয়েছেন স্বাচিপ সভাপতি ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী। কিন্তু সেই দাবি নাকচ করে দিয়েছে শহীদ মনসুর আলী ট্রাস্ট। ট্রাস্টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছেন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে সিরাজগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য তানভির শাকিল জয়। এ নিয়ে স্বাচিপ সভাপতির সাথে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষের।
‘কন্ট্রাক্ট কিলারের’ সঙ্গে ব্যারিস্টার সুমনের যে কথা হলো‘কন্ট্রাক্ট কিলারের’ সঙ্গে ব্যারিস্টার সুমনের যে কথা হলো
২০১১ সালে দিয়েছে শহীদ মনসুর আলী ট্রাস্টের সেক্রেটারি ছিলেন ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী। ২০১৫ সালে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি ওই পদ থেকে অব্যাহতি নেন। দীর্ঘ ১৩ বছর পর সেই সেক্রেটারি পদের দাবি নিয়ে গত ২৭ জুন সদলবলে হঠাৎ করেই কলেজে যান এই স্বাচিপ নেতা। কলেজ অধ্যক্ষের কাছে নিজেকে ট্রাস্টের সেক্রেটারি দাবি করে এখন থেকে তার সাথে পরামর্শ করে কলেজ পরিচালনার নির্দেশ দেন। এখন থেকে তিনি নিয়মিত কলেজে আসবেন ও কলেজ ক্যাম্পাসে তার জন্য কক্ষ তৈরি করতে বলেন। এমনকি ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় কলেজ অধ্যক্ষকে বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশ দেন।
বিষয়টি তাৎক্ষনিকভাবে শহীদ মনসুর আলী ট্রাস্টকে লিখিতভাবে জানান কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন। পরে ৩০ জুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনকেও লিখিতভাবে অবহিত করেন। ঘটনাটি স্বাস্থ্য খাতে ছড়িয়ে পড়ে। আলোচনা ও সমালোচনার মুখে পড়েন স্বাচিপ সভাপতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাচিপ সভাপতি ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী আজ মঙ্গলবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, জয়েন স্টক কোম্পানির নিবন্ধন অনুযায়ি আমি সেক্রেটারি। রেকর্ডেও আছে। নানা কারণে মাঝখানে আমি ওই প্রতিষ্ঠানে যাইনি। কিন্তু যেহেতু পদে আছি, আমাকে দায়িত্ব নিতেই হবে।
স্বাচিপ সভাপতির এই দাবি নাকচ করে দিয়ে কলেজ অধ্যক্ষ বলেন, আমার জানা মতে উনি ২০১১ সালে ট্রাস্টি বোর্ডে ছিলেন। এটা জয়েন স্টক থেকে নিবন্ধিত। প্রতি তিন বছর পর পর নবায়ন হয়। উনি যদি ২০১১ সালে থেকে থাকেন, এখন তো ২০২৪ সাল। কতবার নবায়ন হয়েছে। বোর্ডের সদস্য পরিবর্তন হয়েছে। সর্বশেষ তানভির শাকিল জয় ২০১৮ সাল থেকে সেক্রেটারির দায়িত্বে।
কি ঘটেছিল সেদিন
গত ২৭ জুন দলবল নিয়ে কলেজে যান স্বাচিপ সভাপতি। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে কলেজ অধ্যক্ষের করা লিখিত অভিযোগ থেকে ও অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে স্বাচিপ সভাপতি প্রায় ৫০-৬০ জন বহিরাগত লোকজন নিয়ে কলেজে যান ও প্রায় আধা ঘণ্টা কলেজ অধ্যক্ষের কক্ষে থাকেন।
এ ব্যাপারে কলেজ অধ্যক্ষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্বাচিপের সভাপতি হিসেবে উনি আসতেই পারেন। আমিও স্বাচিপের আজীবন সদস্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে লোকজন এলে আমাকে জানিয়ে আসে। কিন্তু উনি কিছুই না জানিয়ে ৫০-৬০ জন লোক নিয়ে ঢুকে পড়লেন। ২৫-২৬ জন লোক নিয়ে আমার রুমে ঢুকে পড়লেন। আমি তো হতভম্ব। চর দখলের মতো।
কলেজ অধ্যক্ষ বলেন, ‘আসার কারণ জানতে চাইলে উনি (স্বাচিপ সভাপতি) বলেন, ট্রাস্টের সেক্রেটারি হিসেবে এসেছেন। এখন থেকে আপনি আমার সাথে পরামর্শ করে কলেজ পরিচালনা করবেন। আমি তাকে জানাই, গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের স্ত্রী লায়লা আর্জুমান্দ ও আমি সেক্রেটারি। আমি চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলবো। আপনার সাথে কেন বলবো?’
‘এসময় স্বাচিপ সভাপতি ট্রাস্টের সেক্রেটারি দাবি করে তার জন্য একটি কক্ষ বরাদ্দ করতে বলেন। অথচ ট্রাস্টি বোর্ডের বর্তমান সেক্রেটারি সিরাজগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে তানভির শাকিল জয়। তাদের অনুমতি ছাড়া কিছু্ই করা সম্ভব নয়। এ সময় উনি তার এসব বার্তা তাদের কাছে পৌঁছাতে বলেন। আমি তাকে তাদের সাথে সরাসরি কথা বলতে বলি। কারণ তারা সবাই ঢাকায় থাকেন। পরে তারা চলে যান’— বলেন কলেজ অধ্যক্ষ।
কী চান স্বাচিপ নেতা
স্বাচিপ সভাপতি আসলে কি চান— জানতে চাইলে কলেজ অধ্যক্ষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমি জানি না কেন তারা এসেছিলেন। তবে কলেজটি সবার নজর পড়েছে। কারণ দেশের ৬৭টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে এটি চার নম্বরে। এত ভালো একটি প্রতিষ্ঠান, পাঁচ একর জমির ওপর আট তলা ভবন, এত নান্দনিক মেডিকেল কলেজ আর নেই। এটাকে চার বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তুলেছি। ভেবেছিলেন আমাকে উত্যক্ত করতে পারলে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করবেন।
কলেজ অধ্যক্ষ জানান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিষয়টি দেখার আশ্বাস দিয়েছেন ও চুপচাপ থাকতে বলেছেন। উনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে দেখবেন কেন এমনটি হলো। এটা তো হওয়ার কথা না, কাঙ্খিত না। এরপর বিএমডিসি, সাবেক স্বাচিপ নেতারা ফোন করে পরিস্থিতি জানতে চেয়েছে।
স্বাচিপ সভাপতি কলেজের কর্তৃত্ব চান কি না— জানতে চাইলে এই অধ্যক্ষ বলেন, চাইতেই পারেন। কারণ এত বড় প্রতিষ্ঠান, বছরে ৪০-৫০ কোটি টাকার আয়-ব্যয়। ট্রাস্টি বোর্ডের কোন টাকা ট্রাস্টি বোর্ডের কোন সদস্য নিতে পারেন না। নেওয়ার সুযোগ নেই। মেডিকেল কলেজে আসন ১৪০। বিদেশি শিক্ষার্থী ৯২ জন। হাসপাতালের বেড ৭০০। আমরা সরকারকে বড় অঙ্কের রাজস্ব দেই। তবে জাতীয় চার নেতার নামে এমন একটি নামকরা প্রতিষ্ঠান, সেখানে চর দখলের মতো এসে দখল করে নেবে, এটা তো হতে পারে না।
কিন্তু স্বাচিপ সভাপতি বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি বলেছি, এখন থেকে নিয়মিত কলেজে যাবো ও সব কিছু আমাকে জানাতে হবে। কিন্তু প্রিন্সিপাল খুবই অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে। স্বাচিপের সভাপতি যখন যাবে, তখন কিছু লোকজন তো সাথে থাকবেই। স্বাচিপের সভাপতির সাথে খারাপ আচরণ করছে, এক কাপ চা—ও খাওয়াচ্ছে না, তখন তো সবাই ক্ষেপবেই। ওটা এমন কিছু না। আমার সাথে যারা ছিলেন, তারা সবাই ডাক্তার।’
মাঝখানে দীর্ঘ ১৩ বছর যাননি, হঠাৎ কেন— জানতে চাইলে স্বাচিপ সভাপতি বলেন, মাঝখানে যাইনি। তখন পরিবেশ পরিস্থিতি ভালো ছিল না। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আমি দেখতে পাচ্ছি ওখানে অনেক অনিয়ম হচ্ছে। সেগুলো ঠিক করতে হবে। ওখানে আজ কারো চাকরি আছে, কাল নেই। এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না। শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। ওদের কোটি কোটি টাকার ঋণ আছে। আমি সেক্রেটারি। জয়েন স্টক কোম্পানিতে আমার নাম নিবন্ধিত। এসব দেখার দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে।’
ট্রাস্টের সেক্রেটারি কে
স্বাচিপ সভাপতি দাবি করেন, জয়েন স্টক কোম্পানির নিবন্ধন অনুযায়ী তিনি এই ট্রাস্টের সেক্রেটারি। দেশ রূপান্তরকে পাঠানো কাগজপত্র অনুযায়ী, ২০১১ সালে সেক্রেটারি ছিলেন ডা. হাবিবা হাসনাত চৌধুরী ও ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী। সে সময় চেয়ারম্যান ছিলেন লায়লা আর্জুমান্দ ও মোছাদ্দেক হোসেন বিশ্বাস। ওই বছরই মাওলানা ভাসানী ট্রাস্ট নাম পরিবর্তন করে শহীদ মনসুর আলী ট্রাস্ট হয়।
কলেজের কাগজপত্র থেকে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট ট্রাস্টের জরুরি সভায় ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ট্রাস্টের সদস্য ও সেক্রেটারি পদ থেকে অব্যাহতি নেন এই স্বাচিস সভাপতি এবং তার পরিবর্তে সেক্রেটারি হন তানভীর শাকিল জয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি ফের সেক্রেটারি হন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন