রক্তের প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয় মানুষকেই।রক্তদান নিঃসন্দেহে মহৎ ও মানবিক। তবে এর সঙ্গে নানা জটিল দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে বাঁচার উপায়ও হলো নিয়মিত রক্তদান। যেমন- ক্যান্সার। হ্যাঁ, নিয়মিত রক্তদান যে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় তা বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত। এমনিতে প্রতি তিন মাস পরপর সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিশ্চিন্তে রক্তদান করতে পারেন। রক্তদান স্বাস্থ্যে কোনো ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না বরং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
তবে মহামারির সময় রক্তদানে অনেকেই আগ্রহ হারিয়েছেন। পাশাপাশি অনেকে টিকা নেওয়ার পর রক্তদানে বিরত থেকেছেন। কারণ নিয়ম অনুযায়ী টিকা গ্রহণের পর দীর্ঘদিন রক্তদান করতে নিষেধ করছেন চিকিৎসকরা। ফলে অতি সম্প্রতি দেশে রক্তদাতার সংকট দেখা যাচ্ছে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন- সব সময়ই রক্তদাতার সংকট থাকে। এর প্রধান কারণ সচেতনতার অভাব। দেশের অধিকাংশ মানুষ এ ব্যাপারে সচেতন না থাকায় রক্তদানে আগ্রহ দেখায় না। রক্তদানের পদ্ধতি ও পরবর্তী প্রভাব সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অযথা ভীতির কারণে অনেকেই রক্ত দিতে দ্বিধান্বিত হন। কিন্তু রক্তদানের মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেহে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যায়।
আগামী ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। ডব্লিউএইচও এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, 20 years of celebrating giving: thank you blood donors! সহজ বাংলা করলে দাঁড়ায়- ‘দিবস উদযাপনের ২০ বছর: ধন্যবাদ হে রক্তদাতা!’।
বিজ্ঞানীরা বলেন, রক্ত দেওয়ার সময় শরীরের অতিরিক্ত লৌহ উপাদান বেরিয়ে যাওয়ার ফলে রক্তদাতার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায়। বছরে দুইবার রক্তদানে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে মিলার-কিস্টোন ব্লাড সেন্টার সাড়ে চার বছর ধরে ১২০০ লোকের ওপর গবেষণা চালিয়ে বের করেন যে, রক্তদানের
সঙ্গে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমার সরাসরি সম্পর্ক আছে। যারা বছরে অন্তত দুই বার রক্ত দান করেন, অন্যদের তুলনায় তাদের ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম। বিশেষ করে গলা, ফুসফুস, লিভার, কোলন ও পাকস্থলী ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায় রক্ত দিলে। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে ৩৭ শতাংশ!
রক্তদানের সঙ্গে হৃদরোগ ঝুঁকি কমানো নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন একদল গবেষক। তারা ২০ বছর ধরে নির্দিষ্ট রক্তদাতাদের অবজার্ভ করেন। এই পরীক্ষায় হৃদরোগের চেয়েও ক্যান্সারের ফলাফল দেখে তারা বেশি বিস্মিত হন।
গবেষণায় দেখা যায়, রক্তদাতাদের ক্যান্সারের ঝুঁকি ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত নেমে গেছে। আর যাদের ক্যান্সার হয়েছে, তাদের মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম।
এই ফলাফলে বিস্ময় প্রকাশ করে ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট জার্নাল (Journal of the National Cancer Institute)। এক রিপোর্টে তারা বলেন, “results almost seem to be too good to be true” এ থেকে তারা উপসংহার টানেন যে, ৬ মাসের মধ্যে শুধু একবার রক্ত দান করলেই ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে আসে।
কীভাবে কমে ক্যান্সারের ঝুঁকি?
রক্তের অন্যতম উপাদান হলো লৌহ বা আয়রন। রক্তদানের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ‘বোনম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্তকণিকা জন্ম হয়, ঘাটতি পূরণ হয়। পরিসংখ্যান বলছে, যারা নিয়মিত রক্তদান করেন, তাদের ফুসফুস, অন্ত্র, গলার ক্যানসারের আশঙ্কা কমে।
বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত গবেষণায় চমকে উঠছেন যে, রক্তের আয়রন উপাদানের ভারসাম্যের সঙ্গে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কতটা সরাসরিভাবে সম্পর্কিত। গবেষকদের পরীক্ষা নিরীক্ষায় উঠে এসছে যে, রক্তের আয়রন উপাদান বেশি হলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
এ জন্যে গবেষকরা এ নিয়ে গবেষণাপত্র লিখেছেন যে, ক্যান্সার কি তাহলে ফেরোটক্সিক ডিজিজ (ferrotoxic disease)? Ferro মানে লৌহ-বিশিষ্ট। টক্সিক মানে বিষাক্ত।
বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করছেন, শরীরে আয়রন উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি শরীরে যে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে তার কারণে ক্যান্সার হয় কি না! কারণ আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে রক্ত নেন, তাদের শরীরে আয়রন উপাদান বেড়ে যাওয়ার ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
এমনকি মহিলাদের যাদের কোনো জটিলতার কারণে যেমন এনডোমেট্রিওসিস (Endometriosis) মাসিকের সময় ওভারিতে রক্তপাত হয় তাদের ওভারিতে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় অনেকাংশে। নিজ এবং অন্যের জীবন রক্ষার্থে নিয়মিত রক্ত দিন শুধু ক্যান্সারই নয়, রক্তদানের আছে আরও বহুমুখী উপকার।
আসুন জেনে নিই রক্তদানের উপকারিতা:-
রক্তদান করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরের মধ্যে অবস্থিত বোন ম্যারো নতুন কণিকা তৈরির জন্যে উদ্দীপ্ত হয়। দান করার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেহে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যায়, আর লোহিত কণিকার ঘাটতি পূরণ হতে সময় লাগে চার থেকে আট সপ্তাহ। আর এই পুরো প্রক্রিয়া আসলে শরীরের সার্বিক সুস্থতা, প্রাণবন্ততা আর কর্মক্ষমতাকেই বাড়িয়ে দেয়। তবে রক্তদানের এ উপকারগুলো আসলে তারাই পাবেন যারা নিয়মিত রক্তদান করেন।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, যারা নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট সময় পরপর রক্তদান করেন, তাদের হৃদরোগের আশঙ্কা খুবই কম। যারা সারা জীবনে কখনও রক্তদান করেননি, তাদের হৃদযন্ত্রের তুলনায় রক্তদানকারীদের হৃদযন্ত্র অনেক বেশি সুস্থ থাকে।
ক্যালোরি ঝরায়
একবার রক্ত দিলে সাধারণত তিন মাসের ভেতরে আর রক্তদান করা যায় না। কিন্তু চার-পাঁচ মাস পরপর যদি কেউ রক্তদান করেন, প্রতিবারই বিনা পরিশ্রমে ঝরিয়ে ফেলতে পারেন ৬৫০ ক্যালোরি। এমনই বলছে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা।
বয়সের ছাপ কম
যারা নিয়মিত রক্তদান করেন, তাদের শরীরে বয়সের ছাপও কম পড়ে। ত্বক অনেক টানটান থাকে। শরীরে মেদও জমে কম। রক্তে কোলস্টেরলের উপস্থিতি কমাতে সাহায্য করে। হার্ট ও লিভার ভালো থাকে।
লেখক: জুনিয়র কনসালট্যান্ট, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন