গত দুই সপ্তাহ ধরে তাপপ্রবাহ চলছে সারাদেশে। এ অবস্থায় দোকানে নির্দেশিত তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সংরক্ষণের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় বিভিন্ন ফার্মেসি ও দোকানে থাকা ওষুধের গুণগতমান কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রার কারণে কার্যকারিতা হারানো ওষুধে হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য।
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন ওষুধের দোকান ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ৯০ শতাংশ ওষুধের নির্দেশিকায় বা মোড়কে ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখার নির্দেশনা রয়েছে। তবে গত কয়েক সপ্তাহের তাপপ্রবাহে নির্দেশিকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওষুধ সংরক্ষণ করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
কিছু মডেল ফার্মেসি ছাড়া বেশিরভাগ ফার্মেসিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের (এসি) ব্যবস্থা নেই। বাকিগুলোতে ফ্যান ও রেফ্রিজারেটর ছাড়া ওষুধ সংরক্ষণে কোল্ড চেইন ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থায় অ্যান্টিবায়োটিক, ইনসুলিন, টিকা, অয়েন্টমেন্ট, জেল, ফুড সাপ্লিমেন্ট, ডায়াগনোসিস কিটের মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রীর গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। এমনকি ওষুধ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা বাড়ছে।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) এলাকা, মগবাজার, বাংলামোটরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, হাতেগোনা কয়েকটি দোকানে কোল্ড চেইন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। এর বাইরে অন্তত অর্ধশত দোকানে এ ব্যবস্থা নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) সংলগ্ন ফার্মেসিতেও একই অবস্থা। অনেক দোকানের কর্মীরা জানেনই না যে ওষুধ সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রার প্রয়োজন আছে। তবে রেফ্রিজারেটর ব্যবস্থা রয়েছে অধিকাংশের।
ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগ গেট সংলগ্ন মেডিসিন কর্নারের স্বত্বাধিকারী মো. শওকত আলী সময় সংবাদকে বলেন, ওষুধ নিয়ে রোগীদের কোনও অভিযোগ নেই। ওষুধের মোড়কের গায়ে ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ কথা বলা থাকলেও নষ্ট হয়ে যাবে এমনটা কোম্পানি থেকে বলা হয়নি। এই গরমে ২৪ ঘণ্টা ফ্যান ছাড়াই আছে। সাপোজিটর জাতীয় কিছু ওষুধ রেফ্রিজারেটরে রাখা হয়। অনেক সময় রোগীরাও এসে অনুরোধ করে সাপোজিটর ফ্রিজে রাখতে। আমরা এর বিনিময়ে কোনও অর্থ নেই না।
তীব্র তাপপ্রবাহে অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন জীবনরক্ষাকারী ওষুধ সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ হচ্ছে না। ছবি সময় সংবাদ
বিএসএমএমইউ সংলগ্ন ইউনাইটেড ড্রাগসের বিক্রয়কর্মী শরীফ উদ্দিন বলেন, নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ না করলে গুণগত মান কমতে পারে, বিষয়টি আমরা জানি। কিন্তু প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে কেউ খরচ বাড়াতে চায় না। তাই কোল্ড চেইন ব্যবস্থা বা এসি স্থাপন করে খরচ বাড়াতে চাই না। তবে সংবেদনশীল ওষুধ ফ্রিজে রাখি।
এ বিষয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ সময় সংবাদকে বলেন, সঠিক তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ করা না গেলে ওষুধের গুণগত মান থাকে না বা কার্যকারিতা হারানোর ঝুঁকি থাকে। কিছু ওষুধ অনেক বেশি স্পর্শকাতর, যেগুলো রেফ্রিজারেটর করতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিক, বিভিন্ন ধরনের হরমোন, ব্লাড প্রডাক্ট, যেগুলো বায়োসিমিউলেশন প্রডাক্ট অর্থাৎ বায়োমলিকুলার ওষুধগুলো উচ্চ তাপমাত্রায় নষ্ট হয়ে যায়। তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়তে পারে। যেকারণে ফার্মেসি বা ওষুধের দোকানে প্রশাসনের তদারকি বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
সবাইকে সঠিক তাপমাত্রায় ওষুধ রাখার পরামর্শ দিতে হবে উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, অনেকে বেশি ওষুধ কিনে ঘরে রাখে। সেগুলোও সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না হলে ওষুধের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। এ বিষয়ে জনগণ, রোগী, ভুক্তভোগী সবাইকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত ফার্মেসি বা ওষুধের দোকানের সংখ্যা ২ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৫টি। এর মধ্যে মাত্র ৫২৮টিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। এর বাইরে বেশিরভাগ দোকানে সঠিক তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ করা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ফার্মাসিউটিক্যাল প্রফেশনালসের (বিএসপিপি) ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রিম ফার্মাসিউটিক্যালসের নির্বাহী পরিচালক আনসারুল ইসলাম সময় সংবাদকে বলেন, ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো ওষুধের গুণগতমান ঠিক রাখতে উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন পর্যায়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) যথাযথ নির্দেশনা অনুসরণ করে। বাজারের ৯০ শতাংশ ওষুধের গায়ে ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রাখার নির্দেশনা রয়েছে।
তার মতে, সমস্যাটি হয় ফার্মেসি বা ওষুধের দোকান পর্যায়ে। ওষুধের দোকানিরা কোল্ড চেইন ব্যবস্থা রাখছেন না। দীর্ঘ সময় ধরে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি থাকলে ওষুধের গুণগত মান কমে যায় বা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।
বিভিন্ন ওষুধের মোড়কে ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণের নির্দেশনা রয়েছে। ছবি সময় সংবাদ
এগুলো তদারকির দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের উল্লেখ করে তিনি বলেন, অতিরিক্ত গরমে অনেক সময় মেয়াদ থাকলেও ওষুধের রঙ পরিবর্তন হয়ে যায়, এমনকি গলে যায়। এক্ষেত্রে বিক্রেতাদের সঙ্গে ক্রেতাদেরও সচেতন হতে হবে। যেসব দোকানে ওষুধের সংরক্ষণ ব্যবস্থা ভালো নয়, সেসব ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। জনবল কম থাকায় দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সঠিকভাবে তদারকি করতে পারে না। তাই স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জাতীয় ওষুধ নীতি-২০১৬-এ বলা হয়েছে, প্রত্যেক ওষুধের দোকানে শীতাপত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা এবং রেফ্রিজারেটর ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক।
এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের উপপরিচালক আশরাফ হোসেন সময় সংবাদকে বলেন, ‘ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে আমরা প্রতিনিয়ত বাজার তদারকি করি। এখনও গুরুতর সমস্যা পাইনি। মাঠ পর্যায়ে অফিসাররা কাজ করছে। টিনের তৈরি ওষুধের দোকানগুলোকে ইতোমধ্যে বন্ধ রাখার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। ফ্যান চালু রাখলেও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। বর্তমানে মেডিসিন লাইসেন্সের কয়েকটি শর্তের মধ্যে শীতাতপসহ অন্য বিষয়গুলো গুরুত্ব দিচ্ছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ সময় সংবাদকে বলেন, ‘নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ করা খুব জরুরি। হাসপাতাল থেকে শুরু করে কোনোখানেই সেটির শতভাগ অনুসরণ হয় না। গরমে অতিরিক্ত তাপমাত্রায় কার্যকারিতা কমে যাওয়া ওষুধ আবার শীতেও বিক্রি হচ্ছে। যে কারণে মানুষের শরীরে ওষুধ কাজ করবে না। সেক্ষেত্রে আরও বেশি ওষুধ সেবনে মানুষ মারা যাবে। তাই এ ধরনের ফার্মেসি বন্ধ করে দিতে হবে। সাধারণ জনগণেরও এ ধরনের দোকান থেকে ওষুধ কেনা বন্ধ করতে হবে।
এক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর, ফার্মেসি কাউন্সিল, ওষুধ মালিক সমিতি, কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি মিলে মাঠপর্যায়ে ওষুধের সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন