দেশে জন্ম নেওয়া প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে ৫১ জনের জন্ম হয় অস্ত্রোপচারে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২৩ সালের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস (এসভিআরএস) প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, দেশে অস্ত্রোপচারে ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শিশুর জন্মের হার ৪৯.৩ শতাংশ। ২০২২ সালে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার ছিল ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থাৎ ২০২২ সালের চেয়ে ২০২৩ সালে সিজারিয়ানে শিশুর জন্ম বেড়েছে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৪ সালে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ২০১০-এ এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ২ শতাংশ। গত ২০ বছরে এ হার বেড়েছে ৪৬.৭১ শতাংশ।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটির (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রাশেদা বেগম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘স্বাভাবিকের চেয়ে যদি সিজারের মাধ্যমে বেশি শিশুর জন্ম হয় তবে তা উদ্বেগজনক। সেসব ক্ষেত্রেই সিজার করা হয় যেসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রসবে মা বা শিশু কিংবা উভয়ের মৃত্যুঝুঁকি থাকে। দেশে সিজারিয়ান বা সি-সেকশন বাড়ছে। এ বিষয়ে নিবিড় তদারকি দরকার।’
২০২২ সালে বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের প্রতিবেদনে অস্ত্রোপচারে জন্ম নেওয়া শিশুদের বিষয়ে উদ্বেগজনক তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০২২ সালে সিজারিয়ান শিশুর ৮৪ শতাংশই হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালে। ১৪ শতাংশ সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে, বাকি ২ শতাংশ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ওই বছর ১৬ লাখের কিছু বেশি শিশুর জন্ম হয় অস্ত্রোপচারে, যার ১০ লাখ ৮০ হাজারই অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে।
মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘যে হারে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুর জন্ম বাড়ছে তা উদ্বেগজনক ও রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। দেশে প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনেই বেশি সিজার করা হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালে যে পরিমাণ সিজার হচ্ছে তার বড় অংশই অপ্রয়োজনে করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের বাণিজ্যিক মনোভাবই এর জন্য দায়ী।’
তারা মনে করেন, মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা বেড়েছে, ফলে সচ্ছল পরিবারের অন্তঃসত্ত¡া নারীরা কষ্ট সহ্য করে ঝুঁকি নিয়ে সন্তান জন্ম দিতে আগ্রহী নয়, এ সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল ও তার চিকিৎসকরা।
অভিভাবকদের বক্তব্য, চিকিৎসকরা বাণিজ্যিক কারণে তাদের ভয় দেখিয়ে সিজার করাতে বাধ্য করেন। কোনো সন্তানের অভিভাবকই জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতে চান না।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রূহী জাকারিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো সিজারের রোগী জোগাড়ের জন্য দালাল নিযুক্ত করে রাখে। তাদের আয়ের অন্যতম উৎস সিজার। এসব চিকিৎসালয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনে সিজার করা হয়। অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধে অনেক দিন ধরে নীতিমালা প্রণয়ন ও তদারকির কথা হচ্ছে কিন্তু হচ্ছে না।’
স্বাভাবিক প্রসব কমছে কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের মায়েরা গর্ভকালীন চেকআপ ঠিকমতো করেন না। এতে নানা জটিলতা দেখা দিলেও তারা তা বুঝতে পারেন না। চিকিৎসকের কাছে যেতে যেতে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। আমাদের দেশে দক্ষ ও প্রয়োজনীয় মিডওয়াইফারি নেই; দক্ষ নার্সেরও ঘাটতি আছে। একজন মায়ের স্বাভাবিক প্রসব করাতে হলে তাকে দীর্ঘ সময় নিবিড় তদারকিতে রাখতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন দক্ষ নার্স ও মিডওয়াইফ। এসব কারণে চিকিৎসকরা সিজারিয়ানে আগ্রহী থাকেন বেশি।’
একজন রোগীর জন্য একজন নার্স ও একজন মিডওয়াইফ প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের এখানে ১০০ জনেও একজন নার্স ও মিডওয়াইফ নেই। জনবলের ঘাটতি অনেক বেশি। নার্স ও মিডওয়াইফের কাজ অন্তঃসত্ত¡ার স্বাস্থ্য মনিটর করা। মনিটরিংয়ের লোক না থাকলে চিকিৎসকরা ঝুঁকি নিতে চান না। গর্ভধারণকালে প্রসবিনীর নিয়মিত চেকআপও হয় না। প্রায় ৫০ ভাগ প্রসবিনী ঠিকমতো চেকআপ করেন না।
বিবিএসের জরিপে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বাসাবাড়িতে শিশুজন্ম ৩২.৭৭ শতাংশ, ২০২২ সালে এ হার ছিল ৪২.৩১ শতাংশ। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে শিশুজন্ম হয়েছে ২৬.৪৩ শতাংশ, ২০২২ সালে ছিল ২৪.০৩ শতাংশ। প্রাইভেট স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ৩৯.৭৬ শতাংশ, ২০২২ সালে ছিল ৩২.৯৩ শতাংশ। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাসাবাড়িতে শিশুর জন্ম কমেছে ৯.৫৪ শতাংশ, অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে শিশুর জন্ম বেড়েছে ৬.৮৩ শতাংশ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন