ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, ইংরেজিতে ঢাকা ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, সংক্ষেপে- ‘ডাকসু’। শিক্ষার্থীদের সরাসরি ভোটে গঠিত ডাকসুকে ‘মিনি পার্লামেন্ট’ গণ্য করার ইতিহাস রয়েছে। যাঁরা ডাকসুর নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরবর্তীকালে তাঁদের কেউ কেউ দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দিয়ে স্বনামখ্যাত। ডাকসুর ডাকসাইটে সেসব নেতা এখনো জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে ভূমিকা রেখে চলছেন। তাঁদের কারও কারও অবস্থা অবশ্য রাজনীতিতে থেকেও না থাকার মতো।
ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) তোফায়েল আহমেদ (১৯৬৮-৬৯) রাজনীতিতে জীবন্ত কিংবদন্তি। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান কাঁপানো সরকার পতন আন্দোলনে তিনি ছিলেন শীর্ষ ছাত্রনেতা। তাঁকে বলা হয় উনসত্তরের গণ আন্দোলনের মহানায়ক। তোফায়েল আহমেদ এখন আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ মোট আটবার তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে পর্যুদস্ত। তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ছিলেন নাজিম কামরান চৌধুরী।
অনলবর্ষী বক্তৃতা করে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করতেন বলে ডাকসুর জিএস (১৯৬৩-৬৪) মতিয়া চৌধুরীকে বলা হতো ‘অগ্নিকন্যা’। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু বামপন্থি ঘরানায়। মতিয়া ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। কৃষিমন্ত্রীও ছিলেন একসময়। সর্বশেষ তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতা ছিলেন। ৮২ বছর বয়সে গত ১৬ অক্টোবর মারা যান মতিয়া চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে ভিপি ছিলেন রাশেদ খান মেনন। যিনি এখন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি। মেনন দায়িত্ব পালন করেছেন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য হিসেবে। গত ৫ আগস্টের পর একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসের সংসদ প্রতিনিধিদের ভোটে ডাকসু নির্বাচিত করার রীতি অনুসৃত হয়েছে অনেক বছর। পালাক্রমে একেক বছর একেক ছাত্রাবাসের বাসিন্দা ডাকসুর ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হতেন। পরোক্ষ এই নিয়ম বলবৎ ছিল ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ভোটে ডাকসু নির্বাচন শুরু ১৯৭০ সালে। সে বছর ভিপি নির্বাচিত হন আ স ম আবদুর রব। তিনি দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম সংগঠক। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-জনতা বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা সর্বপ্রথম উত্তোলন করেন। তিনি এখন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি। তাঁর সঙ্গে জিএস ছিলেন আবদুল কুদ্দুস মাখন। মাখন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা ছিলেন। ১৯৯৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার ফ্লোরিডায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। দেশ স্বাধীনের পর ডাকসু নির্বাচনে প্রথম ভিপি হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বিশিষ্ট বামপন্থি রাজনীতিবিদ এই নেতা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি। তাঁর সঙ্গে জিএস ছিলেন মাহবুব জামান। আখতারুজ্জামান ১৯৭৯ ও ৮০ সালে পরপর দুইবার ডাকসুর জিএস এবং ১৯৮১ সালে ভিপি নির্বাচিত হন। ছাত্ররাজনীতির নানা ধাপ পেরোনো আখতারুজ্জামান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও সুখ্যাত। একাত্তরে তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনী সংঘটনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। আখতারুজ্জামান জিএস থাকাকালে ভিপি ছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। মান্না ভিপি থাকাকালে জিএস ছিলেন জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। বাবলু জাতীয় পার্টির রাজনীতি সঙ্গে যুক্ত হয়ে উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রী হয়েছিলেন। জাতীয় পার্টির মহাসচিবও ছিলেন। তিনি কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। মাহমুুদুর রহমান মান্না ডাকসুতে দুবার ভিপি নির্বাচিত হন যথাক্রমে ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় এই নেতা একসময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি হেরে যান। মান্না এখন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন ১৯৮৯ সালে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাসহ আশির দশকে আন্দোলনেও সক্রিয় অংশ নেন তিনি। একদা ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ওয়ান-ইলেভেনে সময় সংস্কারপন্থি তকমায় দল থেকে ছিটকে পড়েন। সুলতান মনসুরের সঙ্গে জিএস ছিলেন মুশতাক হোসেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন এখন জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য।
১৯৯০ সালের ৬ জুন ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন আমান উল্লাহ আমান। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠিত হয়েছিল। ৯ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হওয়া পর্যন্ত ওই পরিষদ অবিরাম আন্দোলন করে। আমান এখন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। আমানের সঙ্গে জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন খায়রুল কবির খোকন। তিনি এখন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব। এর আগে নরসিংদী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। সর্বশেষ ডাকসু ভিপি নির্বাচিত হন কোটা আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর। তাঁর সঙ্গে জিএস পদে বিজয়ী হন ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। ২০১৯ সালের ১১ মার্চ ভোট গ্রহণ করা হয়। এটিই ডাকসুর সর্বশেষ ভোট। নুরুল হক নুর গণঅধিকার পরিষদ নামে একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি। গোলাম রাব্বানী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে চাঁদাবাজিসহ নানা অনিয়মের জন্য অভিযুক্ত হন। ফলত সংগঠন তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছে। রাব্বানী এখন আওয়ামী লীগের কোনো পদপদবিতে নেই। সম্প্রতি ফেসবুকে রাজনীতিবিষয়ক কিছু স্ট্যাটাস দিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন গোলাম রাব্বানী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন