ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদ আদর্শে বলীয়ান তরুণদের নেতা হয়ে উঠেছিলেন সিরাজুল আলম খান। তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ ফজলুল হক মনি। তাদের এ দ্বন্দ্ব অব্যাহত ছিল স্বাধীনতার পরও। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে ছাত্রলীগের সম্মেলনে শেখ মনির গ্রুপে যোগ দিয়ে সিরাজ গ্রুপকে প্রকাশ্যে অসমর্থন জানান শেখ মুজিব। এরই ধারাবাহিকতায় সিরাজুল আলমের হাতে তৈরি হয় জাসদ
নানা ঘটনাচক্রে ক্রমেই দলের মধ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়েন সিরাজুল আলম খান। এ দুই তরুণের দ্বন্দ্বে দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে কাউকে সমর্থন জানাননি শেখ মুজিব। এ নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি ১৯৭২ সালের অক্টোবরে। একই দিনে একই সময় ভিন্ন দুটি স্থানে ছাত্রলীগের সম্মেলন আয়োজন করে দুই গ্রুপ। সেদিন শেখ মনির গ্রুপ আয়োজিত সম্মেলনে যোগ দেন বঙ্গবন্ধু। এর ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসেন বিক্ষুব্ধ সিরাজুল আলম খান। গড়ে তোলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)।
পর্যবেক্ষকদের মতে, সে সময় দেশের মূলধারার প্রকাশ্য রাজনীতির বড় অনুঘটক হয়ে উঠেছিল এ দুই তরুণের দ্বন্দ্ব। বিষয়টি সে সময় জাতীয় রাজনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয়ও ডেকে এনেছিল।
সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী একদল তরুণ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয় ষাটের দশকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। সে সময় শেখ মুজিবুর রহমানের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বকে কাজে লাগিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সামনে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন তারা। আর শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে তরুণদের আরেকটি গ্রুপ চাইছিল জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে কাজে লাগিয়ে অবিভক্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতির ক্ষমতার ভাগীদার হতে।
শেখ মনি ও সিরাজুল আলম খান—উভয়েই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন ষাটের দশকে। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ মনি। পাকিস্তান সরকারের শিক্ষানীতির প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বর্জনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে আলোচনায় আসেন তিনি।
ছাত্রলীগে সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মনির দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে ১৯৬৩ সালে। সেবার ছাত্রলীগের কাউন্সিল নির্বাচনে শেখ মনি হেরে যান। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সিরাজুল আলম খান। পরে সিরাজুল আলমকে ঘিরে তৈরি হওয়া বলয়টি আওয়ামী লীগের মধ্যেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। তৃণমূলেও অনেক কর্মীর সমর্থনও পান এ ছাত্রনেতা।
তার এ প্রভাব আরো শক্তিশালী হয় ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনের সময়। ওই আন্দোলনে ভূমিকা রাখার জন্য কারারুদ্ধ হন শেখ মনি। অন্যদিকে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আরো শক্তিশালী ভূমিকায় চলে যান সিরাজুল আলম খান। তার এ জায়গা আরো পাকাপোক্ত হয় ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময়। শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ ফজলুল হক মনি তখন কারাগারে বন্দি। তাদের অনুপস্থিতিতে আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ও দল গঠনে ভূমিকা রেখে চলেন সিরাজুল আলম খান। সে সময় কার্যত আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ ছিল সিরাজ গ্রুপের হাতে। তার জাতীয়তাবাদী ধারণায় আকৃষ্ট হয়ে বাম এবং র্যাডিক্যাল ভাবধারার অনেক তরুণ দলটির রাজনীতিতে যুক্ত হন। সে সময় ছাত্রদের নিয়ে গড়ে তোলা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে গণ-আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এতে যুক্ত হন কলকারখানার শ্রমিক ও কৃষকরাও। আইয়ুব খানের শাসনের পতন ঘটে।
সে সময় কৃষক-শ্রমিকদের অংশগ্রহণ সিরাজ গ্রুপের রাজনীতিতে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারাটিকে জোরালো করে তোলে। এতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন সিরাজুল আলম খানের অনুসারী বাম ও র্যাডিক্যাল মনোভাবাপন্ন তরুণরা। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও তাদের রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসে। এসব ভাবনা থেকে তারা শ্রমিক ফ্রন্ট গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন ও শেখ মুজিবকে বোঝাতেও সক্ষম হন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে গঠিত হয় জাতীয় কৃষক লীগ।
সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওই সময়কার এক মূল্যায়ন নথিতে বলা হয়, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের (তৎকালীন) পাকিস্তানের ভেতরে বা বাইরে কোনো ধরনের নীতিগত পরিবর্তনে খুব একটা আগ্রহ নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দলটিও কোনো ধরনের সমালোচনামূলক ভূমিকা নেবে না বলে ধরে নেয়া যায়।
তবে পাকিস্তানিদের ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার ও সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন গ্রুপটির সক্রিয়তায় পরিস্থিতি ভিন্ন হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা। তাদের এ প্রতিরোধকে আরো দৃঢ় ও জোরদার করে তোলেন মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা। তাদের এ ভূমিকায় অভূতপূর্ব সাড়া দেয় বাংলার আপামর জনসাধারণ।
আবার আওয়ামী লীগ এবং ভারত সরকারের কেউ কেউ আশঙ্কা করতে থাকেন, এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে নেতৃত্ব হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে পাকিস্তানে কারাবন্দি থাকা শেখ মুজিবুর রহমান যদি আর ফিরতে না পারেন, তাহলে এ আশঙ্কা বাস্তব রূপ নেয়ার বড় সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করতে থাকেন তারা। উদ্ভূত এ শঙ্কা থেকেই বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ চার ব্যক্তি তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাক খানকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ), যা মুজিব বাহিনী নামেও পরিচিত। অভিযোগ আছে, এটি মূলত শেখ মুজিব এবং তার ঘনিষ্ঠদের স্বার্থরক্ষায় ছাত্রলীগের বিশেষভাবে অনুগত কর্মীদের নিয়ে এ বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল।
ভারতের উত্তর প্রদেশের দেরাদুন এবং আসামের হাফলং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভারতীয়দের তত্ত্বাবধানে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। গেরিলা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ছিল রাজনৈতিক কোর্স মুজিববাদ (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, মুজিববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা)। তাদের যোগাযোগের জন্য ছিল নিজস্ব কোড ও ওয়্যারলেস সিস্টেম। যুদ্ধের পুরো সময় প্রবাসী সরকারের কমান্ড এবং মুক্তিবাহিনী থেকে স্বতন্ত্র অবস্থান ধরে রেখেছিল তারা।
স্বাধীনতার পর শেখ মনি ও সিরাজুল আলম খানের দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এ বিষয়ে লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তাজউদ্দীন আহমদের প্রবাসী সরকারের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর অনেক আগে থেকেই একটি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ছিল। তাই স্বাধীনতার পর মুজিব বাহিনীর লোকেরা নেতৃত্ব নিতে চাইলেন। কিন্তু এ নেতৃত্ব নিয়ে তাদের ভেতরেও একটি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ছিল। মুজিব বাহিনীর মধ্যে শেখ মনি ও সিরাজুল আলম খানের দুটি ভিন্ন ধারা ছিল। এর মধ্যে সংখ্যার হিসাবে সিরাজুল আলম খানের ধারাটি বড় ও শক্তিশালী ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান যখন ফিরে এলেন বাংলাদেশে, তখনো সিরাজুল আলম খান কোনো এক কারণে দেরি হওয়ায় দেশে পৌঁছাননি। ততক্ষণে শেখ মুজিব শেখ মনি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছেন, যেহেতু উনি শেখ মুজিবের আত্মীয় ছিলেন। এছাড়া শেখ মনি নয় মাসের যে ব্রিফ দিয়েছিলেন, সেটি দিয়েও শেখ মুজিব প্রভাবিত হন। সিরাজুল আলম খান যখন দেশে ফিরে এলেন ততক্ষণে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠতা প্রত্যাশায় অনেক পিছিয়ে পড়লেন। এটি হলো তাদের মধ্যে ভাঙনের বাস্তব কারণ।’
স্বাধীনতার পরপরই সিরাজ গ্রুপ তাদের পুরনো বিপ্লবের ধারণাকে সামনে নিয়ে আসে। বাংলাদেশে শেখ মুজিব ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে পাকিস্তান আমলের নির্বাচিত গণপরিষদের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা কায়েমের পরামর্শ দিতে থাকেন তারা। একই সঙ্গে সমাজ বিপ্লবের ধারণাটিকেও সামনে নিয়ে আসা হয়। এজন্য আওয়ামী লীগ ও মুজিব বাহিনীকে একীভূত করার প্রস্তাবও দেয়া হয়। কিন্তু শেখ মুজিব তাদের এ প্রস্তাব নাকচ করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা শুরু করেন।
এর পর সিরাজ গ্রুপ প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। তারা দলের নেতৃত্বের জায়গাগুলো নিজেদের দখলে নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আব্দুর রাজ্জাককে চাইছিলেন সিরাজুল আলম খান ও তার অনুসারীরা। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কার্যত সাধারণ সম্পাদকের হাতেই সব ক্ষমতা। সিরাজুল আলম খানের অনুসারীদের অভিযোগ, এ অবস্থায় তাকে দূরে সরাতে কূটকৌশল অবলম্বন করেন শেখ মুজিব। বিভাজন তৈরি করেন আব্দুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যে। দলের সাধারণ সম্পাদক করা হয় তুলনামূলক কম পরিচিত জিল্লুর রহমানকে। আর আব্দুর রাজ্জাককে করা হয় সাংগঠনিক সম্পাদক।
সে সময় সিরাজুল আলম খানের অন্যতম অনুসারী হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একাংশের নেতা শরীফ নুরুল আম্বিয়া। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সিরাজুল আলম খান এবং শেখ ফজলুল হক মনির মধ্যে রাজনৈতিকভাবে পার্থক্য ছিল। শেখ ফজলুল হক মনি মনে করতেন আগে স্বায়ত্তশাসন করে নেই, পরে স্বাধীনতার কথা ভাবা যাবে। ফলে যারা স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাস করত, তারা শেখ মনির নেতৃত্বে বিশ্বাস করত। আর আমরা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতাম। আমাদের এ স্বাধীনতাপন্থীদের নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। স্বাধীনতার পর আমরা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চাইছিলাম আব্দুর রাজ্জাককে। কিন্তু শেখ সাহেব জিল্লুর রহমানকে এ পদে নিলেন। এছাড়া সিরাজুল আলম খানের দেশ গঠনের চিন্তাভাবনার সঙ্গে শেখ মুজিবের চিন্তাভাবনা মেলেনি। আমাদের ধারণা ছিল জাতীয় সরকার গঠন করে দেশ গঠনের কাজ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের শক্তি দিয়েই দেশের প্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং প্রতিরক্ষা গড়ে উঠবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেটি করলেন না। বরং উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য তিনি শেখ মনিকে সঙ্গ দিলেন।’
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এক প্রকার কোণঠাসা হয়ে পড়ে সিরাজ গ্রুপ। দলটিতে প্রভাব বিস্তার করা তাদের জন্য এক সময় অসম্ভব হয়ে ওঠে। সে সময় দলটির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে তারা।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘১৯৬৩ থেকে ১৯৭১ সাল বিবেচনায় আনা হলে তরুণদের নেতা হিসেবে সিরাজুল আলম খান ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার এ সময়কার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই। স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসন নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয় সত্তরের পর। স্বাধীনতার প্রশ্নে সিরাজুল আলম খান ছিলেন আপসহীন। মনি ভাইয়ের অবস্থান ছিল স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে।’
তিনি আরো বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে মুজিব বাহিনী ছাড়াও রাজনৈতিক যে বিষয়গুলো সামনে এসেছে, সেগুলোর প্রত্যেকটিতে সিরাজুল আলম খানের অবদান ছিল। স্বাধীনতার পর তার অবস্থানটি ছিল জাতীয় সরকার গঠনের পক্ষে। কিন্তু এতে শেখ মনি একাত্মতা পোষণ করেননি। ফলে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে শেখ ফজলুল হক মনির যে দূরত্ব, তেমনই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও একটি কৌশলগত অবস্থান সিরাজুল আলম খান গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে যেভাবে সমন্বয় করার দরকার ছিল সেভাবে করেননি। বরং ছাত্রলীগের একটি অংশে তার উপস্থিতির মধ্য দিয়ে দুটি অংশের দূরত্ব আরো বেড়ে যায়। শুধু দুটি অংশের মধ্যে নয়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও তাদের দূরত্ব বেড়ে যায়। ফলে মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত ফল আমরা উপভোগ করতে পারিনি।’
বাহাত্তরের মাঝামাঝিতে মুজিববাদ ও অ্যান্টি মুজিববাদ—এ দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। মুজিববাদের বিরোধিতা করা গ্রুপটিকে নেতৃত্ব দেন সিরাজুল আলম খান। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের দুর্নীতি, প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে থাকেন। সমাজে ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনতে বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করার কথা বলতে থাকেন। কিন্তু এ গ্রুপটিকে উগ্রপন্থী, সুবিধাবাদীসহ নানাভাবে নিন্দা করতে থাকেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। পরে বাহাত্তরের জুনে মনি ও সিরাজ উভয় গ্রুপের পক্ষ থেকেই কৃষক সংগঠনের কথা তোলা হয়। কিন্তু সিরাজুল আলম খানের জাতীয় কৃষক লীগ দলের প্রধানদের আশীর্বাদ পায়নি। এর পরের মাসেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিরাজ গ্রুপের বিচ্ছেদ ঘটে। সে মাসে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপই একই সঙ্গে তাদের বার্ষিক সম্মেলন আহ্বান করে। দুটি গ্রুপই প্রচার করতে থাকে শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে যুক্ত হবেন। কিন্তু শেখ মনির গ্রুপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শেখ মুজিব।
এদিকে সিরাজ গ্রুপটির ওপর সম্মেলনের শেষ দিন শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের সময় হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তাদের সমর্থকরা আওয়ামী লীগ থেকে সরে যেতে থাকে। দল ছেড়ে দেন গণপরিষদের দুই প্রভাবশালী সদস্য খন্দকার আব্দুল মালেক ও মোশাররফ হোসেন। এতে তারা গণপরিষদেরও সদস্যপদ হারান। সে বছরের অক্টোবরেই গঠিত হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল নামে নতুন এক রাজনৈতিক দল।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন