ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) গণহত্যা, গুম ও ভয়ের সংস্কৃতি, মানবিক মর্যাদা ও সুবিচারের দাবি শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেমিনারে বক্তারা গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলের সকল গুম ও খুনের বিচার দাবি করেন।
আজ বুধবার (১১ ডিসেম্বর) বিকেল ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের মোজাফফর আহমেদ অডিটোরিয়ামে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘সকল প্রাণের নিরাপত্তা- সপ্রাণ’ নামক একটি অরাজনৈতিক সংগঠন এটির আয়োজক।
সেমিনারে অংশ নিয়ে বিশিষ্ট দার্শনিক, ভাবুক ও কবি ফরহাদ মজহার বলেন, যে পরিবারে একজন গুম হয় সেই পরিবারের লোকজন জানে না যে ওই ব্যক্তি বেঁচে আছে নাকি নেই। সেই পরিবারে ওই সময় যে অবস্থা সৃষ্টি হয় তা ভয়াবহ।
তিনি বলেন, আমি নিজেও গুম হয়েছিলাম। আমি ফিরে এসে দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি। এটা সহ্য করা আসলেই কঠিন ছিল। এটা একটা ভয়ংকর অনুভূতি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, পরিবার কিন্তু জানেনা গুম হওয়া ব্যক্তিকে নিয়ে গেছে কোথায়, সেটা কী সত্য না মিথ্যা তা কিন্তু আমরা জানি না। এটা জানবার যে চেষ্টা সেটা উপদেষ্টা সরকারের কাছ থেকে আমরা পাই নাই। যেটা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং আমাদেরকে ক্ষুব্ধ করে। সত্য জানার অধিকার আমাদের আছে। তারা কি মরে গেছে, কে তাদেরকে নিয়ে গেছে, কেন নিয়ে গিয়েছে, কী তাদের ভুল ছিল এই সত্য জানার অধিকার জনগণের আছে।
সেমিনারে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন, গুমের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘মায়ের ডাক' এর সংগঠক সানজিদা তুলি, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহীদুল ইসলাম ভুঁইয়া ও বোন সাইমি ইসলাম ফারিন, মানবাধিকার কর্মী ও নৃবিজ্ঞানী মুশফিকুর রহমান জোহান, গুম ও মানবাধিকার বিষয়ক গবেষক ও নৃবিজ্ঞানী ইসমত আরা বক্তব্য রাখেন।
এসময় মুশফিকুর রহমান জোহান বলেন, গুম কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী গুমের সংখ্যা ১৬০০। আমার ধারণা এই সংখ্যাটা আরও বেশি। যারা ২-৩ দিন গুম ছিল তারা নিজেদেরকে গুম ভাবছে না। অনেকেই এখনও প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না ভয়ে।
শহীদুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, জুলাই আন্দোলনে যে গণহত্যা চালিয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকার, এরকম গণহত্যা আমি আর দেখিনি। আমার ছেলেটার বুকে গুলি করা হয়েছে টার্গেট করে। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তাকে একটু ভালো করে চিকিৎসাও করতে দেয়নি।
তিনি বলেন, আমাদের ছেলেরা যারা জীবন দিয়েছে তাদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। আর কোন ফ্যাসিবাদ যেন এদেশে আসতে না পারে।
ফারহান ফাইয়াজের বোন সাইমি ইসলাম ফারিন বলেন, যাদের কারণে আমার বাবা মা তাদের ছেলেকে হারিয়েছে আমি তাদের বিচার চাই। যেসব আওয়ামী সন্ত্রাসীদের কারণে এত শহীদ হয়েছে আমি চাই তাদের যেন প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হয়। এজন্য এখন আমাদের সকলের উচিত ঐক্যবদ্ধ থাকা।
সানজিদা তুলি বলেন, গুম, খুন আমাদের চোখেই সামনেই করা হচ্ছিল। কিন্তু পুরো দেশ চুপ ছিল। লেখক, সাংবাদিক যারাই কথা বলত তাদেরকেই গুম করে ফেলা হতো। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিরপরাধ বিডিআর সদস্যদের জেলে দেয়া হয়েছে আমাদের চোখের সামনেই। কিন্তু আমরা কিছুই বলতে পারিনি। শাপলা চত্বরে হেফাজতের গণহত্যায় কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তা কেউ জানে না। ইন্টারনেট, টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে এগুলো করা হয়েছে। জুরাইনে গণকবর দেয়া হয়েছে।
নূর খান লিটন বলেন, এই গণহত্যাটা থেমে থেমে হয়েছে। আমরা বলতে পারি এই স্বৈরশাসকের পুরো সময়টায় গণহত্যা চালানো হয়েছে।বিভিন্ন সময় যখন আন্দোলন দানা বেধে উঠছিল তখন যাদেরকেই সন্দেহ হচ্ছিল তাদেরকেই উঠিয়ে নেয়া হতো।
গুম কীভাবে করা হতো তার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, কাউকে কাউকে রাতের অন্ধকারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্রিজে দুই পাশ বন্ধ করে গুলি করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো লাশ নিয়ে গিয়ে ট্রেন লাইনের উপর রাখা হয়েছে। কাউকে কাউকে চলন্ত বাস বা ট্রাকের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে রাতের অন্ধকারে। ১৫ সালে একজন নারী কক্সবাজার থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। তাকে উঠিয়ে নেওয়া হয় তার সন্তান সহ। সন্তানকে প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয় কমলাপুরের কাছে। আর ভদ্র মহিলার এখন পর্যন্ত আমরা কোন সন্তান জানি না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন