বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের সময় ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করেছিল পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। সন্ত্রাস দমনে নিজেদের গড়া সেই বাহিনীকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে দলটি। বিএনপির পক্ষ থেকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে ৬ ডিসেম্বর দাখিল করা সুপারিশমালায় এ প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ বাহিনী গড়তে এবং মানবাধিকারের প্রতি আরও সচেতন করতে মোট ১৭ দফা সুপারিশ করেছে বিএনপি। এতে পুলিশের অযৌক্তিক বলপ্রয়োগ এবং নিষ্ঠুর আচরণের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণেরও প্রস্তাব করা হয়েছে।
পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে থাকা র্যাব ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজ র্যাবকে দেশে সংঘটিত গুম, খুন, নির্যাতন ও নিপীড়নের জন্য দায়ী করে আসছে। র্যাবের সাবেক দুই ডিজিসহ কয়েক কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিএনপির আমলে র্যাব প্রতিষ্ঠা হলেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিশেষায়িত এই বাহিনী গুম-খুনসহ একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে আসে। ২০১৪ সালে র্যাবের একদল সদস্য নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডারের ঘটনা ঘটায়। এমন সব প্রেক্ষাপটে র্যাবকে বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয়েছে। র্যাবের দায়িত্ব যাতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং থানা পুলিশ পালন করতে পারে, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
পুলিশ প্রশাসন সংস্কারে প্রস্তাবনা তৈরি করতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রমের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি কমিটি করেছিল দলটি। ওই কমিটি পরে একাধিক বৈঠক ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে মত বিনিময় করে এই প্রস্তাবনা তৈরি করে।
দলটির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, বিএনপি গঠিত পুলিশ প্রশাসন সংস্কার বিষয়ক কমিটি আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করবে।
পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান সফর রাজ হোসেন গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপির প্রস্তাবনা তারা পেয়েছেন। দলটির প্রস্তাবনাগুলো ইতোমধ্যে তারা পর্যালোচনা করেছেন। সরকারের কাছে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দিতে তারা ড্রাফট লিখছেন বলেও জানান সফর রাজ হোসেন।
পুলিশ সংস্কার কমিশনে দাখিল করা বিএনপির সুপারিশমালায় বলা হয়েছে, পুলিশ কর্তৃক বেআইনিভাবে আটক, গ্রেপ্তার, তুলে নিয়ে অস্বীকার করা, যতদিন খুশি আটক ও গুম করে রাখার ঘটনা বাধাহীনভাবে চলেছে পতিত হাসিনা সরকারের আমলে। বিএনপি এই অপসংস্কৃতির অবসান চায়। এজন্য দলটি পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ ও বেআইনি আটক, গুম ঠেকাতে গ্রেপ্তার তথ্য বিষয়ক একটি ফরম তৈরির সুপারিশ করেছে। ওই ফর্মে আটক/গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির তথ্য, গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং ইউনিট প্রধান স্বাক্ষর করবেন। ফর্মের একটি কপি গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে প্রদান করার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবে। এ ছাড়া আটক কিংবা গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করতেও প্রস্তাব করা হয়েছে।
পুলিশের নিয়োগের ক্ষেত্রে চার প্রকার পদে নিয়োগের পরিবর্তে দুই স্তরে নিয়োগ ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম স্তরে কনস্টেবল পদে নিয়োগ এবং দ্বিতীয় স্তরে সহকারী পুলিশ সুপার পদে নিয়োগ। বর্তমানে পুলিশে চারটি পদে কনস্টেবল, সার্জেন্ট, এসআই এবং বিসিএসের মাধ্যমে এএসপি পদে নিয়োগ হয়। বিএনপির সুপারিশে সার্জেন্ট এবং এসআই পদে নিয়োগ বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। কনস্টেবল পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা নির্দিষ্ট চাকরির মেয়াদ শেষে বিভাগীয় পদোন্নতির মাধ্যমে এএসআই, এসআই ও ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পাবেন। এতে ওই পদগুলোয় পদোন্নতির অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হবে।
পুলিশে চাকরি করতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের হয়রানি কমাতে প্রাক পরিচিতি যাচাইয়ের ক্ষেত্রে প্রার্থীর নাম ঠিকানা সঠিক আছে কিনা, তার বিরুদ্ধে আমলযোগ্য অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ আছে কিনা, আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে কিনা- শুধুমাত্র এসব তথ্য যাচাই করতে এবং পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ছাড়া অন্য কোনো সংস্থাকে ভেরিফিকেশনের কাজে সম্পৃক্ত না করার সুপারিশ করা হয়েছে।
পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ঠেকাতে পুলিশ সদর দপ্তরে কেন্দ্রীভূত আর্থিক ক্ষমতাকে মাঠ পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ক্রয় সংক্রান্ত যে কোনো ক্ষমতা সদর দপ্তরের পরিবর্তে আগের মতো মাঠ প্রশাসনে ফিরিয়ে দেওয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে।
বেনজীর আহমেদ পুলিশ প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর পুলিশের অধিকাংশ কেনাকাটা করার ক্ষমতা পুলিশ সদর দপ্তরে আনা হয়। এর আগে বেশির ভাগ কেনাকাটা জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়সহ বিভিন্ন ইউনিট করে থাকত বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির প্রস্তাবে অধস্তন পুলিশ সদস্যদের বদলির ক্ষেত্রে বর্তমানে তিন থেকে চার স্তরে অতিক্রম করে মূল বদলি স্থলে যেতে হয়। এক্ষেত্রে অনেক সময় তাদের হয়রানি হতে হয়। তাদের এই হয়রানি ঠেকাতে সর্বোচ্চ দুই স্তর করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
পুলিশ বাহিনীকে সঠিক দিকনির্দেশনা, পরামর্শ ও সহায়তা প্রদানের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতিকে চেয়ারম্যান করে একটি পুলিশ কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। জাতীয় সংসদ বলবৎ না থাকলে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারক। কমিশনে আটজন সদস্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উচ্চ আদালতের আইনজীবী এবং সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকদেরও কমিশনে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
স্থানীয় পর্যায়ে পুলিশকে অপরাধ দমনে সহায়তা প্রদান, জনসাধারণের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক উন্নয়ন ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পরামর্শ প্রদানের জন্য প্রত্যেক উপজেলা ও থানায় একটি নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। দুই বছরের জন্য এই কমিটি গঠিত হবে।
পুলিশের সকল অফিসার ও ফোর্সের জন্য একটি ক্যারিয়ার প্লানিং রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। পুলিশের মাঠ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, জেলার এসপি, রেঞ্জ ডিআইজি এবং পুলিশ কমিশনার পদে পদায়নের জন্য প্রতি ৬ মাস অন্তর একটি ফিটলিস্ট করারও প্রস্তাব করা হয়েছে। নীতিমালা অনুসরণ ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে ওই ফিটলিস্ট থেকে পর্যায়ক্রমে পদায়নের ব্যবস্থা রাখা।
নিম্ন আদালতে সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনায় আগের মতো কোর্ট পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত হবে, জনভোগান্তি কমবে এবং কোর্টের সঠিক বিচারকাজ পরিচালনায় পুলিশকে আরও জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাবে বলে বিএনপির সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
পদোন্নতির ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারী আইন ২০১৮-এর বিধান সঠিকভাবে পালন করতে হবে। ওই আইনে পদোন্নতির জন্য ৬টি শর্তের কথা উল্লেখ আছে। কোনো কারণে উপযুক্ত কাউকে পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব না হলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে লিখিত আকারে অবহিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
মানবাধিকার ও শৃঙ্খলা রক্ষায় শক্তি প্রয়োগ বিষয়ে আরও জোরালো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করারও প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিয়ন্ত্রণে শক্তি প্রয়োগের ধারাবাহিকতার গাইডলাইন সঠিকভাবে শেখাতে হবে। সর্বনিম্ন, সমানুপাতিক ও আইনসিদ্ধ শক্তি প্রয়োগ করার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া মব সাইকোলজি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
পুলিশের কনস্টেবল থেকে এসআই পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী দিনে আট ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা নির্ধারণ করে সপ্তাহে পূর্ণ একদিন ছুটি ভোগের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয় বা জরুরি প্রয়োজনে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করাতে হলে আন্তর্জাতিক ও সর্বজনীন বিধি অনুযায়ী তাদের ভাতা প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। পদায়নের ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের নিজ নিজ জেলার নিকটবর্তী জেলাসমূহে পদায়নের ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। যাতে তারা স্বল্পখরচে পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করার সুযোগ পান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন