খুলনা নগরীর বি কে রায় রোডে বাড়ি রয়েছে কামরুল ইসলাম বাবলুর। সুইচ বাংলাদেশ নামে একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি। তার পরও তিনি নিজেকে অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবী দাবি করে প্রতিবছর ১৪ হাজার ৪০০ টাকা ভাতা তুলতেন। বাবলু খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক।
নগরীর দারোগাপাড়া এলাকায় পাঁচতলা বাড়ি রয়েছে এ বি এম মোখলেসুর রহমানের। তিনিও বাবলু নামে পরিচিত। খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের এই সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদকও অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীর ভাতা নেন।
কামরুল ইসলাম বাবলু ও মোখলেসুর রহমান বাবলু দুটি উদাহরণ মাত্র। অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীদের জীবন ধারণের জন্য সরকারের দেওয়া সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতা এবং সংগঠন পরিচালনার জন্য অনুদান নানাভাবে হরিলুট হয়েছে গত ১৫ বছর। রাজনৈতিক বিবেচনায় ভাতা প্রদান করায় বঞ্চিত হয়েছেন প্রকৃত সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠকরা। এখনও এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।
অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীদের জীবন ধারণের জন্য প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ প্রদান করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রতিবছর এই টাকা মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি ব্যক্তিদের মোবাইল ফোন নম্বর বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারা ভাতা পাওয়ার যোগ্য এবং কারা অযোগ্য, তা যাচাইয়ের জন্য নীতিমালা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
আর্থিকভাবে অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীদের ভাতা মঞ্জুরি নীতিমালার ৫ ধারায় ‘আর্থিকভাবে অসচ্ছল’ ব্যক্তির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘কোন সংস্কৃতিসেবী বার্ধক্যজনিত, শারীরিক অক্ষমতা, দুর্ঘটনাজনিত ইত্যাদি কারণে উপার্জনে অক্ষম অথবা অন্য কোনো উৎস হতে জীবন ধারণের জন্য সন্তোষজনক আয় নেই এমন ব্যক্তিকেই বুঝাবে।’ আওয়ামী লীগ নেতারা এর কিছুই মানেননি।
বিকল্প আয়ের উৎস থাকা সত্ত্বেও কেন ভাতা নেন, জানতে চাইলে কামরুল ইসলাম বাবুল বলেন, ‘বিদ্যালয় থেকে দুই বছর আগে অবসর নিয়েছি। আমার আয়ের কোনো উৎস নেই।’ অবসরের আগে ভাতা নিতেন কেন– জানতে চাইতে তিনি বলেন, ‘মহানগরের সম্পাদক পদে থাকলেও ওই ধরনের আওয়ামী লীগ আমি করতাম না। এ জন্য সব সময় আমার টানাটানি ছিল।’
খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে ভাতাপ্রাপ্ত সংস্কৃতিসেবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা নেই। বিভিন্ন সময় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের চিঠি ঘেঁটে ভাতাভোগী ১১০ জনের নাম পাওয়া গেছে। তালিকার শুরুতেই রয়েছেন এম এম জাফর ইকবাল। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদসহ এমন একাধিক সংগঠনের সভাপতি তিনি। খুলনা মহানগরীতে বসবাসরতদের মধ্যে তিনি সর্বোচ্চ ২৮ হাজার ৮০০ টাকা ভাতা পান।
সংস্কৃতিকর্মীরা জানান, বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করেই বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুদান এবং ভাতা সংগ্রহ করাই ছিল জাফর ইকবালের কাজ। অবশ্য জাফর ইকবাল বলেন, বিকল্প আয়ের উৎস না থাকায় ভাতা নিতাম। আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ভাতা উত্তোলনের অভিযোগ সঠিক নয়।
সংস্কৃতিকর্মীরা জানান, কে ভাতা পাবেন, কারা পাবেন না– আওয়ামী লীগ নেতারাই তা ঠিক করে দিতেন। যার কারণে বিকল্প আয়ের উৎস থাকা সত্ত্বেও অনেকে বছরের পর বছর ধরে অসচ্ছল শিল্পীর ভাতা পাচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে খুলনার সরকারি সুন্দরবন কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক সুশান্ত সরকার, ক্ল্যাসিক সংগীত একাডেমির অসীম কুমার নীল মনি, অগ্রণী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ইকবাল মাহমুদ ও হোমিও চিকিৎসক সিদ্ধেশ্বরী রায়।
চলতি বছর ভাতার জন্য ২০ জন অসচ্ছল শিল্পীর তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল জেলা শিল্পকলা একাডেমি। এর মধ্যে ১২ জনকে মন্ত্রণালয় থেকে বাদ দিয়ে অন্য ১২ জনের নাম ঢোকানো হয়।
খুলনা জেলা কালচারাল অফিসার সুজিত কুমার সাহা বলেন, অসচ্ছল ভাতার তালিকায় কীভাবে নাম ঢুকত, কীভাবে বাদ পড়ত, আমরা জানতেও পারতাম না। আমরা সুপারিশ পাঠাতাম। মন্ত্রণালয়ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিত।
ভুয়া সংগঠনকে লাখ লাখ টাকা অনুদান
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী খুলনা মহানগর নামের সংগঠন চালু করেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এম জাফর ইকবাল। বছরে সংগঠনটি ৬০ হাজার টাকা অনুদান পায়।
পরের বছর স্ত্রীর নামে চালু করেন
বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী খুলনা জেলা শাখা। এই সংগঠনে অনুদান দেওয়া হতো ৬০ হাজার টাকা। এ ছাড়া আওয়ামী শিল্পীগোষ্ঠী বছরে ৩০ হাজার, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট ৩০ হাজার এবং বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা ৩০ হাজার টাকা অনুদান পেত।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান অনুদান মঞ্জুরি নীতিমালার ৮ নম্বর ধারার খ উপধারায় বলা হয়েছে, নিয়মিতভাবে সংগীত, নৃত্য, নাটক, চারুকলাবিষয়ক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে এমন প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠী অনুদান পাওয়ার যোগ্য হবেন।
কিন্তু সংগঠন বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এর কিছুই মানা হতো না। দেখা গেছে, একই শিল্পী, একই ব্যক্তি বিভিন্ন নামে সংগঠন চালু করতেন। এর পর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুদান বাণিজ্যে নেমে পড়তেন।
বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট পরিচালনা করতেন কামরুল ইসলাম বাবলু। আবার নিজ বাড়িতে সংগীত নিকেতন নামে সংগঠন খুলে সেই নামেও অর্থ বরাদ্দ নিতেন। অনুদান মঞ্জুরি নীতিমালার ১৩ ধারার খ উপধারায় বলা হয়েছে, নাট্যগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন ও মঞ্চায়িত নাটকের সফলতা, কর্মশালা আয়োজন ইত্যাদি বিবেচনায় আনা হবে।
কিন্তু নাটক না করেই বছর বছর অনুদান নিয়েছে নাট্যলোক, মঞ্চ সৈনিক ও সুপ্তাগ্নি নাট্য সংস্থা। কার্যক্রম নেই নিয়মিত অনুদান তুলতেন এমন সংগঠনের সংখ্যা অনেক। এ ব্যাপারে জেলা কালচারাল অফিসার সুজিত কুমার সাহা বলেন, পুরোনো সব সংগঠন বাদ দিয়ে সক্রিয় ২৫টি সংগঠনের নতুন তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আগামীতে প্রকৃত সংগঠন অনুদান পাবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন