আ.লীগকে আগামী নির্বাচনে চায় জাতীয় পার্টি
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা উচিত হবে না। আওয়ামী লীগের যারা দোষ করেছে তাদের তদন্তের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করুন। আন্দাজে মামলা দিয়ে কাউকেই শাস্তি দেওয়া ঠিক নয়। একটি সংগঠনের সবাই কি অপরাধী? যদি তাই ভাবেন তাহলে শেখ হাসিনার সঙ্গে আপনাদের তফাৎ কি?
জিএম কাদের বলেন, শেখ হাসিনা মনে করতো বিএনপি ও জামায়াত করলেই অপরাধী, এখন তো আপনারা সেটাই করছেন। আমরা চাই আগামী নির্বাচনে সব দল অংশ নিক। যাদের নিবন্ধন দিয়েছেন তাদের কেন নির্বাচনে আসতে দেবেন না?
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে জিএম কাদের বলেন, কোনো আগ্রাসন এলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা তা প্রতিহত করবো। এটার জন্য গলাবাজির দরকার নাই। কেউ কেউ বলেন, আগ্রাসন এলে এক ইঞ্চিও ছাড় দেব না। কে আপনাকে ছাড় দিতে বলে? আমাদের দেশে আর্মি আছে, বিজিবি আছে না?
শনিবার দুপুরে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে সংবিধান সংরক্ষণ দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
জিএম কাদের বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৩০টি আসন। তাদের ভোটের হার ছিল ৪৮.০৪। বিএনপি পেয়েছিল ৩০টি আসন। তাদের ভোটের হার ছিল ৩২.০৫। জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ২৭টি আসন। ভোটের হার ছিল ০৭.০৭। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে বাদ দিলে দেশের ৫০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী দলকে জাতীয় ঐক্যের ডাকের বাইরে রাখা হয়েছে। ৫০ শতাংশ মানুষের দলকে সংলাপের বাইরে রাখা হয়েছে। এতে জাতিগতভাবে অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। দেশে একটা অবিশ্বাস ও সংঘাতময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদাররা বলেছিল আমরা মানুষ চাই না, মাটি চাই। পোড়ামাটি নীতিতে মানুষকে গাদ্দার মনে করা হয়েছিল। ৫০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী দলকে বাদ দিয়ে সুন্দর দেশ গড়া বাস্তবসম্মত নয়।
তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল মিটিং করা সাংবিধানিক অধিকার। তা আমাদের দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের পার্টি অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে সেলফসেন্সরশিপ চলছে। সাংবাদিকরা ভয়ভীতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আমাদের পাসপোর্ট দেওয়া হচ্ছে না। পাসপোর্ট পাওয়া আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। নির্বিচারে আমাদের লোকদের মিথ্যা মামলায় জড়ানো হচ্ছে। আমাদের নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে, গ্রেফতার করা হচ্ছে কিন্তু জামিন দেওয়া হচ্ছে না। আমরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছি। ৩০ নভেম্বর প্রকাশিত একটি পত্রিকায় দেখেছি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, রাষ্ট্রসংস্কার ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চলে গেলে এই প্রজন্ম আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। অত্যন্ত সত্য কথা। আন্দোলনটা ছিল শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা। কারণ, শেখ হাসিনা বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিল। শেখ হাসিনার লোকজন লুটপাট করে দেশটা শেষ করে দিয়েছিল। একটি সুন্দর নির্বাচনের মাধ্যমেই জাতির মুক্তি মিলবে। যে নির্বাচনের মাধ্যমে সব ধরনের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে একটি সরকার গঠিত হবে।
জিএম কাদের বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের রায়ে শেখ হাসিনা নির্বাচিত হয়ে দানবীয় সরকার গঠন করেছিল। এটা থেকে পরিত্রাণ পেতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সংস্কার চাই। বৈষম্যমুক্ত সমাজের জন্য শুধু ছাত্র না আজীবন সব শ্রেণিপেশার মানুষ যুদ্ধ করেছে। বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়তে জাতীয় ঐক্য দরকার। সংস্কারে সবার মতামত দরকার আছে, পরবর্তীতে এটি সংসদেও পাশ করতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি সবার মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার করছে? এখন দেখা যাচ্ছে ঐক্যের চেয়ে প্রতিশোধের বিষয়টি সামনে আসছে। কেউ অপরাধ করলে বিচার করতে হবে, সরকার প্রতিশোধপরায়ন হলে বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। আইনে বলা আছে ১০টি অপরাধী ছাড়া পেলেও যেন একজন নিরপরাধ শাস্তি না পায়। আপনারা সেটা ফলো করছেন? হত্যা মামলায় লাখ লাখ মানুষকে আসামি করা হচ্ছে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আরও বলেন, ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর সাংবিধানিকভাবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। ভালো নির্বাচন হবে, আরও ভালো গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হবে- এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল তিন জোটের রূপ রেখায়। তাতে কমিটমেন্ট ছিল দেশ সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত হবে। তাদের এই অঙ্গীকারে শ্রদ্ধাশীল হয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। তিনি মনে করেছিলেন, জনগণ এমন প্রত্যাশা করছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সবসময় জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করেছেন। একইভাবে তিনি ক্ষমতা গ্রহণও করেছিলেন জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী। বিএনপির কিছু নেতাসহ সব রাজনৈতিক দল তখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে স্বাগত জানিয়েছিল। পরবর্তীতে অনেকে বলেছে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। কখনো কখনো অসাংবিধানিকভাবেও ক্ষমতা গ্রহণ করতে হয়, এটা এখন সবাই বুঝতে পেরেছেন। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে কখনো অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করা হলেও তা কখনো কখনো নিন্দনীয় নয়। এটা এখন প্রমাণ হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্বৈরাচার ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন সবচেয়ে বেশি গণতন্ত্রমনা রাষ্ট্রপ্রধান। দেশের জনগণ যখন যা প্রত্যাশা করেছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তা পালন করেছেন।
তিনি বলেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যনীতি করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তখন জনগণের একটি অংশ থেকে বাধা আসায় তিনি তা বাস্তবায়ন করেননি। এখন অবশ্য অনেকেই বলেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উদ্যোগই সঠিক ছিল। উপজেলা পরিষদের নির্বাচনও দিয়েছিলেন যখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন করতে সম্মত হয়েছিল। হুসেইন মহুম্মদ এরশাদ সবার সম্মতি নিয়েই ওষুধ নীতি করেছিলেন, দেশের মানুষ এখন তার সুফল ভোগ করছে। তিনি বিচার ব্যবস্থা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে বিভাগীয় শহরগুলোতে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু যখন আদালত এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে রায় দিয়েছে, তখন আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেছেন। বিরোধী দলগুলোর আহ্বানে তিনি পদত্যাগ করে নির্বাচন দিতে রাজি হয়েছিলেন। ওই সময় বিরোধী দলগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পরবর্তীতে তার একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জানতেন জনগণের সমর্থন জাতীয় পার্টির ওপর আছে। সেটা প্রমাণ হয়েছে পরপর দুইটি নির্বাচনে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কারাগারে থেকে ৫টি করে আসনে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আমৃত্য কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি তিনি।
জিএম কাদের বলেন, কয়েকদিন আগে প্রধান উপদেষ্টা একটি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। এতে জাতীয় ঐক্যের নামে জাতীয় অনৈক্যের সূচনা হলো। ৪৮টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে মাত্র ১৮টি দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন তিনি। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। সেই নির্বাচন দুটি ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০১ সালে বিএনপি ১৯৩টি আসন জিতে সরকার গঠন করেছিল। সেই নির্বাচনে বিএনপি ৪০.৯৭ ভোট পেয়েছিল। আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে বিএনপির চেয়ে ১৩১ সিট কম পেয়ে খুব খারাপ ফলাফল করেছিল। আওয়ামী লীগের ভোটের পার্সেন্টেস ছিল ৪০.১৩। সেখানে ভোটের শতকরা ব্যবধান ছিল ১ শতাংশেরও কম। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৪টি আসনে জয়ী হয়। জাতীয় পার্টি ভোট পেয়েছিল শতকরা ৭.২৫। ২০০১ সালে জামায়াত পেয়েছিল ১৭টি আসন। তাদের শতকরা ভোটের হার ছিল ৪.২৮।
সংবিধান সংরক্ষণ দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন- পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট মো. রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া।
উপস্থিত ছিলেন- প্রেসিডিয়াম সদস্য নাজমা আখতার, আলমগীর সিকদার লোটন, লিয়াকত হোসেন খোকা, শেরীফা কাদের, মাসরুর মওলা, উপদেষ্টা ড. নুরুল আজহার শামীম, অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম তালুকদার, নোমান মিয়া, অ্যাডভোকেট লাকী বেগম, ইঞ্জিনিয়ার মনির আহমেদ, প্রিন্সিপাল গোলাম মোস্তফা, মো. খলিলুর রহমান খলিল, মো. জাহিদ হাসান, মাইনুর রাব্বী চৌধুরী রুম্মন, গোলাম রহমান মামুন, মেজর অব. মাহফুজুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ রাজু, সুলতান আহমেদ সেলিম, শেখ আলমগীর হোসেন, আমির উদ্দিন আহমেদ ডালু, আহাদ ইউ চৌধুরী শাহীন, মো. হেলাল উদ্দিন, যুগ্ম মহাসচিব মো. আমির হোসেন ভূঁইয়া, আব্দুল হামিদ ভাষানী, এবিএম লিয়াকত হোসেন চাকলাদার, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শাহজাহান মানসুর, মো. হুমায়ুন খান, জয়নাল আবেদীন, মো. আব্দুল হান্নান, সোহেল রহমান, এমএ রাজ্জাক খান, মিজানুর রহমান মিরু, জামাল উদ্দিন, ইব্রাহিম খান জুয়েল, ইঞ্জিনিয়ার এলাহান উদ্দিন, যুগ্ম সম্পাদক আজহারুল ইসলাম সরকার, প্রিন্সিপাল মোস্তফা চৌধুরী, শরিফুল ইসলাম চৌধুরী অর্ণব, অ্যাডভোকেট আবু তৈয়ব, মাহমুদ আলম, শেখ মো. শান্ত, কেন্দ্রীয় নেতা মো. সামছুল হুদা মিয়া, মো. রেজাউল করিম, হুমায়ুন কবির শাওন, ওমর আলী মান্নাফ, আলাউদ্দিন আহমেদ, মো. আলমগীর হোসেন, নজরুল ইসলাম সরদার, মোতাহার হোসেন শাহীন, তাসলিমা আকবর রুনা, জেসমিন নূর প্রিয়াংকা, সোলায়মান সামি, মেহেদী হাসান শিপন, শাহ্ ইমরান রিপন, আল আমিন সরকার, নাজমুল হাসান রেজা, পারভেজ সাজ্জাদ, মাহমুদ হক মনি। ছাত্র সমাজের আহ্বায়ক মারুফ ইসলাম প্রিন্স, তরুণ পার্টির সদস্য সচিব মোড়ল জিয়াউর রহমান, সাংস্কৃতিক পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক ওমর ফারুক সুজন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন