বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ পালনের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ছাত্র সংগঠনগুলোর এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে মতবিনিময় সভায় ছাত্রশিবিরের নেতৃবৃন্দ থাকায় এতে যোগ দেয়নি ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ। তাছাড়া উপস্থিত হয়নি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও। তাদের অনুপস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভক্তির রাজনীতির সূচনা করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রবিবার (১ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টায় এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তারা হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ইসলামী ছাত্রশিবির, জাতীয় নাগরিক কমিটি, ছাত্রঅধিকার পরিষদ, ইসলামী ছাত্র মজলিস, বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, স্টুডেন্ট’স এল্যায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতা ও অধিকার রক্ষা পরিষদ। প্রত্যেক সংগঠনের প্রতিনিধি জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে তাদের অবস্থান, সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরেন।
এদিকে সভায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাম সংগঠনগুলো অনুপস্থিত থাকায় এ নিয়ে ফেসবুকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আলোচনা-সমালোচনা করছেন। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির সহাবস্থানের বিষয়টি নিয়েও উদ্বেগ দেখা গেছে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের মাঝে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, কে কত বড় সংগঠন তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কে কতটুকু শিক্ষার্থীদের পক্ষে রয়েছে। অনেকে বলছেন জুলাই আন্দোলনে আমরা ছাত্র সংগঠনের অবদান অস্বীকার করছি। কিন্তু আমি এটা বিশ্বাস করি না। কখনোই আমরা এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি কারো অবদান অস্বীকার করিনি। আমি মনে করি ছাত্র সংগঠনগুলো পেছনে ছিল বলেই আজকে আমরা সামনে আসতে পেরেছি। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়েছি। একইভাবে সামনেও ফ্যাসিবাদকে নির্মূল করতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
ছাত্রদল ও বাম সংগঠনগুলো অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, খুবই দুঃখ লাগছে আজকে বৃহৎ একটি ছাত্র সংগঠন এবং অনেকগুলো ক্রিয়াশীল সংগঠন উপস্থিত নেই। আপনাদের রাগ অভিমান থাকতে পারে। এগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। কিন্তু আপনারা যদি না আসেন তাহলে সমাধানের সুযোগ তো তৈরি হচ্ছে না।
সভায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের শাখা সেক্রেটারি মুহাম্মাদ ইব্রাহীম বলেন, ৫ আগস্টের পর ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের এখনো মাঠে থাকতে হচ্ছে। আইনের শিথিলতার অভাবে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন সমস্যা, প্রতিবিপ্লব ঠেকানোর দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের উপর এসে পড়ছে। অথচ তাদের এখন রাষ্ট্র গঠনে সভা-সেমিনার এবং সিম্পোজিয়াম করার কথা। সংস্কার প্রক্রিয়া কিভাবে হওয়া উচিত তা দেখানোর কথা। আমার প্রশ্ন হচ্ছে প্রশাসনের কাজ কি? প্রতিবিপ্লব ঠেকানোর দায়িত্ব পলিসি মেকারদের। কিন্তু তারা যদি শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পেছনে অন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তাহলে ভুল করবে। দেখা যাবে শিক্ষার্থীরা তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য জোবায়রুল হাসান আরিফ বলেন, জাতীয় নাগরিক কমিটির দুইটা উদ্বেগ রয়েছে। একটি হচ্ছে জুলাই গণহত্যার বিচার। আমরা দেখছি জুলাইয়ের বিচার সঠিকভাবে হচ্ছে না। আবার আমরা মবেরও পক্ষে না। আমরা আইনের মাধ্যমে এমনভাবে বিচার করতে চাই যাতে কখনো কেউ বলতে না পারে ক্যাঙারু কোর্টের মাধ্যমে খুনীদের বিচার হয়েছে। আমাদের আরেকটি কনসার্ন সংবিধান সংস্কার। আপনারা দেখবেন আমাদের সংবিধানের পাওয়ার স্ট্রাকচার এমন, যে কেউ স্বৈরাচার হতে বাধ্য। আমরা এমন সংস্কার চাই যাতে সাংবিধানিকভাবে কেউ নতুন হাসিনা হতে না পারে।
ইসলামী ছাত্র মজলিস চবি শাখার সভাপতি সাকিব মাহমুদ রুমি বলেন, আফসোস হচ্ছে মুখে আমরা ঐক্য এবং সংহতির কথা বলি। কিন্তু আজকে সংহতি সভায় অনেক ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন উপস্থিত নেই। সংহতি কি শুধুই ব্যানারে দেখানোর জন্য? রাজনৈতিক যেই প্যারামিটার দিয়ে আমরা ছাত্রলীগকে মাপি তা অন্য সংগঠনের সাথে যায় না। আমরা বিশ্বাস করি ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল অন্য সবার থেকে ভিন্ন। ছাত্রলীগের সাথে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্র মজলিসসহ অন্যান্য সংগঠনের যে দ্বন্দ্ব ছিল তা অন্য সংগঠনের সাথে থাকতে পারে না। কিন্তু ২৪-এর পরেও যদি আমরা একই দ্বন্দ্ব ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবির বা অন্য সংগঠনের মধ্যে দেখি তাহলে তা অপ্রত্যাশিত।
ছাত্র অধিকার পরিষদের সদস্য সচিব মো. রোমান রহমান বলেন, জুলাই বিপ্লবে ছাত্রদলের একটা বড় অবদান ছিল। কিন্তু আজকে ছাত্রদল উপস্থিত নেই যেটা হতাশজনক। আমরা সকলে দলের মধ্যে যদি ঐক্য ধরে রাখতে না পারি তাহলে শিক্ষার্থীদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। শিক্ষার্থীরা সকলের মধ্যে ঐক্য চায়, বিভেদ নয়।
ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের প্রকাশনা ও দপ্তর সম্পাদক মো. আমিনুল ইসলাম রাকিব বলেন, আমাদের ছাত্র সংহতি শুধুই এক সপ্তাহের জন্য হওয়া উচিত না। এটা যতদিন পর্যন্ত একটা স্ট্যাবল সরকার আসবে ততদিন থাকা উচিত। কারণ ফ্যাসিবাদীদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকে না। কখনো তারা রিকশাচালক লীগ, কখনো ইসকন লীগ, কখনো সাকিব লীগ হয়ে ফেরত আসবে।
অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে ছাত্র ইউনিয়নের চবি শাখার সভাপতি সুদীপ্ত চাকমা বলেন, অংশগ্রহণ না করাটা আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত যেটা কেন্দ্র থেকে নেওয়া হয়েছে। ছাত্রশিবিরের সাথে কোন ধরনের বৈঠকে আমরা বসব না। তবে ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও ছাত্রদলের কোন নেতার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন ঠেকাতে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলমান অস্থিরতা নিরসনের লক্ষ্যে ২৫ নভেম্বর এক সপ্তাহব্যাপী ফ্যাসিবাদবিরোধী সব ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ পালনের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন