এমনটি আমি কোনো দিন দেখিনি। কোথাও শুনিনি কিংবা বইপুস্তকে পড়িনি। ইতিহাস-রাজনীতি-আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছি। বহু দেশে গিয়েছি, বহু নাটক-সিনেমা গল্প-উপন্যাস পড়েছি কিন্তু ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যা দেখেছি তা কোথাও দেখিনি। আলোচনার শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে রাজনীতি একটি বিজ্ঞান। এখানে কল্পনা-স্বপ্ন-ধোঁকাবাজি, টাউটারি-বাটপারির কোনো সুযোগ নেই। এখানে বিজ্ঞানের মা হিসেবে পরিচিত অঙ্কের ব্যবহার করতে হয় সবার আগে। তারপর ফিজিক্স বা পদার্থবিদ্যার সূত্র অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয়। সবার শেষে যোগ হয় রসায়ন বা কেমিস্ট্রি।
অঙ্কের সংখ্যাতত্ত্ব না থাকলে যেমন অঙ্ক করা সম্ভব নয়- তদ্রƒপ রাজনীতির ময়দানে সংখ্যাতত্ত্ব অর্থাৎ ০, ১, ২, ৩ থেকে ৯ পর্যন্ত এবং সেসব সংখ্যার যোগ-বিয়োগ-গুণ ভাগ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা আবশ্যক। প্রথমত রাজনীতিতে আপনি যাদের ওপর আধিপত্য দেখাবেন এবং যাদের পরাজিত করবেন তাদের সংখ্যার সঙ্গে আপনার সংখ্যার একটি গাণিতিক সমীকরণ লাগবে। আপনি যদি অযোগ্য, অথর্ব এবং কম বুদ্ধির এক কোটি লোক জড়ো করেন এবং তাদের একত্র করে গুণ-ভাগ-যোগ-বিয়োগ করেন তবে ফলাফল নিশ্চিত শূন্য। আবার যদি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজির সঙ্গী-সাথিদের মতো লোকজন আপনার সঙ্গে থাকে তবে প্রতিটি লোকের গুণগত ও সংখ্যাগত মান হবে ৯ এবং প্রতিটি সংখ্যা একটি অপরটির সঙ্গে গুণনিয়ক হিসেবে কাজ করবে অর্থাৎ ৯X৯X৯X৯...।
উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী সেই আদিকাল থেকে তাবৎ দুনিয়ার রাজনীতির ফলাফল নির্ধারিত হয়ে এসেছে। খুব অল্পসংখ্যক মানুষ কেবল গুণগত পার্থক্যের জন্য তাদের চেয়ে শত গুণ হাজার গুণ লক্ষ গুণ কিংবা কোটি মানুষকে পরাজিত করেছে- তারপর পরাজিতদের জয় করে তাদের ওপর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং সবশেষে শাসন করেছে। অন্যদিকে প্রকৃতির ভেড়ার পালের মতো সংখ্যাধিক্য, দাঁতাল শুয়োয়ের মতো গোঁয়ার্তুমি এবং তেলাপোকা ও শুয়োপোকার মতো বৈশিষ্ট্য নিয়ে বহু জাতি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় নিজেদের বিপুল সংখ্যাধিক্য ধনসম্পদ, অহমিকা, প্রাসাদ-স্ত্রী-পুত্র, হর্মরাজি সবকিছুসহ কখনো পরাজিত শতাব্দীর জটিল রাজনীতির কবলে দেশ!আবার কখনো বা সমূলে বিনাশ হয়েছে কেবল রাজনীতির সংখ্যাতত্ত্বের সূত্র না জানার কারণে।
রাজনীতির সংখ্যাতত্ত্বের সূত্র অনুযায়ী রাজনীতি করার জন্য যেমন বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী-সমর্থক দরকার তদ্রƒপ দল পরিচালনার জন্য যোগ্যতর ও শ্রেষ্ঠতর নেতৃত্ব দরকার। এখানে নেতার যোগ্যতা বলতে তাঁর বড়ত্ব অর্থাৎ সংখ্যার বিচারে জনগণের মধ্যে তাঁর মান কী ১ নাকি ৯ তা নির্ধারণ জরুরি। দ্বিতীয়ত শ্রেষ্ঠত্ব বলতে তাঁর চরিত্রের মাধুর্যতা, অভিজ্ঞতা, জনপ্রিয়তা, সফলতা, সুসম্পর্ক, সুখ্যাতি ইত্যাদিকে বোঝায়। এসব গুণাবলি নেতার সংখ্যাত্মক মানের সঙ্গে পাটিগণিতের যোগ বা গুণের সূত্রমতে একধরনের ফলাফল তৈরি করে, যা নেতাকে উচ্চতর মাকামে পৌঁছে দেয়। রাজনীতির সংখ্যাতত্ত্বের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো শান্তির সময়ে পাটিগণিতের সূত্র প্রযোজ্য হয় এবং অশান্তি-যুদ্ধবিগ্রহের সময় বীজগণিতের সূত্রমতে সবকিছু চলে। অর্থাৎ শান্তির সময় কোনো কিছু গড়তে কিংবা ধ্বংস করতে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের সূত্র কার্যকর থাকে। অন্যদিকে যুদ্ধের সময় রুটওভার সূত্রের কবলে পড়ে হিমালয় পাহাড় প্রশান্ত মহাসাগরে রূপ নেয় অথবা আমাজনের জঙ্গল সাহারা মরুভূমিতে পরিণত হয়। কখনো কখনো আসমানের গ্রহ-নক্ষত্র কক্ষচ্যুত হয়, জমিনের খালবিলের পুঁটি-ভেদা-কাঁচকি-মলা-ডেলা মাছে পরিণত হয় অথবা জমিনের মশা-মাছি-উইপোকারা আকাশের তারা হয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকে। যুদ্ধকালীন এই বিবর্তনে কেবল রাজনীতির সংখ্যাতত্ত্বের মাধ্যমেই ভারসাম্য আনা সম্ভব।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আপনারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোন কোন সংখ্যা কীভাবে দেখতে পাচ্ছেন এবং সেগুলো কী পাটিগণিত নাকি বীজগণিতের সূত্রে নড়াচড়া করছে তা নিয়ে ভাবতে থাকুন। আর আমি এই সুযোগে রাজনীতিবিজ্ঞানের দ্বিতীয় স্তর, অর্থাৎ পদার্থবিদ্যার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে আসি। আপনারা জানের যে ইংরেজি ফিজিক্স শব্দটি এসেছে গ্রিক ফুঁসিস শব্দ থেকে, যার অর্থ প্রকৃতি সম্পর্কিত জ্ঞান, গণিত বা অঙ্ক যখন প্রকৃতির কোনো পদার্থের ওপর প্রয়োগ করা হয় তখন সেখানে যে বিজ্ঞানময়তার সৃষ্টি হয়, তা-ই এক কথায় ফিজিক্স।
আপনার যদি ফিজিক্স বা পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান না থাকে তাহলে আপনি প্রকৃতির কোনো পদার্থকে মূল্যায়ন করতে পারবেন না। পদার্থের শক্তি, ভর বা ওজন এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে আপনি যদি অবোধ শিশু হন তবে বিষধর গোখরা সাপ এবং কেঁচোর পার্থক্য আপনি বুঝবেন না। আপনি শেয়ালকে মনে করবেন শজারু আর বিড়ালকে মনে করবেন বাঘ। আপনি পিঁপড়ের শক্তি নিয়ে মস্ত বড় হাতিকে মাথার ওপর তুলে নাচতে চাইবেন এবং তেলাপোকা হয়ে ঈগলের সঙ্গে আকাশে ডানা মেলে ওড়ার প্রতিযোগিতা শুরু করবেন। আপনি নাপিতের দোকানের ক্ষুর দিয়ে অ্যাটম বোমার বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টা করবেন। অথবা গুলতি নিয়ে কামানের সামনে দাঁড়িয়ে অকুতোভয়ে হুংকার দেবেন এবং তিরধনুক দিয়ে মিগ ৩৫-এর মতো অত্যাধুনিক জঙ্গিবিমান ভূপাতিত করার চেষ্টা করবেন।
পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান না থাকলে আপনি মানুষের গতিপ্রকৃতি ভারসাম্য ইত্যাদি কিছুই বুঝবেন না। অবোধ শিশুর মতো আপনি কারণে-অকারণে হাসবেন এবং ক্ষণে ক্ষণে কাঁদবেন।
অন্যের গুদগুদি বা সুড়সুড়িতে লম্পঝম্প করবেন এবং নিজ বিছানায় মলত্যাগ করে মনের আনন্দে সারা অঙ্গে মেখে এবং কিঞ্চিৎ গলধঃকরণ করে ওলে ওলে পুতুপুতু করে বড়দের বিনোদন প্রদান করবেন। আপনি আগুন দিয়ে খেলবেন এবং হাতের কাছে যা পাবেন তাই মুখের মধ্যে ঢোকানোর জন্য নাচানাচি করবেন। আপনার যদি দু-চারটে দুধদাঁত উঠে থাকে তবে তা দিয়ে লোহা-তুলা-সাপ-ব্যাঙ-মানুষ সবাইকে নির্বিশেষে কামড় দেবেন এবং একেবারে কিছু না পাওয়া গেলে নিজের আঙুলে কামড় বসিয়ে ওয়া ওয়া শব্দে দুনিয়া তোলপাড়ের চেষ্টা চালাবেন।
পদার্থবিজ্ঞানের উপরিউক্ত সাধারণ আলোচনা থেকে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে রাজনীতির জন্য প্রকৃতির জ্ঞান কতটা জরুরি।
দ্বিতীয়ত পদার্থবিজ্ঞানের ভর-তাপ-চাপ সামাল দিয়ে একটি কাঠামো নির্মাণ করতে না পারলে মানুষকে আজীবন গুহাবাসী হয়েই থাকতে হতো। পৃথিবীর তাবৎ স্থাপত্যবিদ্যা বা ইঞ্জিনিয়ারিং এর মূলে রয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের অবদান। মিসরের পিরামিড, চীনের মহাপ্রাচীর, আসোয়ানের বাঁধ, গ্রান্ড ক্যানাল খনন, আধুনিককালের সুয়েজ খাল অথবা প্রাচীন ফেরাউন জমানার প্রথম সুয়েজ খাল এবং হজরত ওমর (রা.)-এর জমানায় খননকৃত দ্বিতীয় সুয়েজ খালের হাত ধরে বর্তমানের সুয়েজ খালের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগ এবং এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মহাকালের রাজনীতি-অর্থনীতি এবং সামরিক নীতির কী সম্পর্ক রয়েছে, তা বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে রীতিমতো মহাভারত রচনা হয়ে যাবে। সুতরাং ওই দিকে না গিয়ে চলমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে পদার্থবিজ্ঞানের যে করুণ দশা ঘটেছে তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম শর্ত হলো গাণিতিক নিয়মে যে কোনো বিষয়ের জন্য একটি কাঠামো দরকার। রাষ্ট্র তার আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে এই কাঠামো গড়ে তোলে। থানা-পুলিশ-প্রশাসন, বিচার বিভাগ-সংসদ থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থিত একটি তহশিল অফিস, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডাকঘর, সরকারি বাংলো অথবা গণশৌচাগারের মাধ্যমে রাষ্ট্র তার কাঠামো গড়ে তোলে। এই কাঠামো যেখানে যত মজবুত সেখানেই রাষ্ট্র তার ক্ষমতা প্রয়োগে অধিকতর সক্ষম। অন্যদিকে রাষ্ট্রের অবকাঠামো যেখানে দুর্বল যেমন আমাদের পাহাড়, বনাঞ্চল এবং চরাঞ্চলে সরকারি কাঠামো শক্তিশালী না হওয়ার কারণে ওসব এলাকায় রাষ্ট্রীয় আইনের পরিবর্তে প্রকৃতির আইন বেশি কার্যকর।
রাষ্ট্রের মতো সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলের কাঠামোর ওপর নির্ভর করে রাজনীতি এবং সরকারের সাফল্য। যে কোনো রাজনৈতিক দলের সংখ্যাতত্ত্ব এবং সারা দেশে কাঠামোগত অবস্থানের ওপর তাদের সফলতা নির্ভর করে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিজস্ব রাজনীতি, নিজেদের সংখ্যাতত্ত্ব এবং নিজেদের কাঠামোগত কোনো বিজ্ঞান নেই। ফলে রাষ্ট্রের কাঠামোর ওপর নিজেদের সংখ্যাতত্ত্বের পাটিগণিত বা বীজগণিতের যে সূত্র তা কোনো অবস্থাতেই জনগণকে শূন্য বা ঋণাত্মক ফলাফলের বাইরে কিছু দিতে পারছে না।
আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার রাজনীতির কেমিস্ট্রি নিয়ে কিছু বলি, আপনার যদি রসায়ন সম্পর্কে কোনো জ্ঞান না থাকে তবে দই আর চুনের পার্থক্য নিরূপণ করতে পারবেন না। দইয়ের মধ্যে চিনি মিশিয়ে তা গলধঃকরণ করলে আপনার মুখ গহ্বর ও খাদ্যনালির মধ্যে যে তৃপ্তির পরশ পাবেন তা রীতিমতো আপনার জন্য মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে যদি আপনি এক চামচ চুন এবং এক চামচ চিনি একত্রে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে তা গলধঃকরণের চেষ্টা করেন। দই-চিনি কিংবা চুন-চিনির রসায়নের চেয়েও জটিল ও কুটিল পরিণত সৃষ্টি হয় রাজনীতির ময়দানে যদি আপনি মানুষের মন-মস্তিষ্ক আচার-আচরণ, রাজনৈতিক আশা-আকাক্সক্ষা এবং স্থান কাল পাত্র অনুধাবন, পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিজ্ঞানের পরিবর্তে ফ্যান্টাসি- অঙ্কের পরিবর্তে ঝাড়ফুঁক, পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের পরিবর্তে পেশিশক্তি হম্বিতম্বি- ধরো মারো খাও প্রযুক্তির সীমাহীন ব্যবহার এবং রসায়নের পরিবর্তে মামলাহামলা, লাঠিপেটা, ধোঁকাবাজি, জালজালিয়াতি, চিনির পরিবর্তে লবণ, চুনের স্থলে দই, কাজের পরিবর্তে আশ্বাস, খাদ্যের পরিবর্তে প্রসাধনী ইত্যাদি লাখো কোটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার বিস্তীর্ণ জনপদে রাজনীতি ততটা জটিল, ততটা দুর্বোধ্য এবং ততটা প্রাণহীন পাথরে পরিণত হয়েছে যা গত ১০০ বছরের ইতিহাসে বাঙালি কোনো দিন দেখেনি।
♦ লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন