ধানমণ্ডির ৫ নম্বর সড়কে লেকের পারে ‘সুধা সদন’ (বাঁয়ে ফাইল ছবি) নামের বাসভবনটি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার। অন্যদিকে গুলশানের ৮৪ নম্বর সড়কে দেড় বিঘা আয়তনের বাড়িটি (ডানে) শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার। ছবি : কালের কণ্ঠ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতার স্বাদ নিতে এই সময়ে শেখ পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যের বাড়ির সামনে দলীয় নেতাকর্মীসহ অনুগতদের ভিড়ের কমতি ছিল না।
তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দৃশ্যপট একেবারে পাল্টে গেছে।
শেখ পরিবারের সদস্যদের বাড়ির সামনে নেতাকর্মীদের আগের সরব উপস্থিতি নেই। নেতাকর্মীদের পদচারণে মুখর বাড়িগুলোয় এখন সুনসান নীরবতা। কালের কণ্ঠের প্রতিনিধিরা ঢাকা, বরিশাল ও খুলনায় সরেজমিনে শেখ পরিবারের সদস্যদের বেশ কিছু বাড়ি ঘুরে এমন চিত্র দেখতে পেয়েছেন।
শেখ হাসিনা
রাজধানীর ধানমণ্ডির লেকপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার বাড়ি।
বাড়িটিতে অবশ্য দীর্ঘ সময় ধরে কেউ থাকতেন না। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্বামীর বাড়ি হিসেবে বিশেষ নিরাপত্তার আওতায় ছিল সেটি। নিরাপত্তার কারণে বাড়ির সামনের সড়কে চলাচল সীমিত ছিল। প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ওই সড়কে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না।
বাড়ির উল্টো পাশে ছিল একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প। বর্তমানে ওই পুলিশ ক্যাম্প নেই। নিরাপত্তাব্যবস্থাও তুলে নেওয়া হয়েছে।
তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে সুধা সদন নামের এই বাড়িটিতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। বাড়িটি থেকে জিনিসপত্রও বের করে নিয়ে যায় তারা।
শেখ রেহানা
শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার বাড়িটি রাজধানীর গুলশানে। বাড়িটি এক হাজার এক টাকা মূল্যে সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ পাওয়া। বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিশেষ নিরাপত্তা আইন বাতিল হওয়ায় এই বাড়িটির মালিক বর্তমানে রাষ্ট্রপক্ষ। বিশেষ আইনে ২০০৯ সালে দেড় বিঘা আয়তনের গুলশানের বাড়িটি বরাদ্দ পান শেখ রেহানা।
জানা যায়, শেখ রেহানা মাঝে মাঝে গুলশানের ওই বাড়িতে অবসর সময় কাটাতেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাড়িটিতে হামলা চালিয়ে তছনছ করা হয়। একসময় বাড়িটি ঘিরে ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা। বর্তমানে বাড়িটি ঘিরে শুধুই নীরবতা। বাড়িটির নিরাপত্তায় বসানো তিনটি নিরাপত্তা চৌকি বর্তমানে ফাঁকা। আগে বাড়িটির সামনের যানজট কমাতে ছিল বাড়তি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। এখন সেখানে নেই কোনো ট্রাফিক সদস্য। বাড়িটির সামনে কয়েকটি ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিকশা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। আর বাড়ির মূল ফটকে ঝুলছে তালা। দূর থেকে ভেতরে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায়, লম্বা সময় ভেতরে কেউ ঢোকেনি। বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় কয়েক স্তরের ঝরাপাতা জমে আছে।
শেখ সেলিম
রাজধানীর বনানীতে বসবাস করতেন শেখ পরিবারের আরেক সদস্য শেখ সেলিম। তার বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেছে, মূল ফটক বন্ধ। বাড়ির ভেতরে কেউ আছেন কি না জানতে অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করা হলেও কারো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে সীমানা প্রাচীরের ওপর দিয়ে তাকিয়ে দেখা গেছে, বাড়িটির ভেতরে কেউ নেই। পাশের বাড়ির দারোয়ান হোসেন মিয়া জানান, বাড়িটিতে শেখ সেলিমের পরিবার থাকলেও গত ৫ আগস্টের পর আর ওই বাড়িতে কেউ আসেননি। অভ্যুত্থানের পর ওই বাড়িটিও হামলার শিকার হয়। কয়েক দিন আগে ময়লা-আবর্জনা সরানো হয়েছে। তবে ভেতরে এখন কেউ নেই।
বরিশালে ‘ভাইয়ের বাড়ি’
সেরাল। বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। এই গ্রামে রয়েছে উঁচু প্রাচীরঘেরা দোতলা একটি বাড়ি। আনুষ্ঠানিক কোনো নাম না থাকলেও বাড়িটি বরিশাল বিভাগজুড়ে সবার কাছে পরিচিত ‘ভাইয়ের বাড়ি’ নামে। এটি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বাড়ি। হাসানাতকে নেতাকর্মীরা ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন।
বরিশালে এলে তিনি গ্রামের এই বাড়িতে থাকতেন। তখন মধ্যরাত পর্যন্ত নেতাকর্মীদের পদচারণে সরগরম থাকত বাড়িটি। রাস্তায় থাকত পুলিশের বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা। ক্ষমতার গত ১৫ বছর এই বাড়িতে বসে হাসানাত বিভাগের ২১টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫টি নিয়ন্ত্রণ করতেন। মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে ইউপি চেয়ারম্যানরা আসতেন এই বাড়িতে। বরিশাল অঞ্চলের আওয়ামী লীগের পদ বণ্টন থেকে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো বাড়িটি থেকে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগেই দেশ ছেড়ে চলে যান হাসানাত। সেই থেকে বাড়িটিতে ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে।
খুলনার আলোচিত ‘শেখবাড়ি’
ভোর হতে না হতেই চলাচল শুরু হতো মানুষ ও গাড়ির। প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা পালাক্রমে হাজির হতেন। ছিল নেতাকর্মীদের মুখর উপস্থিতি। বাড়িটি খুলনার আলোচিত ‘শেখবাড়ি’। নগরীর শেরেবাংলা রোডে বাড়িটির অবস্থান। মাঝেমধ্যে বাড়িতে থাকতেন শেখ আবু নাসেরের সন্তানরা। বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন, খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল, বিসিবির সাবেক পরিচালক শেখ সোহেল উদ্দিন এবং ব্যবসায়ী শেখ আব্দুল্লাহ রুবেল। তাদের পাশাপাশি বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ সারহান নাসের তন্ময়ও মাঝেমধ্যে ওই বাড়িতে আসতেন।
আলোচিত ওই ‘শেখবাড়ি’ বর্তমানে সনসান। নেই কোলাহল। গত ৪ ও ৫ আগস্ট কয়েক দফায় বাড়িটিতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চলে। মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চনার যে আগুন জ্বলছিল ৪ ও ৫ আগস্ট সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বাড়িটির সামনের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় এখনো মানুষ নানা ধরনের বিরূপ মন্তব্য করে।
তবে বাড়িটিতে অগ্নিসংযোগের দুই মাস পর একদিন রাতের আঁধারে ভাঙা গেটটি কেউ টিন দিয়ে আটকে দিয়েছেন। ফলে এখন আর কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না।
[প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়েছে বরিশাল ও খুলনা অফিস]
বনানীর এই বাড়িটিতে থাকতেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী শেখ সেলিম। ছবি : কালের কণ্ঠ
খুলনা নগরীর শেরেবাংলা রোডে বাড়িটির অবস্থান। মাঝেমধ্যে বাড়িতে থাকতেন শেখ আবু নাসেরের সন্তানরা
বরিশালে শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বাড়ি। ছবি : কালের কণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন