যৌক্তিক সময়ে নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে তাগিদ দিলেও দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটির প্রধান টার্গেট আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত সময়ের মধ্যেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার চান দলের নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, দেশের জনগণের কাছে মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের। আর মানুষকে সেবা প্রদানের দায়িত্ব হলো নির্বাচিত সরকারের। নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের ভোটে যে-ই সরকার গঠন করুক না কেন- মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করাটাই বিএনপির টার্গেট। এ লক্ষ্যে সারা দেশে সব রকমের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। দলীয় নেতা-কর্মীদের যে করেই হোক সাধারণ মানুষের মন জয় ও ভালোবাসা অর্জনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে দলের হাইকমান্ড থেকে। নেওয়া হচ্ছে নানা রকমের ইতিবাচক সাংগঠনিক কর্মসূচির উদ্যোগ। ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে দলের ভবিষ্যৎ করণীয়-প্রতিশ্রুতিসহ ৩১ দফা সংস্কারের বিষয়গুলো। সাংগঠনিক এসব কর্মসূচির মাধ্যমে সারা দেশে প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছেন আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা। নিচ্ছেন নির্বাচনি প্রস্তুতি। প্রতিটি এলাকায় গড়ে তিন থেকে চারজন করে মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতা জনকল্যাাণে চষে বেড়াচ্ছেন। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশব্যাপী নেতা-কর্মীদের প্রতি জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি গ্রহণ ও পালনের নির্দেশনা দিয়েছেন। অন্যদিকে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় তিনি অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে ইতোমধ্যেই দল ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন স্তরের প্রায় সহস্রাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কারণ দর্শানো নোটিস দেওয়া হয়েছে তারও বেশি।
কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী, সারা দেশে নানা রকমের জনসংযোগের পাশাপাশি সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে যোগদান এবং স্ব স্ব এলাকায় দলের প্রতিটি ইউনিটকে পুনর্গঠন করে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করছেন নেতারা। এর মূল উদ্দেশ্য হলো- আগামী নির্বাচনের জন্য দল ও নিজেদের অবস্থান সুসংহত করা। এর পাশাপাশি গত পনেরো বছরে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকা দল এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের তাদের এলাকায় সহায়তার জন্য কেন্দ্র থেকে তৃণমূল বিএনপির নেতাদের চিঠি দিয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পরিষ্কার বলেছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে অন্তর্বর্তী সরকারকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার ও তার প্রয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া জনগণের মালিকানা তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া কিংবা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কোনোটিই সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, জনসমর্থিত এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোক্রমেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। তাদের গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য যা যা করা দরকার- তার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে। তবে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা নানা ধরনের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। এ ব্যাপারে সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
এ ছাড়া নির্বাচনে বিএনপি জিতলে সমমনা দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের ঘোষণা দিয়েছিলেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এখন সম্ভাব্য সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশজুড়ে বিএনপির প্রস্তুতি ও কর্মকাণ্ডে সেটিই প্রাধান্য পাচ্ছে। এসব জনমুখী কর্মসূচি পালন ও কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই বেরিয়ে আসবে আগামী নির্বাচনে বিএনপির প্রকৃত বা চূড়ান্ত প্রার্থী কারা হবেন।
তবে নীতিনির্ধারকদের মতে, বিএনপির সার্বিক নির্বাচনি প্রস্তুতিতে এবার মূলত প্রাধান্য পাবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলীয় প্রার্থী বিশেষ করে বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল থেকে উঠে আসা অপেক্ষাকৃত তরুণ ও ত্যাগী নেতারা। এ ছাড়া দলের সাবেক এমপিদের মধ্যে যারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তারাও নির্বাচনের জন্য ইতোমধ্যেই দলের বিবেচনায় থাকার সবুজ-সংকেত পেয়েছেন অনেকে।
দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নির্বাচনকেন্দ্রিক একটি প্রস্তুতি সব সময়ই দলের থাকে এবং সে অনুযায়ীই এখন দলীয় নেতারা কাজ করছেন। নির্বাচনের প্রস্তুতি সব সময়ই আমাদের ছিল এবং এখনো আছে। তা ছাড়া বিগত ১৫ বছরের বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার আন্দোলনের মাধ্যমেই বিএনপির নির্বাচনি প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়ে আছে।
সাংগঠনিক প্রস্তুতি : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত বছর থেকেই বলে আসছেন, জনগণের ভোটে নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে অর্থাৎ জাতীয় সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করা হবে। যেসব দল আন্তরিকভাবে আন্দোলনের মাঠে এবং বিএনপির সঙ্গে ছিল- তারাও সেই সরকারে থাকবে। ফলে নির্বাচনি প্রস্তুতিতে এ বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিবেচনায় রয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় ভোটের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সেই সব সমমনা দলের নেতারাও বিবেচনায় থাকবেন।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে দলের নেতারা মামলা, হামলাসহ নানা কারণে এলাকায় অনিয়মিত ছিলেন কিংবা অনেকে থাকতে পারেননি। এ কারণে গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিএনপির অনুকূলে আসার পর থেকেই দেশজুড়ে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছে দলটির হাইকমান্ড। এরই মধ্যে অনেক জেলা ও মহানগরীর কমিটি বাতিল এবং পুনর্গঠন করা হয়েছে। দল ও অঙ্গসংগঠনের প্রায় প্রতিটি ইউনিটকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদার করা হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হবে দল। বিএনপির তিন সহযোগী সংগঠন- যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল ইতোমধ্যেই সারা দেশে যৌথভাবে প্রতিটি জেলায় যৌথ কর্মিসভা করছে, যার মূল উদ্দেশ্য ভবিষ্যৎ নির্বাচনকে সামনে রেখে তারেক রহমানের নির্দেশনা প্রতিটি জেলায় পৌঁছে দেওয়া। তিনটি সংগঠনের শীর্ষ নেতারা জেলা পর্যায় সফর করে এসব সমাবেশগুলো সমন্বয় করছেন। এর ফলে মাঠ পর্যায়ে তরুণ নেতা-কর্মীরা তাদের করণীয় সম্পর্কে বার্তা পেয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কৃষক দলের পক্ষ থেকে সারা দেশে তিন মাসব্যাপী জনসচেতনতামূলক গণসংযোগ কর্মসূচির উদ্বোধন করেছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এ ছাড়া বিএনপির সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ কেন্দ্রীয় নেতা, ২০১৮ সালের নির্বাচনের দলীয় প্রার্থী এবং নতুন করে আগ্রহী প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ শুরু করেছেন।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খালেদ সাইফুল্লাহ (ভিপি) সোহেল বলেন, আমরা কিশোরগঞ্জ-১ (হোসেনপুর ও সদর উপজেলা) এলাকায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুসারে ব্যাপকভিত্তিক জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি শুরু করেছি। জনকল্যাণমুখী এসব সাংগঠনিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই ইনশাআল্লাহ আমাদের নির্বাচনি প্রস্তুতির কাজও সম্পন্ন হবে।
একই বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এস এ জিন্নাহ কবির বলেন, এলাকায় জনসচেতনতামূলক গণসংযোগের পাশাপাশি জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি শুরু করেছি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় আমরা যেভাবে নিজ নিজ এলাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছি- আশা করি ইনশাআল্লাহ আমরা দলকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি একদিন দেশ গঠনে সফল হবই।
এ বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, যারা নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে রাজপথে এতদিন সক্রিয় ছিলেন, ভবিষ্যতের জন্য দলীয় হাইকমান্ড প্রাধান্য দিচ্ছেন তাদের। তবে এখন নেতা-কর্মীদের বলা হয়েছে, তৃণমূল কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে। তাদের সমস্যা দেখতে এবং জনগণের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ তৈরি করতে। দল দেখছে, কারা দুঃসময়ে কাজ করেছে। অবশ্যই নির্বাচনের জন্য আত্মত্যাগ, পনেরো বছরের ভূমিকা, জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক দক্ষতা- এসব বিষয় বিবেচনায় আসবে।
বিএনপি পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চলতি বছরের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এর আগে ২০১৮ সালে দলটি অংশ নিয়েছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিতর্কিত নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন