বাংলাদেশে গত কয়েক সপ্তাহে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি এবং সরকারের ভূমিকা ও কিছু সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে দলগুলো অবস্থান নেওয়ায় এই মতভেদ তৈরি হয়েছে।
মাসখানেকের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সংসদ নির্বাচন, সংবিধান বাতিল, রাষ্ট্র সংস্কার, রাষ্ট্রপতির অপসারণ, আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ—মোটা দাগে এই কয়টি বিষয় নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বেশ মতবিরোধ কাজ করছে।
কয়েকটি বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতের বেশ অমিল দেখা যাচ্ছে।
ফলে দলগুলোর সঙ্গে সরকারের প্রতি আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ গত রবিবার যে তিনজন নতুন উপদেষ্টা শপথ নিলেন, তাঁদের মধ্যে দুজনের বিষয়ে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের আপত্তি রয়েছে। এ বিষয়টিতে সরকারের সঙ্গে দলগুলোর বড় ধরনের মতবিরোধ তৈরি করেছে বলে অনেকে মনে করছেন।
তিন উপদেষ্টার শপথ গ্রহণ নিয়ে বেশির ভাগ দল এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না জানালেও গণ অধিকার পরিষদ গতকাল বিক্ষোভ করেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ কয়েকটি ছাত্রসংগঠনও প্রতিবাদ জানিয়েছে। অনেকে বলছেন, উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে এবার সরকার বড় ধরনের সমালোচনার মুখে পড়ল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সমর্থন দিয়ে আসছে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন মহল। তবে অভ্যুত্থানের তিন মাসে এসে তাঁদের নানা সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের সঙ্গে দলগুলোর দূরত্ব বাড়লে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে। আবার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে না পারলে সিদ্ধান্ত নেওয়াও কঠিন হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী ও মহলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর সবাই নিজ নিজ এজেন্ডা বাস্তবায়নের দিকে নজর দিয়েছে। সে জায়গা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে।
তিনি মনে করেন, দলগুলোর মধ্যে এই মতানৈক্য দূর করে সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। এটা করতে পারলে সরকার সফল হবে। নইলে তাদের পথচলা কঠিন হয়ে পড়বে।
যেসব বিষয়ে মতভেদ
সংসদ নির্বাচন কবে হবে, তা এখনো জানায়নি সরকার। এতে বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে। বিএনপি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করতে চাপ দিলেও অন্য দলগুলোর প্রচেষ্টা সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে গত ৮ নভেম্বর রাজধানীতে বড় শোডাউন করেছে। মূলত নির্বাচনের দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে এই শোডাউন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দলটি।
এর এক দিন পর গত ৯ নভেম্বর সিলেটে এক অনুষ্ঠানে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেন, শুধু নির্বাচনের জন্য দুই হাজার মানুষ জীবন দেননি, অর্ধলক্ষ মানুষ তাদের রক্ত দেয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচিত সরকার ছাড়া দেশ গতিশীল থাকে না। বরং নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। ফলে দেশ-বিদেশের সবাই এখন নির্বাচনের কথা বলছে। তাই সরকারের দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত।
জামায়াত নির্বাচন নিয়ে বরাবরই কৌশলী। তারা দ্রুত নির্বাচন চাইলেও তা নিয়ে তাদের কোনো তাড়াহুড়ো দেখা যায়নি। বিএনপি জোটের শরিকদের বেশির ভাগ দ্রুত নির্বাচন চায়। তবে গণ অধিকার পরিষদ আগে রাষ্ট্র সংস্কার চায়। এ জন্য সরকারকে সময়ও দিতে চায় দলটি।
কয়েক সপ্তাহ আগে ছাত্রদের প্রথম যে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়, সেটি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ এবং সংবিধান বাতিল বিষয়টি। এই দুই দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রপতি ভবন ঘেরাও করলে তা নিয়ে বেশ উত্তেজনা ছড়ায়। তবে বিএনপি স্পষ্ট বলেছে, সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়, এমন কোনো বিষয়ে দলটি সমর্থন জানাবে না। ফলে রাষ্ট্রপতির অপসারণ ও সংবিধান বাতিলের বিষয় স্তিমিত হয়ে যায়। দলটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির সন্দেহ, রাষ্ট্রপতির অপসারণ ও সংবিধান বাতিলের মধ্যে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কৌশল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা করলেও এসব ইস্যুতে কোনো ঐকমত্য হয়নি। তবে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের পক্ষে তাদের অবস্থান জানিয়েছিল। বিএনপি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করার পর অন্য কয়েকটি রাজনৈতিক দলকেও কমবেশি কৌশলী অবস্থান নিতে দেখা গেছে।
রাষ্ট্র সংস্কারে সরকারের ব্যাপক উদ্যোগের বিষয়ে বিএনপির কিছুটা আপত্তি আছে। বিএনপি মনে করে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে যতটুকু দরকার, ততটুকু সংস্কার হওয়া উচিত। নির্বাচিত সরকারই পুরো রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব নেবে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা দেশে বড় ধরনের সংস্কার চান। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় তাঁরা তাঁদের মত দিয়েছেন। সম্প্রতি সারজিস আলমও বলেছেন, মানুষ ১৬ বছরে দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমের কবলে পড়ে দেয়ালে তাদের পিঠ ঠেকে গেছে। এখন এই সিস্টেমগুলো সংস্কার না করে নির্বাচন দিয়ে দিলে তো হবে না।
জামায়াতের মুখপাত্র দলের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা সংবিধান বাতিল বা পুনর্লিখনের কথা বলছেন না। তবে সংবিধান সংস্কার করতে হবে। নইলে ৫ আগস্ট যে কারণে বিপ্লব হলো, তা বৃথা যাবে।
সম্প্রতি আরেকটি বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক হয়েছে। তা হলো আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হাইকোর্টে রিটের পদক্ষেপ। এর কয়েক দিন পর জাতীয় পার্টির অফিসে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর দলটিও নিষিদ্ধের দাবি ওঠে। দল দুটি নিষিদ্ধের পক্ষে অনেকে মত দিলেও বিএনপি বলছে, তারা কোনো দলই নিষিদ্ধের পক্ষে নয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন