বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরে চলার ইতিহাস ৪৬ বছরের পুরনো আর রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক প্রায় দুই যুগের। ৫ আগস্টের আগ পর্র্যন্ত কোনো না কোনোভাবে এ সম্পর্ক টিকে ছিল। টানা ১৫ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনীতির মাঠে সাবেক ক্ষমতাসীন দলটির দৃশ্যত কোনো কর্মকাণ্ড নেই। এই সুযোগে রাজনীতির ফাঁকা মাঠে নিজেদের বিকল্প শক্তি হিসেবে হাজির করতে চাইছে জামায়াত। একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র বিএনপিকে এড়িয়ে নানা ইস্যুতে অবস্থান নিতে দেখা গেছে দলটির শীর্ষ নেতাদের। দিন যত যাচ্ছে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব তত বাড়ছে। বিএনপিও দূরত্ব ঘোচানোর চিন্তা বাদ দিয়ে অন্যান্য দল নিয়ে এগোতে চাইছে।
বিএনপির সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে আলোচনা করেছেন নীতিনির্ধারকরা। নেতারা বলেছেন, জামায়াত বিএনপির কৌশলগত মিত্র ছিল। জোট বিলুপ্ত হওয়ার পর সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলনেও জামায়াত বিএনপির সঙ্গে ছিল। হাসিনার পতন হয়েছে। দৃশ্যত জামায়াত ও বিএনপির রাজনীতি এখন এক নয়। একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আরেকটা রাজনৈতিক দলের যে সম্পর্ক থাকে, এখন দল দুটির সম্পর্ক সে রকমই। আগামী সংসদ নির্বাচন হওয়ার আগ পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক কৌশলগত থাকবে। সম্পর্কের দূরত্ব ঘোচাতে উদ্যোগী হবে না বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে জানান, ধারণা করা হচ্ছিল ৫ আগস্টে রাজনীতির হিসাবনিকাশ পাল্টে গেছে। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। একটি মহল পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে। পাশের একটি দেশ তাদের সহযোগিতা করছে বলে ধারণা। এখন জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্বের কথা প্রকাশ্যে এলে আওয়ামী লীগ ও অন্য মহলগুলো এর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। বিএনপি সে সুযোগ দিতে চাইছে না। তাই জামায়াতের সঙ্গে একাধিক ইস্যুতে মতানৈক্য হলেও প্রকাশ্যে কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জামায়াত প্রায় দুই যুগের জোটসঙ্গী। তারা নির্যাতিত নিঃসন্দেহে। তবে তারা এ দেশ স্বাধীন করেনি, আমরা করেছি। তারা যদি মনে করে, রাজনীতির মাঠে একচ্ছত্র আধিপত্য করবে, তারা তা করতেই পারে। আমরা আমাদের রাজনীতি করব।’
বিএনপির এ অবস্থানের ব্যাখ্যায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। রাজনীতির মাঠ প্রায় ফাঁকা। জামায়াত এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। তারা ফাঁকা জায়গায় বড় শক্তি হিসেবে হাজির হতে চাইছে। কিন্তু এতে ভোটের রাজনীতিতে বড় প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। জামায়াতের ভোটব্যাংক খুব বাড়বে না। বাংলাদেশের ভোট মূলত বিএনপি ও আওয়ামী লীগে বিভক্ত। বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে এবং আওয়ামী লীগ অংশ নিলে তারা অল্প আসন পেলেও অনেক ভোট পাবে। আর জামায়াতে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে জোট করলে হয়তো তাদের আসন কিছু বাড়বে। কিন্তু ভোটের শতকরা হারে খুব একটা হেরফের হবে না।
জানা গেছে, আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে এক প্ল্যাটফর্মে আনার চেষ্টা করছে। গত ১৮ আগস্ট জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক কয়েকটি ইসলামি দলের সঙ্গে বৈঠক হয়। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন, ১২-দলীয় জোট, জাকের পার্টি, খেলাফত মজলিস, ফরায়েজী আন্দোলনসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে জামায়াতের বৈঠক হয়েছে। খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমির আবদুল মাজেদ আতাহারী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির আবু জাফর কাসেমী, জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মনিরুজ্জামান কাসেমী, জনসেবা আন্দোলনের আমির ফখরুল ইসলামসহ বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও আলেমদের সঙ্গে জামায়াতের আমির পৃথক মতবিনিময় করেছেন।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বনিবনা হওয়ার সম্ভাবনা কম- এটা ধরে নিয়েই জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা ইসলামপন্থিদের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছেন।
এই পরিস্থিতিতে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ‘দূরত্ব’ ঘোচানোর চিন্তা বাদ দিয়ে অন্য দলগুলো নিয়ে এগোতে চাইছে। ইতিমধ্যে দলটির সিনিয়র নেতারা বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও অন্য দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। ঐক্য জোরালো করতে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ৪২ দল ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী ৬৪ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও অব্যাহত রেখেছে বিএনপি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য বরকতউল্লা বুলু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে থাকা দলগুলোর সঙ্গে লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে যাতে সব দল অংশ নেয় এবং মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়, তার জন্য আমরা অন্য দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছি।’
অন্তর্বর্তী সরকারকে আগামী সংসদ নির্বাচন আয়োজন পর্যন্ত সময় দেওয়া নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমে দল দুটোর মতবিরোধ সামনে আসে। ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচন কবে হবে, নির্বাচন কত দিন পর হতে পারে, সে বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা না দেওয়ায় প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের রোডম্যাপ না থাকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের সমালোচনা করে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘এখনো শত শত মানুষ হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে। রক্তের দাগ মোছেনি। দেশ বন্যায় আক্রান্ত। এ সময় নির্বাচনের জিকির জাতি তা গ্রহণ করবে না।’ জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘যাদের জনসমর্থন নেই, যারা নির্বাচনের বিরুদ্ধে, তারা এ ধরনের চিন্তাভাবনা করে।’
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কিছুদিন পর বিএনপির মনে হয়েছে, বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা গুরুত্ব পাচ্ছে না। বরং জামায়াতে ইসলামীকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রশাসনে নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রেও তারা গুরুত্ব পাচ্ছে। বিষয়টি অনেকটা নালিশ আকারেই বিএনপির পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরা হয়।
এর মধ্যেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে গত ২৮ আগস্ট ঢাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে জামায়াতের আমির বলেন, ‘আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। প্রতিবেশী বদলানো যায় না। আপনারা বদলানোর চিন্তা করেন কেন।’ এই বক্তব্যে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বিএনপি। সেপ্টেম্বরে সাতক্ষীরায় বিএনপি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘গত কয়েক দিনে দেখেছি কিছু রাজনৈতিক দল একটি প্রতিবেশী দেশের ফাঁদে পা দিয়েছে। তারা বিভ্রান্তি ছড়ায় এ রকম কিছু কথাবার্তা বলছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের সজাগ থাকার আহ্বান জানাই।’
অন্তর্বর্তী সরকার বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় যেসব লোককে পদায়ন করেছে, তা নিয়েও বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মনোমালিন্য চলছে। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ নিয়ে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষেও জামায়াতে ইসলামী সমর্থন দিয়েছে। অথচ শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করছে বিএনপি। জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আযমী গুম অবস্থা থেকে ফেরত আসার পর জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি তুললে বিএনপি সমর্থকদের অনেকেই এর কড়া সমালোচনা করেন।
শুধু কেন্দ্রীয় পর্যায়েই নয়, তৃণমূলেও দল দুটির মধ্যে বিভেদ লক্ষ করা গেছে। ইতিমধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছে দল দুটির ছাত্রসংগঠন। অনলাইনেও সরব দু-দলের সমর্থকরা। একদল অন্য দলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোয় আধিপত্য বিস্তার শুরু করেছে শিবির। ছাত্রদলকে কোণঠাসা করতে তারা মরিয়া। ছাত্রদলও জবাব দিচ্ছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, নির্বাচন যত দেরি হবে, জামায়াত ততই দল গোছানোর সময় পাবে। নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি সরকারের ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করতে চাইলেও জামায়াতের মধ্যে এ বিষয়ে তাড়া নেই। ফলে দিন দিন দল দুটির মধ্যে যোগাযোগ সীমিত হচ্ছে। তবে ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী উত্তরের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ অংশ নেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক সংকট যাতে সৃষ্টি না হয়, পতিত ফ্যাসিবাদ যাতে সুযোগ নিতে না পারে, সে বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচন অনুষ্ঠান বা সংস্কার ইস্যুতে আমাদের সঙ্গে বিএনপির ভিন্নমত থাকতে পারে। তবে আলোচনায় বসলে এগুলোর নিরসন হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমাদের মতবিরোধ রয়েছে বললে ঠিক হবে না। বিএনপি তার রাজনৈতিক দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বক্তব্য রাখছে। আমরা আমাদের দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বক্তব্য রাখছি। কাউকে গ্রহণ বা বর্জন করার মালিক জনগণ। রাজনীতিতে ভিন্নমত থাকবেই। পারস্পরিক দূরত্বের কারণ রয়েছে মনে করি না।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন