আলাপ-আলোচনার মাঝে বলেছিলাম, শুধু গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে না ভেবে আপনি যদি বাংলাদেশ নিয়ে ভাবতে পারেন, ৮৪ লাখের জায়গায় ১৬ কোটি নিয়ে ভাবতে পারেন তাহলেই আমাদেরকে পেতে পারেন এবং দেশবাসীকে পাবেন। আমার কথায় তিনি পুলকিত হয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আগামী দিনে তিনি তেমনটাই করবেন
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-যুবকদের সঙ্গে আপামর জনসাধারণ ঝাঁপিয়ে পড়ায় শেখ হাসিনার পতন হয়। দেশের মানুষ আশায় বুক বাঁধে অনেক কিছুর পরিবর্তন হবে। বিশেষ করে ঘুষ-দুর্নীতি, জোর-জবরদস্তি থেকে মানুষ মুক্তি পাবে। খুব একটা তেমন হয়নি। মন্দের ভালো যা হওয়ার মোটামুটি তা হয়েছে। গত ১৫-১৬ বছর কোনোখানে কোনো যোগ্য মানুষের স্থান ছিল না, তা এখন পদে পদে দেখা যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি মহামান্য রাষ্ট্রপতি যা বলেছেন, যেভাবে বলেছেন তাতে তার যোগ্যতার কোনো প্রমাণ হয় না। তিনি তার বেতার ভাষণে বললেন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি। এরপর মরে গেলেও রাষ্ট্রপতি এ নিয়ে যা বলছেন তার কানাকড়িও বলার কথা না। যোগ্যতা না থাকলে যা হয় তাই হয়েছে। আর কুকর্মের সঙ্গে সারাজীবন জড়িত থাকলে সে কখনো সুস্থির হতে পারে না। তাকে কম বেশি সব সময় অস্থির থাকতে হয়। সেটাই মহামান্য রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে পদে পদে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বর্তমান প্রধান উপদেষ্টাকে আমি ভালো জানি, সম্মান করি, বিশ্বাস করি। ২০১২’র দিকে যখন তার গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি’র পদ নিয়ে ঝড় বইছিল তখন একদিন ড. কামাল হোসেন কথায় কথায় বলেছিলেন, সিদ্দিকী সাহেব, আপনি একটু ড. ইউনূসের কাছে যান। আপনি গেলে সে সাহস পাবে, জোর পাবে। তার কথায় আমি গিয়েছিলাম। তার আগে প্রধানমন্ত্রী বারবার অধ্যাপক ইউনূসকে সুদখোর বলায় আমার মধ্যেও নানা রকম প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল। আমি যাবার পথে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে, গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৪ লাখ গ্রাহককে নিয়ে তার ভাবনা নামে একটি পুস্তিকা ড. কামাল হোসেন আমার হাতে দিয়েছিলেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তার ভাবনা পুস্তিকাটি নিয়ে গিয়েছিলাম। শুধু গ্রামীণ ব্যাংকের স্থলে বাংলাদেশ আর ৮৪ লাখের জায়গায় একটা পেন্সিলে ১৬ কোটি লিখে নিয়েছিলাম। অনেক আলাপ-আলোচনার মাঝে বলেছিলাম, শুধু গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে না ভেবে আপনি যদি বাংলাদেশ নিয়ে ভাবতে পারেন, ৮৪ লাখের জায়গায় ১৬ কোটি নিয়ে ভাবতে পারেন তাহলেই আমাদেরকে পেতে পারেন এবং দেশবাসীকে পাবেন। আমার কথায় তিনি পুলকিত হয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আগামী দিনে তিনি তেমনটাই করবেন। আজ যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান তখন কথাগুলো ভাবি। বয়স একেবারে কম হয়নি। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কী হয়, কীভাবে হয়, কেন হয় এসবের কিছুই যে বুঝি না তাও নয়। অধ্যাপক ড. ইউনূসের এই সময় রাষ্ট্র চালানো বেশ কঠিন। কিন্তু মোটেই অসম্ভব নয়। তার দৃঢ়তা অনেক সমস্যার সহজ সমাধান হতে পারে। তাকে আওয়ামী কিছু লোক একেবারেই পছন্দ করে না এটা যেমন সত্য তেমনি অসংখ্য মানুষের আস্থা তার প্রতি আছে- এটাও এক চরম সত্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দক্ষতা ও যোগ্যতার। আমার ভুল হতে পারে। কিন্তু আমি এখনো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাকেই প্রধান দক্ষ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ মানুষ হিসেবে মনে করি। কে তাকে অনুরোধ করলো, কে অনুনয় বিনয় করে প্রধান উপদেষ্টা বানালো এটা বড় কথা নয়। এটা বড় কথা, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন, আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা তার প্রতি রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সংগঠকরা এক অসাধ্য সাধন করেছে। বাংলাদেশ সত্যিই অসাধ্য সাধনের দেশ, দুঃসাধ্য বাস্তবায়নের দেশ। সেক্ষেত্রে ছাত্র-যুবক, অসন্তুষ্ট জনসাধারণের অংশগ্রহণে বিগত সরকারের পতন ঘটেছে। বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের, যুবকদের সারা দেশব্যাপী কখনো কোনো দৃঢ় সংগঠন ছিল না, এখনো হয়তো নেই। কিন্তু তারা যদি অহংকারী না হয়, তারা যদি বাস্তব বুঝতে চেষ্টা করে এবং তারাই দেশের মালিক-মোক্তার না ভাবে তাহলে তাদের সফলতা কেউ ঠেকাতে পারবে না। এটা খুবই সত্যি- দেশে বড় বড় দল বহু আছে। দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো আছে। কিন্তু সব থেকে বড় কথা কোনো দলের প্রতি সাধারণ মানুষের গভীর শ্রদ্ধা ও নিবিড় আস্থা ও বিশ্বাস ছিল না, এখনো অনেকেই তা অর্জন করতে পারেনি। যতক্ষণ জাতীয় দলগুলো মানুষের আস্থা অর্জন করতে না পারবে ততক্ষণ নিশ্চয়ই দলীয় কাঠামো একটা শক্তি তাদের থাকবেই, কিন্তু কোনো লক্ষ্যেই পৌঁছতে, কোনো বিজয় অর্জন করতে যে পরিমাণ জনসম্পৃক্ততার প্রয়োজন সেটা না পেলে তারা মোটেই সফলকাম হবে না। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে কাজ করা দরকার ঠিক তেমনি সফল আন্দোলনকারীদেরও সাধারণ মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি গুরুত্ব এবং তাদের কষ্ট বোঝা উচিত।
দেশবাসী নানা কষ্টে আছে। আইনশৃঙ্খলা ভালো নেই, ঘুষ মোটেই বন্ধ হয়নি, দুর্নীতি একই পরিমাণ আছে। পুলিশের নিচু পর্যায়ে অনেকটা দরদী হলেও উঁচু পর্যায়ে আগের চাইতে খারাপ হয়েছে। এতদিন যারা নিগৃহীত ছিল তারা মনে করছে দেশটা এখন তাদের জন্য অবারিত, লুটপাট ও দাঙ্গাবাজি, কাজ না করা সে এক বেপরোয়া ভাব। ২-৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা এখনো ভালো আছে বলে চলছে। না হলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম বলতে পারি না। বিশেষ করে সেনাবাহিনী খুবই প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। তাদেরকে বিচারিক ক্ষমতা দেয়ার পরও কোনোরকম উত্তেজনাকর তেমন বড়সড় ঘটনার কথা শোনা যায়নি। দেশে এরকম গৌরবান্বিত সেনাবাহিনীই আমাদের দরকার। সেনাবাহিনী যদি এমন সুন্দর নিয়ন্ত্রিত থাকে তাহলে ভবিষ্যতে আমরা গর্ব করার মতো অনেক কিছু পাবো। সেনাবাহিনীকে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা উচিত না। সেনাবাহিনীকে দক্ষ, যোগ্য ও গৌরবান্বিত বাহিনীতে পরিণত করা উচিত। ব্যাপারটা শুধু সেনাবাহিনী নয়, ব্যাপারটা সমস্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী নিয়ে। সেটা সেনা, নৌ, বিমান, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, প্যারা মিলিশিয়া, গ্রামরক্ষী যত রকমের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে তারা যেন সম্মানের হয়, গৌরবের হয়- সেদিকে আমাদের নজর দেয়া উচিত।
মতো। শুধু আর্থিকভাবে তারা সম্মানী ছিলেন না, সামাজিকভাবেও ছিলেন। কোনো শিক্ষক বাজারে গেলে তাকে সম্মান করা হতো। কোনো জিনিস কেনার সময় গুরুজনের উপর দিয়ে কোনো পয়সাওয়ালা এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যেতো না। কিন্তু এখন তেমনটাই হয়। কারও কোনো সামাজিক মর্যাদা নেই। শিক্ষা আর শিক্ষা নেই। শিক্ষা কেমন যেন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আগে শিক্ষকরা ছিল পিতার মতো, এখন শিক্ষকরা অনেকটা তেমন নেই। কতো খারাপ শব্দ ব্যবহার করবো? কোনো শব্দই তাদের পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করা যাবে না। কবে যে এইসব অসঙ্গতি থেকে মুক্তি পাবো- সদা সর্বদা শুধু তাই ভাবি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন