আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১০ বছর সাজা, জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচার মামলাসহ পাঁচটি মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাজা দেয়া হয়। আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের আবেদনে দেশের সব গণমাধ্যমে তার বক্তব্য প্রচার ও প্রকাশ নিষিদ্ধ করে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেনের পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনা সরকারের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো প্রায় ৮০টি মামলা দায়ের করা হয়। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার জট খুলতে শুরু করেছে।
এর মধ্যে মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে করা ৩০ থেকে ৩৫টি মামলা আদালতের মাধ্যমে খারিজ বা বাতিল হয়েছে বলে বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তারেক রহমান আইন, আদালত ও সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উনার মামলাগুলো নিষ্পত্তি করার প্রচেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের সব রাজনৈতিক দলের সমর্থনে একটি অন্তর্বর্তী সরকার কায়েম হয়েছে। সেই সরকার আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। আইনগত পদক্ষেপের মাধ্যমেই তারেক রহমান তার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় মোকাবেলা করবেন। তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে বিএনপির আইন সম্পাদক বলেন, তারেক রহমান এ দেশের নাগরিক। অন্যান্য নাগরিকের মতো যেকোনো সময় তার দেশে আসার সাংবিধানিক ও আইনগত অধিকার রয়েছে। তিনি বলেন, গত ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দেশের মানুষের প্রত্যাশা এবং দলীয় নেতাকর্মীদের আবেগ ভালোবাসার প্রতি সম্মান দেখিয়ে তিনি যথাসময়ে দেশে আসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা : একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এ মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি চলছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর গত ৩১ অক্টোবর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা মামলায় আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) ও আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়েছে। বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ শুনানি গ্রহণ করেন।
পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে শুনানি শুরু হয়। এর পর আগামী ৭ নভেম্বর শুনানির পরবর্তী দিন রাখা হয়েছে।
বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, কুখ্যাত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানকে সাজা দিয়েছে শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ তার একক ইচ্ছায়। ২০০৪ সালে যখন এই মামলা করা হয় তখন তারেক রহমানের নাম এফআইআরে ছিল না। একে একে তিনটি চার্জশিট দেয়া হলো। সেই চার্জশিটেও তারেক রহমানের নাম ছিল না।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা : ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ মামলায় অভিযোগ ছিল, এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে পাওয়া ২ কোটি ১০ লাখ টাকার বেশি অর্থ ট্রাস্টের কাজে ব্যবহার করা হয়নি। বরং সেই টাকা নিজেদের হিসাবে জমা রাখার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। একই সঙ্গে তারেক রহমানসহ অন্য পাঁচ আসামিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। বর্তমানে এ মামলাটিও আপিল বিভাগে শুনানির জন্য রয়েছে। মামলাটি শিগগরিই আপিল বিভাগে শুনানির জন্য উঠতে পারে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদের মামলা : ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেক রহমান, তার স্ত্রী জুবাইদা রহমান ও জুবাইদা রহমানের মা সৈয়দা ইকবাল বানুর বিরুদ্ধে জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলাটি করেছিল দুদক। অভিযোগ ছিল তারেক ও তার স্ত্রীর ঘোষিত আয়ের বাইরেও ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকারও বেশি পরিমাণ মূল্যের অবৈধ সম্পদ রয়েছে। এ মামলায় তারেক রহমানকে ৯ বছরের এবং তার স্ত্রী জুবাইদা রহমানকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ মামলাটির বিষয়ে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ২০০৭ সালে দুদকের করা এই মামলায় তড়িঘড়ি করে ২০২৩ সালে একটি রায় ঘোষণা করা হয়। এ মামলায় রাত ৯টা পর্যন্ত মোমবাতি জালিয়ে সাক্ষ্য নেয়া হয়। তিনি বলেন, এই রায় আইনের রায় না, আদালতের রায় না। এটা ছিল ফরমায়েশি ডিক্টেটরি রায়।
অর্থপাচার মামলা : ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের একটি মামলায় ঢাকার একটি আদালত তারেক রহমানকে খালাস দেয়। বিচারিক আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে দুদক। ২০১৬ সালে বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেয় হাইকোর্ট। পাশাপাশি ২০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়।
মানহানির মামলা : ২০১৪ সালে লন্ডনে এক সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কটূক্তির অভিযোগে নড়াইলে তার বিরুদ্ধে মানহানির একটি মামলা করা হয়। ওই মামলায় ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন নড়াইলের আদালত। ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানান, নড়াইল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ৬০টির মতো মানহানির মামলা দায়ের করা হয়।
রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা : তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাও রয়েছে। ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি তেজগাঁও থানায় করা রাষ্ট্রদ্রোহের একটি মামলায় তাকে এবং একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান আবদুস সালামের বিরুদ্ধে যোগসাজশ করে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়।
এ মামলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও রয়েছে। গত ৩১ অক্টোবর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান আবদুস সালামসহ চারজনের বিরুদ্ধে করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা বাতিল করেন হাইকোর্ট।
এ দিকে গত ২২ আগস্ট তারেক রহমানের বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার বন্ধে আবেদনকারী রিট আবেদন না চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়ায় এ বিষয়ে জারি করা রুল খারিজ (ডিসচার্জ ফর নন-প্রসিকিউশন) করে আদেশ দেন হাইকোর্ট। এর ফলে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে আর কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবী।
বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাসহ তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মোট মামলা ৮০টি। এর মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫টি মামলা আদালতের মাধ্যমে খারিজ বা বাতিল হয়েছে। অপর দিকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ ৫টি মামলায় তাকে সাজা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উনার মামলাগুলো নিষ্পত্তি করার প্রচেষ্টা চলছে। আদালতের মাধ্যমেই প্রমাণ হচ্ছে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা মিথ্যা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন