ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন আন্দোলনে ভূমিকা রাখা প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে সরব হওয়ার চিন্তা করছে। রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যুটি শেষ পর্যায়ে কোনো দিকে মোড় নেয়, তা মাঠে থেকেই পর্যবেক্ষণ করবে দলটি। ইতোমধ্যে এ নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের মাঝে প্রাথমিক আলোচনা শেষ হয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে আগামী নভেম্বর মাসে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহানগরে সমাবেশ করতে পারে দলটি।
বিএনপি নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর আড়াই মাসের মাথায় আন্দোলনকারীদের মাঝে অনৈক্য সামনে এসেছে। এখনও প্রশাসনকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করা যায়নি, যার কারণে আওয়ামী লীগ এখনও প্রতিবিপ্লবের স্বপ্ন দেখে। এই অবস্থায় পতিত সরকারের প্রধানের অডিও ফাঁস ও তার নির্দেশনাকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছে বিএনপি। সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে ফের রাজপথে সরব হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। কারণ দেশে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হোক বিএনপি চায় না। এ জন্য মাঠে থেকে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
দলটির নেতারা বলেন, হঠাৎ করে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতির মন্তব্যে উত্তেজনা দেখা দিলে বঙ্গভবন পরবর্তী সময়ে ব্যাখ্যাও দেয়। রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি জোরালো অবস্থান নেয়। কিন্তু বিএনপি তাদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ না করে বলেছে, এতে করে সাংবিধানিক সংকট দেখা দেওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে। এ বিষয়ে গত রবিবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ দলের অবস্থান খোলাসা করে বলেন, দেশে যদি রাজনৈতিক সংকট হয়, সেই সংকটের পেছনে কী শক্তি আছে, সেটা আগে বিশ্লেষণ করতে হবে।
এই অবস্থায় সার্বিক দিক চিন্তা করে ফের মাঠে সক্রিয় থাকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে বিএনপি। এ জন্য আগামী নভেম্বরে মহানগরসহ সব সাংগঠনিক জেলায় সমাবেশের কথা ভাবছে।
এ কর্মসূচির মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতিতে দলটির অবস্থানও জনগণকে জানাতে চায়। এ নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিভিন্ন ফোরামেও আলোচনা হয়েছে। সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে। গতকাল বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসও বলেছেন, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল যদি একসঙ্গে কাজ করতে পারি, তখন দেশটা পুনর্গঠিত হতে পারে। তা না হলে আমাদের নিয়ে প্রতিবেশী দেশ খেলতেই থাকবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে রাজপথে থেকে রাষ্ট্র সংস্কারে বিএনপির দেওয়া ৩১ দফা তুলে ধরার পাশাপাশি দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবি তোলা হতে পারে। একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেক্টর থেকে আওয়ামী লীগের দোসরদের সরানোর দাবিও থাকবে। একই কর্মসূচি দেশের গুরুত্বপূর্ণ জেলা সদরে পালন করতে পারে সমমনা দলগুলোও।
বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যুতে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করছে একটি মহল। এর মধ্যে নির্বাচনকে প্রলম্বিত করারও একটা চেষ্টা রয়েছে। নেতাদের ধারণা, এ সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগকে মাঠে নামানোর পাঁয়তারা করছে মহলটি। এ জন্য মাঠে থেকে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
সূত্র জানায়, এরই অংশ হিসেবে মহানগর ও জেলায় সমাবেশ করার কথা ইতোমধ্যে দলের কয়েকটি ফোরামে আলোচনা হয়েছে। নীতিগত সিদ্ধান্ত সমাবেশ করার। এখন কবে থেকে এ কর্মসূচি শুরু করবে এবং কোন জেলা বা মহানগরে কবে সমাবেশ হবে-তার তারিখ ঠিক করার কথা রয়েছে দায়িত্বশীল নেতাদের। রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যুতে বিভিন্ন ধরনের কথা বলা হচ্ছে যা ইঙ্গিতপূর্ণ, বিএনপির বিরুদ্ধে বলে মনে করছেন নেতারা। সে জন্য সমাবেশে জনগণকে এ বিষয়ে দলের অবস্থানও জানানো হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স আমাদের সময়কে বলেন, ‘সভা-সমাবেশ একটি চলমান প্রক্রিয়ারই অংশ। আস্তে আস্তে রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করা উচিত। বিভিন্ন ইস্যু সামনে আসছে। এই ইস্যুর ভিত্তিতে আমাদের কাজ করা উচিত।’ বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীম বলেন, দল যখন যে সিদ্ধান্ত দেবে, তা আমরা পালন করব।
বিএনপি নেতাদের মতে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের উচিত হবে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। দ্রুত নির্বাচন না হলে সরকার জনগণের আস্থা হারাতে পারে বলে মনে করেন নেতারা। এ বিষয়ে নির্বাচনের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়া হবে জানিয়ে সম্প্রতি রাজধানীতে এক সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সতর্ক করে বলেন, যৌক্তিক সময়টা অতিক্রান্ত হলে জনগণনির্ভর বিএনপি জিয়াউর রহমানের দল তারেক রহমানের নেতৃত্বে অবশ্যই ঘরে বসে চিনাবাদাম খাবে না।
বিএনপি নেতারা বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারে বিএনপি অন্তত ৪৮টি রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে ৩১ দফা ঘোষণা করেছে। এসব দফায় জনগণ যা প্রত্যাশা করছে সবই আছে। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। কোনো বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হলে তা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দিতে হবে। নেতারা আরও জানান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ আন্দোলনরত প্রত্যেকটি দলের শীর্ষনেতাদের নামে মিথ্যা মামলা রয়েছে। দেড় লাখ মামলায় আসামি আছে ৬০ লাখের ওপর। এসব মামলা প্রত্যাহারে সময়ক্ষেপণ করায় তৃনমূলসহ দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান তাদের আবেগের জায়গা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, পতিত স্বৈরাচারী দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে তা চায় না জনগণ। বিএনপি একটি বড় দল। পাশাপাশি জনগণের কাছেও জনপ্রিয় একটি দল। জনগণের কথা ভেবে বিএনপি ঘরে বসে থাকতে পারে না। এ জন্য আবারও কর্মসূচি দেওয়া হবে। জনগণের দল জনগণের কাছে যাব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন