চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার যুবদল নেতা মেহেদী হাসান দিপু এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সহসভাপতি সুবেলকে সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। আহতদের বয়ানে জানা গেছে, এই হামলায় জড়িত ছিল আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। তাঁরা যুগপৎভাবে এই দুজনের ওপর হামলা করে। অভিযুক্তরা আরও জানান যে, আগস্টের ৫ তারিখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা গণরোষ থেকে বাঁচতে লুকিয়ে পড়েছিল, তবে ধীরে ধীরে জামায়াতের নেতাদের সহায়তায় তাঁরা আবার বেরিয়ে আসছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী আমলে নিষিদ্ধ করা জামায়াতকে আবার আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর ইউনূসের সাথে জামায়াতের শীর্ষনেতারা একাধিক বৈঠক করেন। মিডিয়াতেও জামায়াতের আমিরকে অনেক বেশি দেখা যেতে থাকে। একপর্যায়ে তিনি, গণহত্যাকারীকে আওয়ামী লীগকে ক্ষমার ঘোষণাও দেন। তাঁর এই মন্তব্যে বিক্ষুব্ধ হয় দেশবাসী।
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করেন। জানা যায়, দুজনেই আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায়, তাঁদের কর্মী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত আমলে অবস্থান করতেন।
এই দুটি ঘটনায় জামায়াতের ওপর জনগণের সন্দেহ ঘনীভূত হয়। আওয়ামী লীগ আমলে জামায়াতের কর্মীরা নিদারুণ অত্যাচারের শিকার হন। যে কাউকে জামায়াত-শিবির তকমা দিয়ে আওয়ামী আমলে নির্যাতন ও অন্যায় করা হতো। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সরকারি দল অপরাজনীতি করে যা দেশকে কার্যত দুইভাগ করে তোলে। কিন্তু, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এদেশের মানুষ চায়। তা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার হোক আর ২০২৪ সালে ঘটা গণহত্যা হোক। যারা এদেশের মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে দেশবাসী চায় তাঁদের উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা হোক।
ফলত, জামায়াতের আমিরের গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করতে চাওয়ার বাসনাকে আসলে গণহত্যাকারীদের বাঁচিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা হিসেবে দেখা যেতে পারে। মনে রাখা দরকার, জামায়াত কিন্তু সময়ে সময়ে আওয়ামী লীগের সাথে জোট বেঁধেছে। বিএনপির বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালের আগে জোট বাঁধা জামায়াত ৭১ সালের স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য ২৪ এর গণহত্যাকেও ধামাচাপা দিতে চাইতে পারে তাঁদের রাজনীতির স্বার্থে।
অন্যদিকে, প্রশ্ন উঠে যে, ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় শিবিরের যে নেতারা ছিলেন, তাঁরা কি ছাত্রলীগের অপকর্মের দায় নেবেন? আওয়ামী সমর্থকেরা সবসময় দাবি করতেন যে, জামায়াত-শিবির তাঁদের দলে অনুপ্রবেশ করে অপরাধ করে। ঢাবি শিবির নেতাদের আত্মপ্রকাশ আওয়ামী সেই বয়ানকে কিছুটা হলেও প্রমাণ করে। রাজনীতির মাঠে কৌশল জরুরি, আত্মরক্ষা জরুরি, কিন্তু সততা আরও বেশি দরকার। শিবিরের আওয়ামী লীগ হয়ে যাওয়ার কৌশল তাই প্রশ্নবিদ্ধ। এর চেয়েও বড় প্রশ্ন, তবে শিবির কি আওয়ামী বয়ানের সমর্থক হয়ে উঠছে?
মোটা দাগে প্রশ্ন উঠবে, শিবির বা জামায়াত এই কাজ কেন করবে? কারণ জামায়াত ও আওয়ামী লীগ, এই দুই গণহত্যাকারী দলের পরস্পরকে দরকার। পরস্পরের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে তাঁরা তাঁদের রাজনীতি টিকিয়ে রাখে। জামায়াত না থাকলে আওয়ামী লীগ চেতনার গল্প দিতে পারবে না, অন্যদিকে জামায়াতের জন্যও এই ফাঁপা চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করা সহজ।
শুধু তাই না, বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ অসীম লুটতরাজ করেছে। দেশে ও বিদেশে সঞ্চিত এই অর্থ এখন তাঁরা নিজেদের পুনুরুদ্ধারে কাজে লাগাবে। জামায়াত, যারা এই দেশে ৫ শতাংশের আশেপাশে ভোট পায়, যাদের বিএনপি বা আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চেপে ক্ষমতায় যেতে হয়, তাঁরা এই অর্থের হিস্যা নিতে জোট করতে পারে।
অতীতেও আমরা দেখেছি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষত রাজশাহী ও চট্রগ্রামে, ছাত্রদলের জনপ্রিয়তা ও আধিপত্য ভাঙতে ছাত্রলীগ ও শিবির একজোট হয়ে কাজ করেছে। বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে রাজনীতি হলেও ছাত্রশিবিরের সাথে ছাত্রদলের লড়াইটা পুরোনো।
আবারও তা প্রমাণ হলো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কর্মীদের ওপর শিবিরের হামলায়। শিবির জানে যে, নতুন বাংলাদেশে ছাত্রদলের সাথেই তাঁদের রাজনৈতিক মোকাবিলা করতে হবে। ফলত, শিবির ও জামায়াত থেকে সাবধান থাকা জরুরি। গণতন্ত্রে সব দল ও মতের রাজনীতি করার সুযোগ আছে ঠিকই, তবে ষড়যন্ত্রী ও ঐতিহাসিকভাবে সমস্যাযুক্ত দল ও মতের থেকেও সতর্কতা আবশ্যক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন