ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ইতিহাসে স্মরণকালের মহাবিপর্যয় ঘটলেও অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য বসে নেই দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। খোদ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বিদেশে বসে প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে এখনো সরকার হটানোর ছক কষছেন বলে নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
তারই অংশ হিসেবে দেশের গোষ্ঠীগত নানা দ্বন্দ্বসহ ইস্যুভিত্তিক ঘটনাকে উসকে দেয়ার ভয়াবহ মিশনে নেমেছে দলটি। এ বিষয়ে দেশ-বিদেশে অবস্থান করা সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের বাছাইকৃত কিছু নেতার সাথে দলীয় প্রধান যোগাযোগ করে তৃণমূল পর্যায়ে উসকানি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য উৎসাহ জোগাচ্ছেন। আর ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দেশের অভ্যন্তরে আত্মগোপনে থাকা দলটির বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের মাঠপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ সক্রিয় রয়েছেন বলে একাধিক নেতার সাথে আলাপকালে জানা গেছে।
যুবলীগের এক সহ-সম্পাদক আলাপকালে জানান, আওয়ামী লীগকে হটিয়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে ছাত্ররা সরকার গঠন করতে পারলেও তারা শান্তিতে থাকতে পারবে না। দাবিদাওয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজপথে আন্দোলন করছে এবং সামনের দিনগুলোতে এরকম আরো আন্দোলনের কর্মসূচি দেখা যাবে। তিনি আরো বলেন, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েক স্তরে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের লোক রয়েছে। যারা এখনো বিভিন্ন মাধ্যমে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রীরা আত্মগোপনে থাকলেও বিভিন্ন ইস্যুতে রাজধানীতে আন্দোলন হচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ হচ্ছে, একসময় দেখবেন গৃহযুদ্ধ লেগে গেছে, যা সামাল দেয়া এই সরকারের জন্য অনেকটা কঠিন হয়ে যাবে।
ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, ভারতে বসেই দেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছেন শেখ হাসিনা। দেশের অভ্যন্তরে আত্মগোপনে থাকা একাধিক শীর্ষ নেতার সাথে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত কথা বলে তিনি আপডেট নিচ্ছেন এবং তাদের পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পরিকল্পনাও সাজাচ্ছেন। দেশী-বিদেশী শক্তি প্রয়োগ করে কিভাবে রাজনীতিতে আবার ফিরে আসা যায় সেই কৌশল কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরই আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতাসহ প্রায় সবপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ আত্মগোপনে চলে যান। ওই দিন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেলেও দেশের অভ্যন্তরে থাকা বাছাইকৃত নেতাকর্মী ও সরকারি-বেসরকারি উচ্চপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার সাথে ইনফরমাল যোগাযোগ রাখছেন। একটি রাজনৈতিক সূত্র বলছে, এই যোগাযোগের মাধ্যমে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটির সুবিধাভোগী সরকারি-বেসরকারি উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা উৎসাহিত হচ্ছেন এবং তারা মনে করছেন আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতায় আসবে। এ জন্য ৫ আগস্টের পরই ১০ আগস্ট জুডিশিয়ারি ক্যু ও ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের প্রতিবিপ্লবের বিষয়টি জোরালো আলোচনায় ছিল। যদিও দু’টি প্রতিবিপ্লব ব্যর্থ হয়। এ ছাড়া ৫ আগস্টের পর আনসারদের সচিবালয় ঘেরাও করে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা এবং একপর্যায়ে ছাত্রদের ওপর তারা মারাত্মকভাবে হামলা করে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে দুর্বৃত্তরা বাসাবাড়িতে ডাকাতি করে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে। কিছুদিন আগে বিভিন্ন স্থানে মাজার ভাঙচুর করে একটা ইস্যু তৈরি করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ।
গেল কয়েক দিন পোশাককারখানায় শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। একযোগে দুই শতাধিক পোশাককারখানা বন্ধ রাখা ও দাবি আদায়ে পোশাকশ্রমিকদের রাজপথে আন্দোলনে শ্রমিক লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একটি অংশ কাজ করে। দেশে একের পর এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হলেও তা যথাযথভাবে সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশবাহিনীর একটি অংশ নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত দেখা দিলেও সেটি দমন না করে কৌশলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পক্ষালম্বন করে ওই সঙ্ঘাত জিইয়ে রাখার জন্য স্থানীয় পুলিশের কেউ কেউ ভূমিকা রাখছেন।
সূত্র আরো বলছে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উসকানি দিয়ে শাহবাগে আন্দোলন করে একটি বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করে সুফল নিতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু কোনোটাই সুবিধা করতে পারেনি। শেখ হাসিনার ভুলের কারণে গোটা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসা অনেকটা কঠিন। সে জন্য শেখ হাসিনা মাঝে মাঝে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কিছু নেতাকে টার্গেট করে তাদের সাথে আলাপচারিতা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ও অডিও বার্তা ছাড়ছেন। সম্প্রতি বিদেশে অবস্থান করা সহযোগী সংগঠনের এক নেতার সাথে একটি অডিও বার্তা প্রকাশ পায়। ওই অডিও বার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, তিনি বাংলাদেশের কাছে আছেন, যেকোনো সময় চট করে যাতে ঢুকে পড়তে পারেন। ওই বার্তাটি রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি করলেও আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের কিছু ত্যাগী নেতাকর্মীর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা এখনো অন্তর্বর্তী সরকারের বিপক্ষে নানান বিষোদগার করছেন। এমনকি শেখ হাসিনা যে এখনো প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন তা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করে ইস্যু বানাতে চাইছেন। এসব অডিও ভিডিও বার্তায় উৎসাহিত হয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিএনপির নেতাকর্মী এবং ছাত্রদের ওপর চড়াও হচ্ছেন বলে এমন অভিযোগ উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নেতাকর্মীদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ না থাকলেও একটা ইনফরমাল যোগাযোগ আছে। দীর্ঘ দিন শাসন করা আওয়ামী লীগের অধিকাংশই বিশ্বাস করছে- তারা আবার যেকোনো সময় ক্ষমতায় চলে আসবে। এ জন্য তারা নানা উসকানিতে পা রাখছে। কিন্তু আসলে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শেখ হাসিনার দুঃশাসন এ দেশের মানুষ কখনোই ভুলবে না। সাধারণ ছাত্ররা কোনোভাবেই আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন হতে দেবে না। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা যে অডিও-ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন তা পরিকল্পিত। নির্বাচন সামনে রেখে এর মাধ্যমে তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার উপায় বের করছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক এমপি ও বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি নয়া দিগন্তকে বলেন, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের যে নির্বাচন হয়েছে- এটা আওয়ামী লীগ মনে প্রাণে বিশ্বাস করে সঠিক নির্বাচন হয়েছে। ওই প্রেক্ষাপটে ৫ আগস্ট সরকারের যে পতন হয়েছে, শেখ হাসিনা যে পালিয়ে গেছে এটা তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। তারা একপ্রকার ঘোরের মধ্যে আছে। তিনি আরো বলেন, এই যে সম্প্রতি শেখ হাসিনা বললেন, চট করে দেশে ঢুকে পড়বেন। আওয়ামী লীগের ত্যাগী এবং বঞ্চিত নেতারা এখনো মনে করছে, আসলেই তিনি দেশে ফিরে আসবেন। এ জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটিরই জানান দিচ্ছে- যদিও এটা তাদের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু বাস্তব চিত্র তো একেবারেই ভিন্ন। আওয়ামী লীগ এখন ডেথ ইস্যু।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন