নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাসের কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে গিয়ে কয়েকটি বিষয়ে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। দলটির পর্যবেক্ষণ, প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে অগ্রগতি নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সরকার তার অবস্থান এখনো স্পষ্ট করেনি।
বিএনপি নেতারা প্রশাসনে রদবদলে সরকারের একজন উপদেষ্টার কার্যক্রমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তাঁদের পর্যবেক্ষণ, ওই উপদেষ্টা আওয়ামী লীগের ‘আশীর্বাদপুষ্ট’ ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিচ্ছেন। ওই উপদেষ্টার বিষয়ে কয়েক দিনের মধ্যে বিএনপি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
গত সোমবার রাতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ বিষয়গুলো উঠে আসে। গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তারেক রহমান ভার্চুয়ালি অংশ নেন।
সভায় আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ওই দিন ঢাকায় বড় ধরনের সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারে সরকারকে সমর্থন দিতে চায় বিএনপি। কিন্তু এখনো সংস্কার কাজ শুরু হয়নি। নির্বাচনী রোডম্যাপের ঘোষণাও আসেনি।
ফলে এই সরকার তাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চায় কি না তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
বৈঠকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন উপদেষ্টার পিএস হিসেবে যাঁকে নিয়োগ করা হয়েছে তাঁর বিষয়েও আপত্তি তুলেছেন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। ওই সচিব আওয়ামী লীগ সরকারের তিনজন মন্ত্রীর পিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে দাবি করেন দলটির নেতারা। এমন ব্যক্তি কিভাবে একটি নির্দলীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টার পিএস হতে পারেন, সেই প্রশ্ন তোলেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনে যে পরিবর্তন আনছে তাতে ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগ সরকারের অনুগতরাই আছেন।
এই রদবদল নিরপেক্ষ হয়নি। বরং আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা প্রশাসনে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রশাসনের এই রদবদল ছাত্র-জনতার বিপ্লবের বিপরীতমুখী কার্যক্রম।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা প্রশাসনে বিগত সরকারের সুবিধাভোগীরা এখনো রয়ে গেছেন বলে অভিযোগ করে আসছেন। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়।
বিএনপি নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করেন, সরকার গত এক মাসে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের অগ্রাধিকার দেখা যাচ্ছে না। তা ছাড়া ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৬ বছরে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে ধ্বংস করেছে, সেই বিষয়ে যেভাবে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন তা দেখা যায়নি। বরং ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংস্কারে কাজ বেশি হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি স্বৈরাচার থেকে গণতান্ত্রিক সরকারে ফিরে আসার যে প্রক্রিয়া তার মধ্যবর্তী সরকার। তাই নির্বাচনের যৌক্তিক সময় কী, তা বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। যৌক্তিক বিষয় সমাধান করে নির্বাচনে যাওয়া খুব সহজ বিষয়।’ তিনি বলেন, সরকারকে তো নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। কিন্তু নির্বাচনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা ও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর যদি কিছু ব্যক্তির মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করে, তাহলে তো প্রশ্ন তৈরি হবে।
বৈঠকে একজন নেতা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা দেশের বিভিন্ন স্থানে মতবিনিময়কালে বিএনপিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য রাখছে। অথচ বিএনপি স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ১৬ বছর ধরে নির্যাতিত ও গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি। এই আন্দোলনে তাদের অনেক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। ফলে সমন্বয়কদের বক্তব্যে দলের তৃণমূলে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে।
স্থায়ী কমিটির আরেকজন সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা কোনোভাবে তাঁরা অস্বীকার করেন না। তবে তাদের ভুলে গেলে চলবে না, এই আন্দোলন ১৭ বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং ছাত্র সমন্বয়কদের এমন বক্তব্য দেওয়া উচিত হবে না যাতে তাঁদের বিষয়ে ভুল ধারণা তৈরি হয়।
বৈঠকে ঢাকার বাইরে সফরের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সার্বিক নিরাপত্তা দিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে গত রবিবার জেলা প্রশাসকদের কাছে যে চিঠি দেওয়া হয়, সেটি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ চিঠিটি বৈঠকে পড়ে শোনানো হয়।
বৈঠক সূত্র জানায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড নিয়েও বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়। বৈঠকে একজন নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ গত ১৬ বছর গুম-খুন, মামলা-হামলা, অত্যাচার-নির্যাতন করলেও জামায়াত আমির তাদের ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ছাড়া জামায়াত নেতারা ভারত নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছে তা সমর্থনযোগ্য নয়। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, আন্দোলনের শরিকদের নিয়ে তাঁরা পথ চলতে চান। কিন্তু তাতে জামায়াতের ভূমিকা কী হতে পারে তা নিয়ে তাঁদের সন্দেহ আছে।
এ ছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরালো করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য। বৈঠকে সাংগঠনিক পুনর্গঠন শুরুর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি পুনর্গঠন করা দরকার।
এদিকে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী গতকাল বলেছেন, ‘আজকে ৩৪ জন ডিসি নিয়োগ দিয়েছেন। এই ডিসিদের সবই ছিল ছাত্রলীগের। ছাত্রলীগের মধ্যে যে ভালো ছেলে নেই তা তো না। কিন্তু বেশির ভাগই আপনারা কোটা বৃদ্ধি করে তাঁদের নিয়েছেন—এটাও মেরিটে আসতে পারত না। এঁরা এখন ডিসি হয়ে গেছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন