নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় না হওয়ায় ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে তা প্রতিহত করার ডাক দিয়েছিল বিএনপি। দলটি এবারো একই পথে এগোচ্ছে। দলীয় সরকারের অধীনে ‘প্রহসনের’ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার যে দৃঢ় অবস্থান বিএনপি এতদিন ব্যক্ত করেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন জমা দেয়ার সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেটি এখন শতভাগ স্পষ্ট। জানা গেছে, বিএনপি ছাড়াও আরো ৫৯টি রাজনেতিক দল আসন্ন এই নির্বাচন বর্জন করছে। ইতোমধ্যে দলগুলো এ বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছেছে।
বিএনপি এসব দলগুলোকে সাথে নিয়ে নির্বাচন ‘প্রতিহত’ করার ডাক দিয়ে শক্তভাবে কিভাবে মাঠে থাকা যায়, সেই কৌশল নির্ধারণে কাজ শুরু করেছে বলে শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন। তবে দলটির নেতাদের কারো কারো ধারণা, ৭ জানুয়ারি নির্বাচন নাও হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান নয়া দিগন্তকে বলেন, বিএনপি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য, জনগণের ভোটাধিকার পুনর্বহালের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এই আন্দোলন চলতেই থাকবে যতদিন না গণমানুষের আকাক্সক্ষা পূর্ণ হয়। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল পাতানো নির্বাচনের তফসিল বর্জন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বও এই নির্বাচন নিয়ে আস্থাহীনতার প্রশ্ন তুলেছে। তারা যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিল, সরকার তা আমলেই নেয়নি। ফলে জাতিসঙ্ঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ নির্বাচনে পর্যবেক্ষকও পাঠাচ্ছে না। কারণ তারা বুঝে গেছে, নির্বাচনের নামে এখানে কত বড় প্রহসন হতে যাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিলে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না বিএনপি। দলটি এই মুহূর্তে আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচন ঠেকানোর পথে হাঁটছে। এ লক্ষ্যে দলে নানা ধরনের কৌশল ঠিক করা হচ্ছে। পাশাপাশি চলমান একদফার আন্দোলন আরো জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার যুগপৎ আন্দোলনের সব শরিককে নিয়ে একত্রে বৈঠক করেছে বিএনপি। গত ৩০ ডিসেম্বর সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন শুরুর পর এটি ছিল এ ধরনের প্রথম বৈঠক। শিগগিরই এমন বৈঠক আরো হবে। এ ছাড়া যুগপতের বাইরে থাকা যেসব দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না তাদের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে, যাতে বিএনপির ভোট ঠেকানোর আন্দোলনে তারাও যোগ দেয়।
বিএনপি ও যুগপৎ শরিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হওয়ায় এখন আন্দোলনকে দুই পর্বে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। প্রথম পর্ব হচ্ছে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় পর্ব হলো ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন পর্যন্ত। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের এই কর্মসূচির ব্যাপারে ইতোমধ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে আগামীকাল রোববার সকাল থেকে নবম ধাপে দেশব্যাপী ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শুরু হবে, যা আগামী মঙ্গলবার সকাল ৬টায় শেষ হবে। তবে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচির প্রভাব ক্রমেই কমে আসায় আন্দোলনকে আরো গতিশীল করতে বিকল্প একাধিক কর্মসূচি বিএনপির নীতিনির্ধারকদের ভাবনায় রয়েছে। এর অংশ হিসেবে গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সম্মিলিত শ্রমিক পরিষদের (বিএসপি) উদ্যোগে শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গার্মেন্ট শ্রমিক হত্যার বিচার, হতাহতদের ক্ষতিপূরণ, আহতদের সুচিকিৎসা, দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, আন্দোলনে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, কর্মচ্যুতদের কাজে পুনর্বহাল ও ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা ঘোষণার দাবিতে এই শ্রমিক সমাবেশ হয়। কর্মসূচিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানসহ যুগপতের শরিক বিভিন্ন দলের নেতারা ছিলেন। এর আগে বিএনপির কারাবন্দী, গুম-খুন ও নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীর স্বজনদের নিয়ে তাদের ব্যানারে গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান উপস্থিত ছিলেন। কারাবন্দী স্বজনদের এই কর্মসূচিকে বিভাগীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে বিএনপির হাইকমান্ডের। এ ছাড়া যুগপতে থাকা দলগুলোর অঙ্গ সংগঠনকে নিয়ে ঢাকায় নারী সমাবেশ, যুব সমাবেশ, শ্রমিক সমাবেশ, ছাত্র সমাবেশের কথাও ভাবছে বিএনপি। ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের পাশাপাশি জনসম্পৃক্ত এসব কর্মসূচি করার কথা ভাবা হচ্ছে।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মামলায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া গ্রেফতার এড়াতে বাকি নেতারা নিরাপদ অবস্থানে থেকে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে বিকল্প এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে আসতে চান।
তফসিল অনুযায়ী ১৮ ডিসেম্বর থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হবে। তখন পরিস্থিতি বুঝে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি চূড়ান্ত করবে বিএনপি। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, নির্বাচনের কয়েক দিন আগে থেকে ফের হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে যেতে পারে দলটি। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন সারা দেশে হরতালের ডাক দেয়া হতে পারে। এ ছাড়া নির্বাচনের পরেও হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি অব্যাহত থাকতে পারে।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোট বয়কট করে তা প্রতিহতে আন্দোলনে নামে বিএনপি ও দলটির নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ১৮ দলীয় জোট। নির্বাচনের আগে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচির ডাক দেয়া হয়, যা নির্বাচনের পরেও বেশি কিছুদিন অব্যাহত ছিল। ওই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পায় আওয়ামী লীগ ও এর শরিক দলগুলো। ওই নির্বাচনে মোট ১৭টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। ভোট নেয়া হয় ১৪৭টি আসনে।
এ দিকে আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিতে সরকারবিরোধী দল ও জোটগুলোকে এক মঞ্চে আনার কথা ভাবছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার যুগপৎ আন্দোলনের সব শরিককে নিয়ে একত্রে বৈঠক করেছে দলটি। আন্দোলনকে বেগবান করতে সেখানে যুগপতের পরিধি বাড়ানোর ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে যুগপতে থাকা ৩৯টি দল ছাড়াও বাইরে থেকে এবি পার্টি অংশ নেয়। এ ছাড়া নির্বাচন বর্জন করে যুগপতের বাইরে আন্দোলনে থাকা অন্য দল ও জোটকেও যুগপতে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে আলোচনা হয়েছে ‘একতরফা’ নির্বাচন ঠেকানোর কর্মকৌশল নিয়েও। এর অংশ হিসেবে তফসিল বাতিলের দাবির পাশাপাশি ভোটারদের ভোট বর্জন করার আহ্বানও জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, শিগগিরই আবার বৈঠকে বসবে যুগপতের ৩৯ দল। সেখানে যুগপতের বাইরে থাকা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী দলগুলোর মোর্চা ‘সমমনা ইসলামী দলগুলো’ এবং বাম গণতান্ত্রিক জোটকেও আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে। জানা গেছে, ইতোমধ্যে ৬০টি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।
যুগপতে থাকা একটি দলের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, একদফার আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে আমরা যুগপতের পরিধি বাড়ানোর চিন্তা করছি। এ লক্ষ্যে নির্বাচন বর্জন করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা দল ও জোটগুলোকে যুগপতে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাদের সাথে যোগাযোগও করা হচ্ছে। যদি যুগপতে সম্পৃক্ত হতে রাজি না হয়, তাহলে তারা আগের মতো নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্দোলন করবেন। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যাশা- এখন থেকে একতরফা ভোট ঠেকানোর আন্দোলনকে তারা আরো বেগবান করবেন।
ওই নেতা আরো বলেন, বাম গণতান্ত্রিক জোট ছাড়া বাকিরা যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ দিকে নির্বাচন ঠেকানোর কৌশলের অংশ হিসেবে বিএনপি ও শরিকদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ভোটারদের ভোট বর্জনের আহ্বান জানানো হয়েছে। জানা গেছে, ভোট বর্জনের এই আহ্বান অব্যাহত রাখা হবে। বিএনপি ও শরিকদের লক্ষ্য, নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ন্যূনতম করা। ভোটারদের অনুপস্থিতিতে ভোট হলে সেই নির্বাচন বিদেশীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
এ বিষয়ে ড. মঈন খান বলেন, ৭ জানুয়ারি আরেকটি নির্বাচনী সার্কাসের দিকে দেশকে ধাবিত করা হচ্ছে, যা শুধু দেশের ভেতরে নয়, সারা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষের সামনে একটি কলঙ্কময় ভাবচিত্র প্রতিস্থাপন করবে।
তিনি বলেন, এই নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে উচ্ছ্বাস কিংবা আগ্রহ কোনোটাই নেই। কারণ নির্বাচনের ফলাফল ইতোমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে গেছে। ক্ষমতার মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে এই যে নির্বাচন নির্বাচন খেলা, সেটির পরিণাম কখনোই জাতির জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না। বিএনপির এই শীর্ষ স্থানীয় নেতা বলেন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ দেশে জনগণের আন্দোলন কখনোই বৃথা যায়নি। এবারো যাবে না। সরকার মনে করেছে, আগের মতো এবারো একতরফা একটি নির্বাচন করে স্বাচ্ছন্দ্যে ক্ষমতায় থাকবে, সেটা হওয়ার নয়, কেননা এখন ২০১৪ বা ২০১৮ নয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন