বাঙালির শৈশবটাই শুরু হয় ভীতি দিয়ে। ‘অজগর ওই আসছে তেড়ে’ ছড়া সব অভিভাবকই সন্তানকে শেখান বড় হয়ে ওঠার শুরুতে। অজগরের মতো ভয়ানক সাপ যাদের শৈশবের কল্পনায় শুরু হয়, তার জীবনে শব্দদূষণ যেন মামুলি ব্যাপার। দেশে ৫২ বছরে কোনো যুদ্ধ না লাগলেও শব্দদূষণে নাগরিকরা প্রতিদিন যেভাবে বধির হওয়ার দিকে যাচ্ছে, তা কোনোভাবেই যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। ঢাকা শহরের শব্দদূষণ এখন বিশ্বে শীর্ষে। ৮০ থেকে ৮৫ ডেসিবেল নিয়মিত শুনলে একজন স্বাভাবিক মানুষ বধির হয়ে যায়, সেখানে ঢাকায় গড়ে ১২৫ ডেসিবেলের শব্দ শুনতে হয় তাদের। শব্দদূষণ কমানোর জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরও উদ্যোগ নিয়েছে। বিধি বাম, উদ্যোগের পুরো টাকাই বলা যায় জলে গেছে।
গত ১৬ অক্টোবর ঘটা করে ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে পুরো শহরে এক মিনিট নীরবতা পালনের সিদ্ধান্ত নেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু ওই এক মিনিটই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে শহরবাসীর জন্য। মোদ্দাকথা, এক মিনিটও নীরবতা পালন করানো যায়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তর ২০২০ সালে ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক প্রকল্প’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করে। ৪৮ কোটি টাকার এই প্রকল্প একবার মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু তাও শেষ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আবার ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়ে দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। ইতিমধ্যে সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভাও হয়েছে।
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ উন্নয়নে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ বাস্তবায়নে অংশীজনদের সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা। তা ছাড়া শব্দদূষণের মাত্রা, উৎস এবং এর প্রভাব নিয়েও তথ্য সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণের কথা রয়েছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে।
এই প্রকল্পের মূল কার্যক্রম ছিল অংশীজনদের নিয়ে সভা সেমিনার করা, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি, শিক্ষক, চালক, নির্মাণ ও কারখানার শ্রমিক ও ইমামদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। বাস্তবে এর প্রতিফলন খুবই কম দেখা গেছে।
এ ছাড়া এই প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্যে আরও রয়েছে, ৬৪ জেলায় শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে জরিপ করা, শব্দদূষণমুক্ত এলাকা তৈরিতে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা।
প্রকল্পটির গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের আরও কয়েকটি হলো শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সব জেলা শহরে ১ হাজার ৪৭৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা। ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন ২০১০-এ শব্দদূষণ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে কর্মশালা ও অংশীজন মতবিনিময় সভার আয়োজন করা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্যে দেখা যায়, দেশের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ মানুষ কানে কম শোনার সমস্যায় ভুগছে।
শহরের বিভিন্ন জায়াগায় ঘুরে দেখা গেছে, সড়ক বিভাজকে পরিবেশ অধিদপ্তরের শব্দদূষণ না করার আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি রয়েছে। কিন্তু গাড়িচালকরা কেউই সেসব মানতে নারাজ। ফাঁকা রাস্তায়ও যেমন হর্ন বাজানোর বাহাদুরি চলছে, তেমনি হাসপাতাল, বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় সব অতিস্পর্শকাতর জায়গায়ও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ‘শব্দ-সন্ত্রাস’।
গত বুধবার রাজধানীর ফার্মগেট, বাংলা মোটর ও শাহবাগ এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, বেসরকারি খাতের যান চালকরা যেমন আইন অমান্য করে ‘শব্দ-সন্ত্রাস’ করে চলছেন, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ির সাইরেন বাজানোতেও; বিশেষ করে শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশের রাস্তায় শব্দের তীব্রতা এত বেশি যে রোগীরাও তা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরেও একই চিত্র দেখা যায়। এতে যেন অসহায় নগরের ট্রাফিক পুলিশরাও। নিরুপায় এসব ট্রাফিক পুলিশ অনেকেই নিজেরাই প্রায় বধির হওয়ার পথে।
রাজধানীর বাংলা মোটর এলাকার পুলিশ সার্জেন্ট শফিউল ইসলামের কাছে ‘শব্দ-সন্ত্রাসের’ ভয়াবহতা নিয়ে জানতে চাইলে দেশ রূপান্তরের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘চাকরিজীবনের শুরুতে আমি স্বাভাবিকই শুনতে পেতাম। এখন নিয়মিত এখানে ডিউটি করার কারণে কানে অনেক কম শুনতে পাই, কয়েকবার ডাক্তারও দেখিয়েছি। কিন্তু থাকতে হয় এই শব্দদূষণের মাঝেই। আমার সহকর্মীদের অবস্থাও আরও ভয়াবহ।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমরা মানুষকে সচেতন হতে বলি, কিন্তু মানুষ সচেতন না হলে কিছুই করার নেই।’
ঠিক কত ডেসিবেল শব্দ মানুষের সহ্য ক্ষমতার মধ্যে থাকে এ-সম্পর্কে এই প্রতিবেদক জানতে চেয়েছিলেন নাক, কান ও গলা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ডা. মানস রঞ্জন চক্রবর্তীর কাছে। তার মতে, ‘আমরা গ্রহণযোগ্য ক্ষমতা ধরি স্বাভাবিকভাবে ৬০ ডেসিবেল। প্রায় ২৫টি স্থানে এর মাত্রা মেপেছিলাম। তখন দেখা যায়, এসব এলাকায় গ্রহণযোগ্য শব্দের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ ডেসিবেল বেশি। কোনো কোনো জায়গায় আমরা দেখেছি প্রায় ৩০ ডেসিবেলও বেশি।’
তিনি বলেন, সপ্তাহে যেকোনো ব্যক্তি ৮ ঘণ্টা সর্বোচ্চ ৮০ ডেসিবেল শব্দ শুনতে পারবে। এর চেয়ে বেশি বা ৯০-৯৫ ডেসিবেল হলে তার শব্দ শ্রুতি ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। এটি শহরে ধীরে ধীরে বাড়ছে। এটি এখন একটি অদৃশ্য সমস্যা, বধিরতা বাইরে থেকে দেখা যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের যোগাযোগে সমস্যা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত বুঝতে পারেন না তিনি এতে আক্রান্ত।
বায়ুদূষণের মাত্রা যে চরম সীমায় পৌঁছে গেছে তা স্বীকার করে ১০০ দিনের পরিকল্পনায় বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। জনস্বাস্থ্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা কাজ করতে চাই। আমাদের সংবিধানেও জনস্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আন্তঃসমন্বয়টা জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যর মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সেটিকে আমরা আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করব। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার, পানিসম্পদ বিষয়টিও জড়িত। সবার সমন্বয়ে কাজ করতে হবে।’
২০২০ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের দায়িত্ব পালনরত ২০০ ট্রাফিক পুলিশের শ্রবণ স্বাস্থ্যের ওপর জরিপ চালায় ক্যাপস। জরিপে দেখা যায়, শব্দদূষণে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ জানান, সাধারণভাবে মোবাইলে কথা শুনতে তাদের অসুবিধা হয়। ১৯ দশমিক ১ শতাংশ জানিয়েছে, ঘরের অন্য সদস্যদের তুলনায় বেশি ভলিউম দিয়ে তাদের টিভি দেখতে হয়। আর ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ জানিয়েছে, অন্যরা উচ্চ স্বরে কথা না বললে তাদের কথা শুনতে কষ্ট হয়। ৮ দশমিক ২ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ জানিয়েছে, কয়েক ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের পর তারা ঘূর্ণিরোগ, মাথা ভনভন করা, বমি বমি ভাব ও ক্লান্তির সমস্যায় ভোগে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার অনেক প্রকল্পই নেয়। কিন্তু প্রকল্পের নামে লুটপাটই দেখি সব সময়। জনগণের স্বার্থে অনেক আইন হয়। কিন্তু কোনোটারই যথাযথ বাস্তবায়ন আমরা দেখি না।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহর কয়েক বছর ধরে শব্দদূষণে শীর্ষে। কিন্তু সমস্যা হলো সরকার জলবায়ু প্রকল্পের টাকায় ফ্লাইওভার বানায়। কারণ এগুলো দিয়ে লুটপাট করা যায়।’
আলমগীর কবির বলেন, ‘আমরা সব সময় শব্দদূষণের ক্ষেত্রে দেখি হাইড্রোলিক হর্নের ব্যাপারটি। আমাদের গবেষণায় দেখেছি, এই হাইড্রোলিক হর্নের মাত্রা ১১০ থেকে ১২০ ডেসিবেল পর্যন্ত ওঠে। ২০২২ সালের তুলনায় হৃদরোগের রোগীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে শুধু শব্দদূষণের কারণে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন