রাজধানীতে অতিরিক্ত বাসভাড়া আদায় ঠেকাতে চালু করা ই-টিকিটিং ব্যবস্থা হোঁচট খেয়েছে। ফলে যাত্রীরা আগের মতোই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
রাজধানীতে অতিরিক্ত বাসভাড়া আদায়ের অভিযোগ অনেক দিনের। এই সমস্যা নিরসনে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেয়।
গত ৩১ আগস্ট বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ে বাস-মিনিবাসের ভাড়া পুনর্নির্ধারণসংক্রান্ত সভা শেষে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা দেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। ই-টিকিটিংয়ের ব্যবস্থাটি ধীরে ধীরে সব পরিবহনের বাসে বাধ্যতামূলক করা হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
বাসমালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে গত ২২ সেপ্টেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে চারটি পরিবহন কোম্পানিতে ই-টিকিটিং চালু হয়। বর্তমানে চারটিসহ মোট আটটি পরিবহন কোম্পানির বাসে ই-টিকিটিং চালু রয়েছে।
ই-টিকিটিং ব্যবস্থায় সরকার নির্ধারিত হারে একজন যাত্রী যত কিলোমিটার যাবেন, তিনি ঠিক তত দূরত্বের জন্যই ভাড়া দেবেন। এই ব্যবস্থা চালুর পর যাত্রীরা স্বস্তি প্রকাশ করেছিলেন। এ নিয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো অনলাইনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
কিন্তু এক মাস না যেতেই এখন উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। ই-টিকিটিং নিয়ে যাত্রীরা হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, চালু হতে না হতেই উদ্যোগটি অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাঁরা আগের মতোই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, কিছু বাসমালিক ও শ্রমিক এই উদ্যোগে অসহযোগিতা করছেন। অন্যদিকে ই-টিকিটিংয়ের আওতায় থাকা একটি পরিবহন কোম্পানি বলছে, তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যাত্রীদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে না।
বাসের দেখা মিলছে না
ই-টিকিটিংয়ের আওতায় থাকা কিছু মালিক বাসের নাম পাল্টে অন্য নামে তা সড়কে চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগ খোদ সংশ্লিষ্ট পরিবহনের কর্মীদের।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে এমনই এক পরিবহনকর্মীর সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি আশীর্বাদ পরিবহনের একটি বাস দেখিয়ে বলেন, এটি ই-টিকিটিংয়ের বাস ছিল। মালিক নাম পাল্টে আশীর্বাদ করে সড়কে চালাচ্ছেন। ফলে টিকিট কেটেও যাত্রীরা বাসের দেখা পাচ্ছেন না। দেখা পাবেন কেমন করে, বাসের সংখ্যাই তো কমে গেছে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে চারটি পরিবহন কোম্পানিতে ই-টিকিটিং চালু হয়
গত ২২ সেপ্টেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে চারটি পরিবহন কোম্পানিতে ই-টিকিটিং চালু হয়ছবি: প্রথম আলো
দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিবহনকর্মীদের বক্তব্য, বাসই তো আসে না, তাঁরা যাত্রীদের ই-টিকিট দেবেন কেমন করে?
অবশ্য ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক আইনজীবী মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাসের নাম পাল্টে ফেলার বিষয়টি এত সহজ নয়। এখানে রুট পারমিটসহ বিভিন্ন বিষয় আছে। তবে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালুর পর কিছু মালিক এমন চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের চিঠি দিয়ে আগের ব্যানারেই বাস চালাতে বলে দেওয়া হয়েছে।
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি দূরত্বে প্রজাপতি ও পরিস্থান পরিবহনের টিকিট কাউন্টার অবস্থিত। দুটি কোম্পানিই ই-টিকিটিংয়ের আওতাভুক্ত। গতকাল বেলা ৩টা থেকে ৩টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত এই কোম্পানির দুটি কাউন্টার ঘুরে দেখা যায়, বাসের দেখা নেই বলে যাত্রীদের টিকিট দেওয়া হচ্ছে না।
প্রজাপতির কাউন্টারে বেশ কয়েকজন যাত্রী টিকিট কেটে অপেক্ষা করছিলেন। অন্য কোম্পানির একটি বাসস্ট্যান্ডে এলে প্রজাপতির কাউন্টারের কর্মীরা টিকিটের টাকা ফেরত দিয়ে যাত্রীদের ওই বাসে চলে যেতে বলেন।
জানতে চাইলে টিকিট বিক্রির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মী বলেন, বাস আসে না। যাত্রীরা আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন?
তার আগে প্রজাপতির একটি বাস এলে যাত্রীদের সবাই হুড়োহুড়ি করে ওঠার চেষ্টা করেন। অবশ্য বাসটি আগে থেকেই যাত্রীতে ঠাসা ছিল। বাসের সংখ্যা কম বলেই এমন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বাসে উঠতে না পারা এক যাত্রী।
পরিস্থান পরিবহনের কাউন্টারের কর্মীদের গতকাল বেলা ৩টার দিকে অলস সময় কাটাতে দেখা যায়। কোনো যাত্রী কাউন্টারে এলে তাঁরা বলছিলেন, বাস না এলে টিকিট দিয়ে কী হবে?
যাত্রীরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে যাচ্ছিলেন। যে যন্ত্রের মাধ্যমে যাত্রীদের টিকিট দেওয়া হয়, তা দেখিয়ে একজন কর্মী বলেন, এখন বেলা তিনটার বেশি বাজে। এখন পর্যন্ত একটা টিকিটও বিক্রি হয়নি।
টিকিট বিক্রির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা জানালেন, তাঁরা এখন নিয়মিত পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না।
একজন কর্মী বলেন, তাঁরা শুনেছেন, মালিকেরা দফায় দফায় মিটিং করছেন। তাঁরা বাসের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছেন। মালিকদের নাকি ক্ষতি হচ্ছে।
পরিস্থান পরিবহনের কাউন্টারে বাসের অপেক্ষায় থাকা এক নারী যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এরা নাকি আবার সব বাসে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করবে! শুরুর পরই তো ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা!
গতকাল প্রজাপতি বাসের কাউন্টার থেকে মিরপুর ১০ নম্বরের একটি টিকিট নেন বেসরকারি কর্মজীবী অঙ্কুর রায়। একপর্যায়ে তিনিও টিকিটের টাকা ফেরত নিয়ে অন্য বাসে রওনা দেন।
ধানমন্ডি থেকে মিরপুর ১ নম্বরে যাতায়াত করেন কর্মজীবী ফাতেমা বেগম। তিনি জানালেন, ই-টিকিট চালুর প্রথম দিকে প্রজাপতি বাসে সিট পাওয়া যেত। কিন্তু এখন বাসে আর বসার জায়গা পাওয়া যায় না। টিকিট কেটেও বেশির ভাগ দিন দাঁড়িয়ে যেতে হয়। এখন টিকিট বিক্রেতাদের খুঁজে বের করতে হয়। ফলে ভোগান্তিটা থেকেই যাচ্ছে।
ফেসবুকে আলোচনা
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টসহ বিভিন্ন গ্রুপে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা লক্ষ করা গেছে।
রাতিন রহমান একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করেন। পেশাগত কারণে তাঁকে প্রায় প্রতিদিন মিরপুর থেকে উত্তরা, মিরপুর থেকে বনানী যাতায়াত করতে হয়। তিনি ৯ অক্টোবর তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, কালশী থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত ভাড়া টিকিটের গায়ে লেখা ১৩ টাকা। ২০ টাকার নোট দিলে টিকিট বিক্রেতা বাকি সাত টাকা ফেরত দেননি। কেন ফেরত দিলেন না, জানতে চাইলে টিকিট বিক্রেতা বলেন, ভাড়া ২০ টাকা। টাকা ফেরতের ব্যাপারে তিনি জোর দেন। তখন টিকিট বিক্রেতা বলেন, তাঁর কাছে ভাংতি নেই। পরে তিনি নিজেই ভাংতি দেন।
আক্ষেপ করে রাতিন রহমান লিখেছেন, আগে এতগুলো বছর এরা কি পরিমাণ বাড়তি ভাড়া প্রতিদিন লুটপাট করেছে যাত্রীদের কাছ থেকে, ভাবা যায়!
রাখাল চন্দ্র শীল নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, শাহবাগ থেকে রামপুরার জন্য সরকারি ভাড়া ১৫ দশমিক ২৪ টাকা। আর ভাড়া আদায় করে ৩৭ টাকা। যাত্রীর পকেটের কী হচ্ছে, তা দেখার কেউ নেই।
রাফসান আলী নামের একজন লিখেছেন, মিরপুর ১০ নম্বর থেকে শেওড়াপাড়ার ভাড়া ২৩ টাকা। ৩০ টাকার নিচে তারা টিকিট দিতে চায় না। কারণ জানতে চাইলে বলে, যেতে না চাইলে যাবেন না।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়
এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের আলোকে ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানায়, রাজধানীর গণপরিবহনে যাত্রীদের কাছ থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।
সংগঠনটির ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ২০ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন গণপরিবহনে ভাড়া আদায় পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীতে পাঁচ হাজার লক্কড়ঝক্কড় বাস-মিনিবাসের সব কটিতেই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যেখানে প্রত্যেক যাত্রীর কাছ থেকে গড়ে ১৭ টাকা বেশি ভাড়া নেওয়া হয়।
যাত্রীদের দোষারোপ
প্রজাপতি পরিবহন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ই-টিকিটিংয়ে উদ্যোগটি ভালোভাবেই চলছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যাত্রীদের কাছ থেকে তাঁরা সহযোগিতা পাচ্ছেন না। যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠছেন। কম ভাড়ার টিকিট কেটে বেশি দূরত্বে যাচ্ছেন। টিকিট ছাড়া যাত্রীরা বাসে চড়ছেন। মালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত মোহাম্মদপুরে একটি পরিবহনের কোনো বাস আসেনি। সে কারণে টিকিট বিক্রিও হয়নি বলে কর্মীরাই দেখালেন
গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত মোহাম্মদপুরে একটি পরিবহনের কোনো বাস আসেনি। সে কারণে টিকিট বিক্রিও হয়নি বলে কর্মীরাই দেখালেন ছবি: প্রথম আলো
বাসের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে রফিকুল বলেন, সরকার প্রজাপতি পরিবহনের ১৭২টি বাসের রুট পারমিট দিয়েছে। কিছু গাড়ি ঢাকার বাইরে চলছে। প্রজাপতি পরিবহনের বাসগুলো ২০১৩-২০১৪ সালের। অনেক গাড়ির ইঞ্জিন নষ্ট। মেয়াদ শেষে কিছু গাড়ি মালিকই বাতিল করে দিয়েছেন। চাকা নষ্ট বা বিভিন্ন কারণে কিছু গাড়ি রাস্তায় চলতে পারে না। তাই বাসের সংখ্যা ইচ্ছাকৃতভাবে কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়।
তবুও আশা
কিছু মালিক ও শ্রমিক ই-টিকিটিং উদ্যোগে অসহযোগিতা করছেন বলে জানান ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতা মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, টুকটাক কিছু সমস্যা হচ্ছে। ই-টিকিটিং ব্যবস্থায় মালিকেরা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি লাভবান হচ্ছেন না। বিনা টিকিটে যাত্রী নিচ্ছেন শ্রমিকেরা। এ টাকা মালিকেরা পাচ্ছেন না। যাত্রীদের কম টাকায় বেশি দূরত্বে যাওয়াসহ বেশ কিছু অনিয়ম হচ্ছে। এগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হচ্ছে। তবে তাঁরা আশাবাদী, ই-টিকিটিংয়ের উদ্যোগটি ফলপ্রসূ হবে। চলতি মাসের মধ্যেই মিরপুর, সায়েদাবাদ ও গুলিস্তানের আরও ২৪টি পরিবহনের বাসকে ই-টিকিটিংয়ের আওতায় আনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন