রাজধানীর মানুষের কাছে বৃষ্টিবিলাস এক রকমের অপরিচিত উদ্যাপন। বৃষ্টি মানেই রাস্তায় পানি জমে যাওয়া, ঘরে পানি ঢোকা ও নানা রকমের ভোগান্তি।
এক সময় ঢাকায় ৪০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টি না হলে পানি জমতো না। কিন্তু চলতি বছরের বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ওপরে পর্যালোচনা চালিয়ে দেখা যায়, ২৫-৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেই ডুবে যায় ঢাকা শহর। জমে থাকা পানি নামতে সময় লাগে ৭-৮ ঘণ্টা।
এদিকে দুদিন পরপর রাস্তা মেরামত ও বৃষ্টির সহবস্থানের ফলে রাস্তার পিচে ব্যবহৃত বিটুমিনসহ অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ গিয়ে পড়ে নিকটস্থ জলাশয়ে। এতে বাড়ছে পানি দূষণ ও শহরের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম সময় সংবাদকে বলেন, বন্যার বিপরীত ঘটনাটি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। বন্যায় নদীর পানি ভেতরে ঢোকে আর জলবদ্ধতায় শহরের পানি জলাশয়ের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু নানা কারণে আমাদের ড্রেনগুলো আটকা পড়ে যাওয়ায় পানি যেতে পারে না। জলাবদ্ধতার প্রথম অসুবিধা হচ্ছে নগরের মানুষ পানিকবলিত হয়ে পড়ে। পানি তো আর সবসময় স্থির থাকবে না- এটা গিয়ে এক সময় নদীতে পড়ে। যখন নগরের পানিটি নদীতে যায় তখন এটি তিন ধরনের বর্জ্য নিয়ে যায়। একটি হচ্ছে ফিজিক্যাল বর্জ্য যেমন, প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন ইত্যাদি। পলিথিন ডুবে গিয়ে নদী খালের তলানিতে জমা হয়, আর বোতল দিনের পর দিন ভাসতে ভাসতে শেষমেশ গিয়ে পড়ে বঙ্গোপসাগরে।
অন্যদিকে আরেক বর্জ্য হচ্ছে বায়োলজিকাল যেমন মানুষের মলমূত্র। এগুলো একসময়ে পানিতে মিশে যায়। তবে সবচেয়ে ভয়ানক হচ্ছে কেমিক্যাল বর্জ্য। বিটুমিন এদের মধ্যে একটা- যা পানিতে মিশে পানি দূষণ থেকে শুরু করে ভয়ানক স্বাস্থ্যহানির কারণ হতে পারে। পানিতে কেমিক্যাল পড়লে স্বভাবতই পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়, যা পরিবেশগত জায়গা থেকে বাস্তুসংস্থানে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
শহিদুল ইসলাম বলেন, বায়োলজিক্যাল বর্জ্য আপনি শোধনের মাধ্যমে সামাল দিতে পারবেন, ফিজিক্যাল বর্জ্য ছেঁকে পরিষ্কার করতে পারবেন, কিন্তু কেমিক্যাল বর্জ্য কিন্তু আপনি সহজে দূর করতে পারবেন না। পরিবেশে এটির প্রভাব মারাত্মক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দিনকে দিন ঢাকা শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে ২৫ হাজার কিলোমিটার খোলা এবং চার হাজার কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ ড্রেন আছে। ঢাকা ওয়াসার ৬৫ কিলোমিটার খোলা খাল ও বক্সকালভার্ট আছে। তবে শহরের বর্জ্যের তুলনায় এ ড্রেনেজ ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৬ হাজার ১১০ টন গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। অথচ এর বিপরীতে ঢাকায় মাত্র ৪০ শতাংশ এলাকা ড্রেনেজ ব্যবস্থার আওতায় আছে। বাকি ৬০ শতাংশ এলাকায় পানি নিকাশ হয় প্রাকৃতিকভাবে। কিন্তু প্রাকৃতিক মাধ্যম খাল ও অন্যান্য জলাশয়গুলো ভরাট করে ফেলা, ময়লা ফেলে নোংরা করে ফেলার ফলে শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নাজুক অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে।
এ ব্যাপারে শহীদুল বলেন, ড্রেন বলতে আমরা বুঝি যে একটা নালা আছে। কিন্তু যে নালাটি দিয়ে পানি যাবে সেটিতো পরিষ্কার নেই। শহরের বিভিন্ন জায়গায় অনেক বড় বড় ড্রেন আছে, বড় আকারে পাইপ আছে। কিন্তু সেগুলো যদি পরিষ্কার না থাকে, সেগুলো দিয়ে যদি পানিই যেতে না পারে তাহলে লাভ কী! আপনি খেয়াল করলে দেখবেন অবকাঠামোগত অনেক কাজের জন্য বালু-মাটি আনা হয়। এগুলো রাস্তায় পাশেই রাখা যায়। বৃষ্টি হলে এসব বালু-মাটি ধুয়ে গিয়ে পড়ে ড্রেনে। এতে করে ড্রেনের পুরুত্ব নষ্ট হয়, ব্যাঘাত ঘটে পানি নিষ্কাশনে।
এক সময়ে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিয়ে ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন কাদা ছোড়াছুড়ি করলেও দুবছর আগে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে রাজধানীর খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে সিটি করপোরেশনের অনেক কর্মযজ্ঞের পরও এখনও জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসন হয়নি।
জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচেভেলের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার জন্য ১১টি মূল কারণকে শনাক্ত করা হয়। এগুলো হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ন, যত্রতত্র ময়লা ফেলা, বর্ষায় রাস্তা মেরামত, নদী ভরাট, খাল দখল, আশপাশের জলাশয় ভরাট, বুড়িগঙ্গায় অব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত বক্স কালভার্ট, পলিথিনের অবাধ ব্যবহার, সমন্বয়হীন সংস্কার কাজ, ড্রেনের ময়লা ড্রেনে ফেলা ও মেট্রোরেল ও ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রজেক্টের জন্য চলমান অসুবিধা।
ঢাকার জলাবদ্ধতা নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহম্মদ খান সময় সংবাদকে বলেন, ওয়াসা থেকে এ দায়িত্ব যখন সিটি করপোরেশনের হাতে আসে ততদিনে ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা অনেকখানি নষ্ট হয়ে গেছে। ওয়াসা থেকে খাল-বিলগুলো বুঝে নেয়ার পরে তারা বেশকিছু খাল-বিলের ময়লা পরিষ্কার করেছে এ কথা সত্য। তবে এটা দিয়ে আদৌ পুরো ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন করা যাবে কি-না এটা অনেক বড় একটি প্রশ্ন। সিটি করপোরেশন যে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব ময়লা-আবর্জনা আবার ফেরত এসেছে খালগুলোতে। রাজধানীর অভ্যন্তরে খালগুলোতে প্রতিনিয়ত ময়লা ফেলা হচ্ছে। যত্রতত্র ময়লা ফেলা নিয়ে যে নজরদারি থাকা দরকার সেটা কিন্তু আমাদের নেই। মোটা দাগে বলতে গেলে, সিটি করপোরেশন দায়িত্ব নেয়ার পরে বেশকিছু কাজ করলেও মনিটরিংয়ের অভাবে এসব কাজের সুফল রাজধানীবাসী বেশিদিন ভোগ করতে পারে না।
বৃষ্টি হলেই জমে যাচ্ছে পানি, দুর্ভোগে পড়ছেন নগরবাসী। বৃষ্টি এখন আর উপভোগ্য নেই, পরিণত হয়েছে জনদুর্ভোগে। জলাবদ্ধতাকে কেন্দ্র করে ঘটছে নানা রকমের দুর্ঘটনা, হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। এভাবে চলতে থাকলে ঢাকা শহরে নগরবাসীর ভোগান্তি আরও বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন