ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) বাইরে চায়ের দোকানগুলোর সামনে চিপস ও কোমল পানীয় খাচ্ছিলেন মাহমুদ হোসেন। খাওয়া শেষে চিপসের প্যাকেট ও কোমল পানীয়ের প্লাস্টিকের বোতলটি নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে গিয়ে ফেলেন, আবার ফিরে আসেন নিজের জায়গায়।
এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। রাজধানী শহরে যে যেভাবে পারছে, নিজেদের ইচ্ছেমতো যত্রতত্র ময়লা ফেলছে। টিএসসির চায়ের দোকানগুলোর সামনেই রয়েছে বেশ কয়েকটি ডাস্টবিন। কিন্তু অল্পসংখ্যক মানুষই ব্যবহার করে এই ডাস্টবিন। রাস্তাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্লাস্টিকের বর্জ্য, সিগারেটের ফিল্টার, টিস্যু ও ফেলে দেয়া নানা জিনিস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মাহমুদ হোসেন সময় সংবাদকে বলেন, ‘এই যে আমি উঠে ডাস্টবিনে ময়লা ফেললাম, এতে কিন্তু আমার কোনো সমস্যা হলো না। এটা যদি বাইরে ফেলতাম, তাহলে পরিবেশের ক্ষতি হতো। আমরা ভাবি, চিপসের একটি প্যাকেটে কিংবা চায়ের একটি প্লাস্টিকের গ্লাসে কী আর এমন দূষণ হবে। এভাবে আমরা একা নই, অনেকেই ভাবেন, আর তারা যত্রতত্র ময়লা ফেলেন। এতে রাজধানী শহর দিনকে দিন ডাস্টবিনে পরিণত হচ্ছে।'
সম্প্রতি নটর ডেম ন্যাচার স্টাডি ক্লাবে প্রায় একই কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেন, ‘সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমরা কেউ ভাবি না। প্রত্যেকে যদি নিজের ময়লাটা সঠিক জাগায় ফেলি, তাহলে পৃথিবীতে একটি বিশাল কাজ হয়ে যায়। আমাদের কারো দরকার নেই অন্য আরও ১০ জনের ময়লা ফেলা, নিজে যেটুকু তৈরি করছি, সেটুকুই সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করি, তাহলেই হয়ে যায়।'
করোনা মহামারির পর কেবল প্লাস্টিক নয়, ব্যবহৃত মাস্কের স্তূপও জমছে রাজধানীর প্রতিটি এলাকায়। বিশেষ করে জলাশয়গুলোতে ফেলা হচ্ছে ব্যবহৃত মাস্ক ও গ্লাভস। সম্প্রতি কানাডার জীববিজ্ঞানী জেনিফার প্রোভেঞ্চারের এক গবেষণায় দেখা যায়, ব্যবহৃত এসব বর্জ্য আমাদের চারপাশের জীবজগৎকে হুমকির মুখে ফেলছে। এতে করোনা শেষ হলেও নিজেদের দোষেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি আরেক বিপর্যয়ের দিকে।
গুলশান গুদারাঘাট থেকে এফডিসি পর্যন্ত ওয়াটার বাসে যারা যাতায়াত করেন, তাদের চোখে পড়বে হাতিরঝিল লেকে ভাসছে নানা ধরনের প্লাস্টিক সামগ্রী। মূলত যারা এসব এলাকায় বেড়াতে আসেন, আশপাশের বাসাবাড়িতে থাকেন, ওয়াটার বাসে যাতায়াত করেন, তাদের হাতেই দূষিত হচ্ছে হাতিরঝিলের পানি। কিন্তু ঢাকার এলাকাগুলোতে যতই দূষণ হোক না কেন, কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই কারো।
নাগরিকদের স্বভাব কীভাবে বদলাবে–এ ব্যাপারে সময় সংবাদের সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহম্মদ খানের। তিনি বলেন, 'সব দেশেই আপনি অসচেতন নাগরিক খুঁজে পাবেন। প্রথমত, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, পরবর্তী সময়ে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের বাগে আনতে হবে। এ ছাড়াও আমাদের দেখতে হবে ময়লা ফেলার মতো যথেষ্ট জায়গা ঢাকা শহরে আছে কি-না। প্রতিটি ওয়ার্ডে ময়লা ফেলার মতো জায়গা থাকতে হবে। একটি সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থাকলে মানুষ যত্রতত্র ময়লা ফেলবে না।'
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গত তিন বছরে রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন রাখতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ১ হাজার ৯২১ কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু এ বিপুল অর্থ খরচের পরও এখনো রাজধানীর প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে ওঠেনি সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ঢাকা উত্তর সিটিতে ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে অস্থায়ী বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র (এসটিএস) রয়েছে ৩২টিতে। এখন পর্যন্ত ২২টি ওয়ার্ডে গড়ে ওঠেনি কোনো এসটিএস।
একই অবস্থা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে এসটিএস আছে ৫৬টিতে। ১৯টি ওয়ার্ডে নেই কোনো অস্থায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে পাওয়া তথ্য থেকে দেখা যায়, গত তিন বছরে ৩২টি এসটিএস নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৪৩ কোটি টাকা, ল্যান্ডফিলের জমি অধিগ্রহণে ৫০২ কোটি, ল্যান্ডফিল উন্নয়নে ২৪ কোটি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও পরিদর্শকদের বেতন-ভাতা বাবদ ৩৭৯ কোটি ও বর্জ্য পরিবহনে ১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
অন্যদিকে, উত্তর সিটি করপোরেশনে জমি অধিগ্রহণে ৩৩৬ কোটি ও বাকি আনুষঙ্গিক কাজে ৫৮১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
টাকা ও সময় খরচের পরও কেন একটি সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করা যাচ্ছে না–এ ব্যাপারে আদিল মোহম্মদ খান বলেন, সিটি করপোরেশন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে যেভাবে কাজ করছে, সেখানে নাগরিকদের সম্পৃক্ততা কম। প্রাথমিকভাবে কোথায় কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে–সেটি বুঝতে অক্ষম সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশনের উচিত একটি বিজ্ঞানসম্মত সমাধান বের করা। কদিন আগে তারা বলল, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় এ কাজ এগোবে, সে ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। টেবিলে নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর বেশির ভাগই টেবিলে থেকে যায়। বাস্তবে আর প্রয়োগ করা হয় না।’
ঢাকাকে একটি বাসযোগ্য শহরে পরিণত করতে চাইলে ও সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে সিটি করপোরেশনের প্রথম কোন পদক্ষেপটি নেয়া উচিত–এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আদিল বলেন, ‘আগে সিটি করপোরেশনের উচিত ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি তৈরি করা। প্রতিটি ওয়ার্ডে যাতে ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। পরে ময়লা ফেলার জায়গা থাকার পরও যারা নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলবে না, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।'
এদিকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহরে গড়ে উঠেছে বড় রকমের অবৈধ ব্যবসা। বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহের নামে চলছে অনাচার ও অর্থ লুটপাট। দেড় বছর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা উত্তর সিটিতে এলাকাভেদে ১০০-৫০ টাকা করে বর্জ্য সংগ্রহের বিল নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও টেবিলে নেয়া সিদ্ধান্ত রয়ে গেছে টেবিলেই।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উত্তরবাড্ডা, মধ্যবাড্ডা ও পূর্ব বাড্ডা এলাকায় বর্জ্য সংগ্রহের জন্য আদায় করা হচ্ছে ১৫০-২০০ টাকা। গুলশান-বনানীতে এ খরচ ৩০০-৫০০ টাকা। বর্জ্য সংগ্রহের অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের নাম্বারে একাধিকবার ফোন ও সাংবাদিক পরিচয়ে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও কোনো জবাব দেননি তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন