রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে যানজটের শৃঙ্খলা আসছেই না। দিন দিন যানজটের নগরী হিসেবে বেড়েই চলেছে রাজধানীর পরিচিতি। এই যানজটের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয় পায়েচালিত রিকশাকে। ত্রিচক্র যানটি এখন কোনো বাধা ছাড়াই উঠে আসছে প্রধান ব্যস্ততম সড়কগুলোতেও।
পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সড়ক থেকে রিকশা তুলে নেওয়ার জন্য সিটি করপোরেশন ও ট্রাফিক বিভাগের পরিকল্পনার কথা দীর্ঘদিন ধরে শোনা গেছে। দু-তিনটি সড়ক ছাড়া পরিকল্পানাটি আর বাস্তবায়ন হয়নি। এ ব্যাপারে এখন আর তেমন কোনো তোড়জোড় নেই। ফলে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউর মতো প্রধান সড়কে রিকশার দেখা মিলছে হামেশাই। নিরসন ও সড়কে শৃঙ্খলা আনতে সিটি করপোরেশন যানজট ৫৩টি চৌরাস্তা প্রশস্তকরণ, অযান্ত্রিক যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, বাস রুট রেশনালাইজেশন, রাস্তার অবৈধ দখলদারদের অপসারণ, পার্কিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত স্থান নিশ্চিতকরণ, আধুনিকায়নসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বললেও সেসবের কোনো বাস্তবায়ন বা ফল নেই।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে অধিকাংশ প্রধান সড়কেই রিকশার আনাগোনা। কেউবা যাত্রী নিয়ে আবার কেউবা যাত্রীহীন রিকশা চালিয়ে ছুটে চলেছে সড়কগুলোতে। স্বল্পদূরত্বে উল্টাপথে যেতেও দেখা গেছে কাউকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাধাহীন চলাচল করছেন তারা। কোথাও কোথাও ট্রাফিকের দায়িত্বরতদের বাধার মুখে পড়লেও নানা অজুহাতে পার পেয়ে যায় রিকশা।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকারি অফিসের নতুন সময়সূচি সকাল ৮টা থেকে বেলা তিনটা। সাধারণত অফিস সময়ের সড়কে চাপ বেশি থাকে বলে যানজটের শুরু হয়। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার পরও রাজধানীর কয়েকটি সড়কে তীব্র যানজট লেগে ছিল। এই যানজটের ফাঁকে ফাঁকে অগণিত রিকশার আনাগোনা।
একইভাবে অফিস শেষে একই চিত্র দেখা গেছে। রাত সাড়ে ৮টার সময় রাজধানীর বাংলামোটর সিগন্যাল থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত যানজটের চিরচেনা রূপ। অধিকাংশ জায়গা জুড়েই রিকশার দখল। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি শহরের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকার কথা। তবে ঢাকার আয়তনের তুলনায় রাস্তার পরিমাণ মাত্র ৭ শতাংশ। আবার বিভিন্ন স্থানে উন্নয়নকাজের জন্য প্রায়ই সড়কের অনেকটা অংশ সংরক্ষিত হয়ে পড়ে।
একদিকে রাস্তার পরিমাণ কম, আরেক দিকে তরতর করে বেড়ে চলেছে অবৈধ রিকশা। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাস্তায় নামা এসব রিকশা ব্যস্ত সড়কে ম্যালাওয়ার হয়ে দেখা দিয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে, তাদের নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা ৩০ হাজার ১৫২টি। আর দক্ষিণ সিটি বলছে, সেখানে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে মোট রিকশা চলে ৭ লাখের বেশি। এর মধ্যে নিবন্ধিত রিকশা ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮টি। দুই সিটি মিলিয়ে বৈধ রিকশার সংখ্যা ২ লাখ ২৮ হাজার ১৬০টি।
ঢাকার দুই সিটিতে কত সংখ্যক রিকশা চলে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই তাদের কাছে। ধারণা করা হয় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ঢাকায় ১১ লাখের বেশি রিকশা রয়েছে। রিকশাচালক ও মালিকদের নিয়ে রাজধানীতে গড়ে উঠেছে অন্তত ২৮টির বেশি সংগঠন। এসব সংগঠন অবৈধ রিকশা নিয়ন্ত্রণ করে।
ট্রাফিকের দায়িত্বরতদের ভাষ্যমতে, প্রধান সড়কগুলোতে চলাচলে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকেন রিকশাচালকেরা। ট্রাফিকের চোখ ফাঁকি দিতে বিভিন্ন চেক পয়েন্টের আগে অলি-গলি দিয়ে পার হয়ে আবার প্রধান সড়কে উঠে পড়েন। এদিকে রিকশাচালকেরা দাবি করেন, টাকার বিনিময়ে সড়কে চলাচল করেন তারা।
রাজধানীর বাংলামোটরে কথা হয় রিকশাচালক হোসেন মিয়ার সঙ্গে। থাকেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউনহল এলাকায়। মোহাম্মদপুর থেকে বাংলামোটর রিকশা নিয়ে আসতে ট্রাফিকগুলো পার হয়েছেন কীভাবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টাকা দিলে সব জায়গায় যাওয়া যায়। যেখানে রিকশা আটকায় সেখানেই টাকা দিতে হয়। ১০ টাকা ২০ টাকা দিলেই ছেড়ে দেয়।’ অধিকাংশ রিকশাচালকের ভাষ্য এমনই।
প্রধান সড়কে রিকশার কারণে যানজটসহ বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় বলে জানান রাজধানীর আন্তজেলা বাসচালকেরা। সাভার পরিবহনের চালক মাজেদ মিয়া বলেন, ‘রাস্তায় রিকশা আর প্রাইভেট গাড়ি সবচেয়ে বেশি সমস্যা করে। কে কোনদিকে যাবে তার কোনো ঠিক নেই। এক একজন একেক দিকে গাড়ি ঢুকিয়ে বসে থাকে। এদের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে পড়ে থাকতে হয়।’
মাজেদ মিয়া বলেন, ‘আর রিকশার কথা কী বলব! দেখে তো মনে হয় রাস্তাগুলো সব তাদের। রাস্তার মাঝ দিয়ে যাতায়াত করে। হর্ণ দিলেও সাইড দেয় না। এদের কারণেই বেশি এক্সিডেন্ট হয়।’ এমনই ভাষ্য ওয়েলকাম পরিবহনের মাহবুব ও লাব্বাইক পরিবহনের হারুন শেখের।
প্রধান সড়কে রিকশার আনাগোনার বিষয়ে রমনা ট্রাফিক বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার জয়দেব চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের চোখে পড়লে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’ রিকশাচালকদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জয়দেব বলেন, এ রকম কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মো. শাহেদ আল মাসুদ বলেন, ‘আমাদের পুরো মোহাম্মদপুরের সড়কগুলোতে মাত্র ৭ জন ডিউটি করে। তাদের পক্ষে এতটা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। আমরা মিরপুর রোডে যাতে কোনো রিকশা না আসে এটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি।’
রিকশা চালকদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহেদ আল মাসুদ বলেন, ‘এখন তো টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সবার হাতে মোবাইল ফোন। ছবি তুলে প্রমাণসহ দিলে আমরা সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
১৯৮৬ সালের পর বেশ কয়েক বছর ঢাকায় রিকশার নিবন্ধন বন্ধ ছিল। মাঝে কিছু দিন দেয়া হয়। এরপর আবার বন্ধ। তবে প্রতিদিনই অবৈধভাবে নতুন রিকশা নামছে রাস্তায়। রিকশাচালক ও মালিকদের নিয়ে রাজধানীতে গড়ে উঠেছে অন্তত ২৮টির বেশি সংগঠন। এসব সংগঠনই নিজেদের মনগড়া ‘লাইসেন্স’ দিয়ে রিকশা নামায় সড়কে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে অবৈধ রিকশার সংখ্যা ১০ লাখ। এই অবৈধ রিকশা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে ঢাকা বিভাগ রিকশা ও ভ্যান মালিক সমিতি, বাংলাদেশ রিকশা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশন, মহানগর রিকশা মালিক লীগ, রিকশা ও ভ্যান মালিক শ্রমিক লীগ, মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ রিকশা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশন, জাতীয় রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগ ও বাংলাদেশ রিকশা মালিক লীগ, রিকশা শ্রমিক-মালিক লীগ, ঢাকা সিটি মুক্তিযোদ্ধা রিকশা-ভ্যান মালিক কল্যাণ সোসাইটিসহ ২৮টি সংগঠন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার পশ্চিমে সাতমসজিদ হাউজিং, চাঁদ উদ্যান, নবীনগর, ঢাকা উদ্যান এলাকায় রয়েছে অর্ধশতাধিক রিকশা-গ্যারেজ। প্রতিটি গ্যারেজে রিকশার সংখ্যা ২০ থেকে ৫০টি।
গাবতলি থেকে সদরঘাট বাবুবাজার পর্যন্ত বেড়িবাঁধ সড়কের উভয় পাশে রয়েছে অগণিত রিকশার গ্যারেজ। এর মধ্যে কেবল স্লুইজগেট সুনিবিড় হাউজিং, আদাবর-১০ নম্বর ও আদাবর-১৬ নম্বর এলাকার রিকশার গ্যারেজ আছে শতাধিক। এখানে রিকশার সংখ্যা হাজারের বেশি।
অন্যদিকে ভাটারা, রামপুরা, বনশ্রী, মুগদা, বাসাবো, উত্তরখান, দক্ষিণখান, কুড়িল, মিরপুর, গাবতলি এলাকায় রয়েছে অসংখ্য রিকশার গ্যারেজ। এসব গ্যারেজের রিকশা মিস্ত্রিরা পুরনো রিকশা মেরামতের পাশাপাশি প্রতিদিনই তৈরি করছেন নতুন নতুন রিকশা।
আর ভুঁইফোড় সংগঠন থেকে ২০-৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে দেয়া হয় এসব রিকশার নিবন্ধন। যদিও এসব গ্যারেজের প্রতিটিতে রিকশার লাইসেন্সের সংখ্যা এক থেকে দুটি করে। প্রতিটি লাইসেন্সের বিপরীতে রিকশা চলছে ১০ থেকে ২০টি।
বাংলাদেশ রিকশা ভ্যান মালিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আর এ জামান ঢাকাটাইমসকে জানান, নিবন্ধিত রিকশার তুলনায় রাজধানীতে অনিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা অনেক বেশি। অবৈধ রিকশা বন্ধে বারবার সিটি করপোরেশনের কড়া নেড়েও তাদের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি বলে অভিযোগ করেন এই রিকশা মালিক সমিতির নেতা। যানজট নিরসনে যত উদ্যোগ
ঢাকার যানজট নিরসনে জোড়-বিজোড় নম্বরের ভিত্তিতে গাড়ি চালানোর একটা পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। রাজধানীর খালগুলো পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে খনন করে সড়কপথের বিকল্প হিসেবে নদীপথে ব্যবহারের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিলেন তিনি।
এদিকে ডিএসসিসির উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- নৌরুট পুনরুদ্ধার, নতুন সড়ক নির্মাণ, বিদ্যমান সড়ক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, ৫৩টি চৌরাস্তা প্রশস্তকরণ, অযান্ত্রিক যানবাহন নিবন্ধন, বাস রুট রেশনালাইজেশন, রাস্তার অবৈধ দখলদারদের অপসারণ,পার্কিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত স্থান নিশ্চিতকরণ, আধুনিকায়নসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে নগরীর উপর যানবাহনের চাপ কমাতে ঢাকার প্রবেশপথে চারটি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল ও বাস ডিপো স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান দক্ষিণের মেয়র। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইন্টারনেট অব থিংস ট্রাফিক সিস্টেম বাস্তবায়ন করছি।’ এখন এসব উদ্যোগ কতটা বাস্তবায়ন হয়, কিংবা ফল দেয় তা-ই দেখার অপেক্ষায় রাজধানীবাসী।
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন