রাজধানীর মিরপুর থেকে সদরঘাটের উদ্দেশ্যে দুপুর ২টায় বিহঙ্গ বাসে ওঠেন আল আমিন। মিরপুর থেকে বাংলামোটর আসতে তার প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায়।
আল আমিন বলেন, মিরপুর ১০ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। রাস্তার কাজ করায় এক লেনে সব গাড়ি চলে। যেখানে মাত্র ৫ মিনিটের রাস্তা, তা পার হতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লেগেছে। শুধু তাই নয় বিজয় সরণি আর কারওয়ান বাজারের সিগন্যাল পার হতে ৪০-৫০ মিনিটের মতো সময় পার হয়েছে। আমার লঞ্চ ৫টায়। সেখান থেকে বাকি পথটুকু যেতে আরও কত ঘণ্টা লাগবে জানি না।
এর আগে দুপুর ২টার দিকে বাংলামোটরে যানজটে আটকা ওয়েলকাম পরিবহন থেকে নেমে হাটা শুরু করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান। তিনি জানান, তার পরিচিত একজন ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি রয়েছেন। তার রক্তের প্রয়োজন । দুপুর ১টায় রক্ত দেওয়ার কথা। কিন্তু যানজটের কারণে ১ ঘণ্টা দেরি হয়েছে। তাই হেঁটেই রওনা দিয়েছেন।
হাসপাতালগামী জাহিদ বা সদরঘাটগামী আল আমিনের মতোই ঢাকার লাখো বাসিন্দাকে এখন নিত্য পোহাতে হয় যানজটের চরম ভোগান্তি। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোও বাদ যাচ্ছে না। যানজটে আটকে বিলম্ব হয় শিক্ষার্থীদের, কারখানায় যেতে দেরি হয় শ্রমিকদের। ফলে প্রতিদিনই নষ্ট হচ্ছে লাখ লাখ কর্মঘণ্টা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীজুড়ে এখন দিন আর রাতে ২৪ ঘণ্টা যানজটে নাকাল হতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। প্রচুর কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। ট্রাফিকের নিয়মকানুন মানা হচ্ছে না। তা ছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তা কম। পর্যাপ্ত পরিমাণ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট না থাকায় অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। শুধু তাই নয়, রাজধানীতে সুনির্দিষ্ট পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় মানুষ রাস্তাতেই পার্কিং করে। এসব কারণও ট্রাফিক জ্যামের অন্যতম কারণ।
যাত্রীদের অভিযোগ, বেশির ভাগ চালক ও পথচারী ট্রাফিক আইন ও নিয়ম মানার ব্যাপারেও আন্তরিক নন। এখনো যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী তুলছেন চালকরা। এ ছাড়া আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতাও রয়েছে তাদের মধ্যে। ওভারব্রিজ থাকলেও অবাধে রাস্তা পার হতে দেখা গেছে যাত্রীদের। এর ফলে সড়কের গতি কমে যাচ্ছে।
সোমবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, পান্থপথ, শাহবাগ, পল্টন, সাতরাস্তা, মগবাজারসহ আশপাশের এলাকায় ছিল প্রচণ্ড যানজট। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন এলাকাগুলোতে যার তীব্রতা ছিল আরও বেশি।
যানজট কবলিত এলাকাগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কোনো এলাকায় উন্নয়নকাজের জন্য সড়ক সরু হয়ে গেছে, কোনো এলাকায় রাস্তার ওপরই করা হয়েছে পার্কিং, আবার কোনো এলাকায় চলছে ডাইভারশন।
কমলাপুর থেকে মোহাম্মদপুর বাসায় আসছিলেন সোহরাব হোসেন। মৌচাক থেকে মগবাজার আসতে প্রায় ২০ মিনিট গাড়িতে বসে ছিলেন তিনি।
এই প্রতিবেদককে সোহরাব বলেন, দুপুর ১২টায় কমলাপুর থেকে বাসে উঠেছি। কমলাপুর থেকে মৌচাক আসতে আধা ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে । মৌচাক থেকে মগবাজার আসতে সময় লেগেছে ২০ মিনিট এখন সিগন্যাল পার হতে পারিনি। এরপর বাংলামোটর , ফার্মগেট, সংসদ ভবনের সিগন্যাল তো রয়েছে।
এ সময় মগবাজারে দাঁড়িয়ে থাকা স্বাধীন বাসের সহকারী মনির বলেন, মৌচাক থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা খারাপ। রাস্তার দু পাশে ড্রেনের কাজ চলে। তার ওপর আবার রাস্তার পাশে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি পার্কিং করা। ফলে রাস্তা অনেক সরু হয়ে গেছে। যার কারণ এই রাস্তায় অনেক দিন ধরে তীব্র যানজট হয়। রাস্তায় পার্কিং না থাকলে এখানকার যানজট অনেকটা কমে যেত।
রাজধানীর কলাবাগানে সিগন্যালে থেকে বিরক্ত হয়ে মোটরসাইকেল থেকে নেমে ফুটপাতে পায়চারি করছিলেন হাসনাইন আহমেদ।
তিনি বলেন, সকালে জ্যাম ঠেলে অফিসে এসেছি। এখন আবার অফিসের কাজে শ্যামলী যাচ্ছি। আজিমপুর থেকে কলাবাগান আসতে ৪০ মিনিট লেগেছে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে অনেক সময় লেগে যায়। দশ মিনিটের পথ দেড় ঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টায়ও যাওয়া যাচ্ছে না।
যানজট তীব্র থাকায় এই এলাকায় রিকশা ভাড়াও বেড়ে গেছে।
কাঁঠাল বাগানের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, ধানমন্ডি থেকে কাঁঠাল বাগানের রিকশা ভাড়া ৪০-৫০ টাকা ছিল । এখন ৭০-৮০ টাকার নিচে কেউ যেতে চায় না। এ সড়কে আগে এত যানজট ছিল না। দিন যত যাচ্ছে এ এলাকার যানজটও তত বেড়েছে।
শাহবাগে অর্নব সরকার নামে এক পথচারী বলেন, সড়কে কেউ সিস্টেমই তো মেনে চলে না। এতেই যানজটের সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া যারা গাড়ি চালায় তারা কোনো আইন মানে না। যে যেমন পারে তেমন করে আগে যাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। সব জায়গায় বাস স্টপেজ রয়েছে। অথচ কোনো স্টপেজে গাড়ি থামে না। চলাচলের রাস্তা আটকে যাত্রী ওঠানামা করে। সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নিলেও তা কাগজে-কলমে থাকে। সব সময় আমরা যারা সাধারণ মানুষ আছি তারাই ভুক্তভোগী।
নগরবাসীর অভিযোগ, যানজটের এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। যানজট নিরসনে নেয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা এবং মহাপরিকল্পনা। এ কারণেই ঢাকার কোনো সড়ক এক দিন হয়তো ‘ওয়ান ওয়ে’, আবার পরের দিনই হয়ে যাচ্ছে ‘টু ওয়ে’। আজ এ সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ, কাল আবার খুলে দেওয়া হচ্ছে। কোনো রাস্তায় আবার চলছে আইল্যান্ড বা সড়ক দ্বীপ তৈরি এবং ভাঙার খেলা। কিন্তু তার ফলাফলও শূন্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি শহরের রাস্তার পরিমাণ হওয়া উচিত মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ। অথচ ঢাকায় তা মাত্র ৭-৮ শতাংশ। প্রতিদিন জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহন। ফলে যানজটও বাড়ছে। বিশেষ করে ব্যক্তিগত গাড়ির কারণে যানজটের অবস্থা বেশি খারাপ হচ্ছে।
যানজটের বিষয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান দেশ রূপান্তরকে বলেন, যানজট নিরসনে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন খুবই কম। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে কোনো পরিকল্পনা নেই। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে কোনো রাস্তা বন্ধ করার আগে সেখানে বিকল্প রাস্তা তৈরি করা হয়। আমাদের দেশে সেসব কোনো ব্যবস্থা নেই।
তিনি বলেন, দেশে যে ট্রাফিক আইন আছে তা শতভাগ কার্যকর করতে হবে। কোন রাস্তায় কোন ধরনের গাড়ি চলতে পারবে সেসব ঠিক করা দরকার। আইনের শতভাগ প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবহন ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আনতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন