রাজধানীর পুরান ঢাকার প্লাস্টিক কারখানা ও রাসায়নিক গুদামে প্রায়ই আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। গত এক যুগে এই এলাকায় আগুনের ঘটনায় দুই শতাধিক প্রাণ ঝরেছে। সম্পদ ধ্বংস হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার। তবুও বদলায়নি পুরান ঢাকার চিত্র। এখনো রাসায়নিকের গুদাম, দোকান ও কারখানা রয়েছে বহাল তবিয়তে। গত ১২ বছরে পুরান ঢাকার বড় দুটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কাঁদিয়েছে দেশবাসীকে। নাড়িয়ে দিয়েছে অনেক কিছু।
২০১০ সালে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো পুরান ঢাকার নিমতলীতে রোমহর্ষক এক অগ্নিকা্লে ১২৪ জন মানুষ আগুনে পুরে মারা যান। এরপর ২০১৯ সালের পহেলা মার্চ চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডে ৭০টি তাজা প্রাণ অকালে ঝরে গেল।
এছাড়া গতবছর ২২ এপ্রিল পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় আবাসিক ভবনের রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগে মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের। তবুও চকবাজার ও নিমতলী অগ্নিকাণ্ড থেকে কেউ কোনো শিক্ষা নেয়নি। এখানকার জীবনধারায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। এমনকি আগুন ট্রাজেডির পর বাস্তবায়ন হয়নি সরকারি আশ্বাসের।
ফলে একই রকমের ভৌত পরিস্থিতিতে শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) লালবাগ প্লাস্টিক কারখানায় আগুনের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। কিন্তু একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নগরবিদরা। ভবিষ্যতে এমন অগ্নি-বিভীষিকার পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য এখনই সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তারা।
পুরান ঢাকায় প্লাস্টিক কারখানা ও আবাসিক ভবনের রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার এই ঘটনা নতুন নয়, অথচ রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থাগুলো এত ধীর কেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। যদিও বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই কেবল নড়াচড়া শুরু হয় সংশ্লিষ্টদের। সরকারে পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও তার বাস্তবায়ন নেই। চলে শুধু রুটিন অভিযান। ফলে কয়েক বছর পর পর ঘটছে আগুন ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি।
অন্যদিকে নিমতলী ও চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তখনকার মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন, এ এলাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেওয়া হবে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও রাসায়নিক ব্যবসা দ্রুত সরিয়ে নিতে পল্লি ও অস্থায়ী গুদাম নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল। তার কোনটি আজো বাস্তবায়ন হয়নি।
২০১০ সালের ৩ জুন আরমানিটোলার জনবসতির পাশে স্থাপিত একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরিত হলে সেখান থেকে আশপাশের বাড়িগুলোতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশের দোকানগুলোতে থাকা রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আগুন আরো বিস্তৃত হয়, দ্রুত গ্রাস করে সবকিছু। এছাড়া আক্রান্ত এলাকাটি ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় অগ্নিনির্বাপক কর্মীদের ওই এলাকায় যেতে ও কাজ করতে বাধার সম্মুখীন হতে হয়, যা দ্রুত অগ্নিনির্বাপণ বাধাগ্রস্ত করে। পুরান ঢাকা এলাকার সংকীর্ণ অলি-গলি দিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও অগ্নিনির্বাপক গাড়ি প্রবেশ করাতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
সেই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগ্নিকাণ্ডের যথাযথ কারণ উদঘাটনের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। তিনি সেই সঙ্গে ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহতদের পরিবারবর্গের প্রতি তার গভীর সমবেদনা জানান। তার সরকার ৫ জুন, ২০১০ সারা দেশে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে। নিমতলীর ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের দায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ওই ট্র্যাজেডিতে আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া তিন কন্যা উম্মে ফারওয়া আক্তার রুনা, সাকিনা আক্তার রত্না ও আসমা আক্তার শান্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি। নিজের কন্যা পরিচয়ে তিনি নিজেই তাদের বিয়েও দেন।
নিমতলী ট্র্যাজেডির জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধের জন্য ১৭ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল। তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার মিল-অমিল উভয়ই রয়েছে। ১৭ দফার উল্লেখযোগ্য দিক হলো- জরুরিভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেওয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্য বা বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুদকরণ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা ও ৬২ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করাসহ আরো অনেক কিছু। আশ্চার্যের বিষয় হলো এর একটি দফাও আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
এ অবস্থায় পুরান ঢাকার বাসিন্দারা বলছেন, আমরা এখন আর আশ্বাসে বিশ্বাস করতে চাই না। সরকারি উদ্যোগ ও আশ্বাসের বাস্তবায়ন দেখতে চাই। নিরাপদে বসবাসের নিশ্চয়তা চাই। তারা আরও বলেন, একেকটি আগুন ট্র্যাজেডি ঘটে আর সরকারের পক্ষ থেকে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুই বাস্তবায়ন হয় না।
আরমানিটোলার বাসিন্দা মিরাজ হোসেন বলেন, নিমতলী ও চুরিহাট্টা ট্র্যাজেডির পর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এলাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরিয়ে নেওয়ার। গঠন করা হয়েছিল তদন্ত কমিটি। গত ১২ বছরেও কমিটির দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো সরানো হয়নি রাসায়নিকের গুদাম ও অবৈধ কারখানা। এরপর আরমানিটোলায় আবার আগুন লাগে।
শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) আবার লালবাগ প্লাস্টিক করাখানায় আগুন লাগে। তাই এখান থেকে রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা সরাতে না পারলে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা থাকবে না। ব্যবসায়ীদের দাবি, পুরান ঢাকায় এখন রাসায়নিক ব্যবসা করেন ১ হাজার ২০০ ব্যবসায়ী। রাসায়নিকের ধরন আছে প্রায় ৫ হাজার রকমের। এর মধ্যে কিছু রাসায়নিক অতিদাহ্য। এলাকায় প্লাস্টিকের কারখানা ও গুদাম রয়েছে প্রায় ১ হাজার। চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর ওয়াহেদ ম্যানশনের আশপাশের গুদামগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
তবে মিটফোর্ড সড়ক, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী সড়ক, আরমানিয়ান স্ট্রিট, মাহুতটুলী সড়কে সরেজমিনে ঘুরে সেখানে শিল্পকারখানায় ব্যবহূত রাসায়নিকের দোকান ও গুদাম দেখা গেছে।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক নুরুল আক্তার বলেন, আমরা আগুন লাগলেই সচেতন হই। সরকারও একটু নড়েচড়ে বসে। আবার কিছুদিন পর সবাই ভুলে যায়। ফলে একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের বার বার গুদামের জন্য জায়গা দেওয়ার কথা বলা হলেও জায়গা দিচ্ছে না সরকার। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, এ ধরনের দুর্ঘটনা বন্ধে অবিলম্বে আমাদের একটি নির্দিষ্ট জায়গা দেওয়া হোক। কারখানা ও গুদামের জন্য আমরা সরকারকে টাকা দিতেও প্রস্তুত আছি।
ফায়ার সার্ভিসের লালবাগ স্টেশনের একজন কর্মকর্তা জানান- পুরান ঢাকা প্রতি মাসে গড়ে একটি করে আগুন লাগছে। এর কারণ হিসাবে তিনি জানান, প্লাস্টিক কারখানা বা গোডাউনের জন্য যারা বাসা ভাড়া দিচ্ছে না তারা দ্বিগুণ বা তিনগুণও ভাড়া পাচ্ছে। তাই যত্রতত্র এখানে প্লাস্টিক কারখানা ও রাসায়নিক গুদাম গড়ে উঠছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা।
২০২০ সালের ১১ ডিসেম্বর, চকবাজারের উর্দু রোডের একটি তিন তলা ভবনের কারখানায় আগুন লাগে। তিনটি ফায়ার স্টেশন থেকে ১৩টি ইউনিট এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। চারতলা ভবনটি প্লাস্টিকের গুদাম ও কারখানায় ঠাসা। এর তিনটি ফ্লোর পুড়েছে। ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি ইসলামবাগে একটি প্লাস্টিক কারাখানায় আগুন লাগে। এতে প্রচুর সম্পদের ক্ষতি হয়। ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামবাগে একটি প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে এক শিশুসহ তিনজন নিহত হয়।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন